বাংলাদেশের পরিবর্তিত রাজনৈতিক বাস্তবতায় প্রায় সকল সেক্টর নতুনভাবে ঘুরে দাঁড়ানোর চেষ্টা করছে। দেশের সরকারি-বেসরকারি বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান-সংগঠন নতুন নেতৃত্বের মাধ্যমে প্রাতিষ্ঠানিক গতিশীলতা ধরে রাখছে। অথচ সৃজনশীল প্রকাশনা জগতের চিত্রটা এখনও যেন পুরোপুরি উল্টো!
পুস্তক প্রকাশক ও বিক্রেতাদের একমাত্র বাণিজ্যিক সংগঠন ‘বাংলাদেশ পুস্তক প্রকাশক ও বিক্রেতা সমিতি’র নেতৃত্ব বদলের চেষ্টা হলেও পুরো প্রক্রিয়াটি এখনও সমাধানের পথে এগোয়নি। তাই মূলত স্থবির হয়ে আছে এই সংগঠনের কার্যক্রম। অন্যদিকে বেশ কয়েক বছর ধরেই সৃজনশীল প্রকাশকদের সংগঠন ‘বাংলাদেশ জ্ঞান ও সৃজনশীল প্রকাশক সমিতি’র কার্যক্রম বন্ধ রয়েছে আইনি জটিলতার মারপ্যাঁচে। এমন জটিল পরিস্থিতিতে প্রকাশনা শিল্পের বিভিন্ন উদ্যোগ-আয়োজন নিয়ে সরকারের সঙ্গে যোগাযোগের প্রক্রিয়া ও পথটি আপাতত বন্ধ হয়ে আছে। কলকাতায় বিগত ১৩ বছর নিয়মিতভাবে আয়োজিত হওয়া ‘বাংলাদেশ বইমেলা’র কার্যক্রমও শুরু করা যায়নি। দেশের বাইরে নিয়মিতভাবে এই বইমেলার আয়োজন শুরু হয় বাংলাদেশ জ্ঞান ও সৃজনশীল প্রকাশক সমিতির হাত ধরে। পরবর্তীতে বাংলাদেশ পুস্তক প্রকাশক ও বিক্রেতা সমিতির মাধ্যমে কয়েক বছর বইমেলা আয়োজিত হয়ে আসছে। কলকাতাস্থ বাংলাদেশ উপ-হাই কমিশনের সহযোগিতায় আয়োজিত এই বইমেলায় অর্থনৈতিকভাবে সহযোগিতা করে রপ্তানী উন্নয়ন ব্যুরো। কিন্তু দেশের পরিবর্তিত রাজনৈতিক পরিস্থিতিতে এ বছর বাংলাদেশ বইমেলা আয়োজন সম্ভব হবে না বলে মনে করছেন প্রকাশকরা।
সমিতির নেতৃত্বশূন্যতা প্রকাশকদের কপালে চিন্তার ভাঁজ তৈরি করেছে আরও একটি ইস্যুতে। সেটি হচ্ছে বাংলা একাডেমি আয়োজিত অমর একুশে বইমেলা। বইমেলা আয়োজক কমিটিতে প্রকাশক প্রতিনিধির অংশগ্রহণ থাকে প্রতি বছর। কিন্তু বর্তমানে এই প্রতিনিধির ব্যাপারটিও ঝুলে আছে।
সামগ্রিক পরিস্থিতি বিবেচনায়, বাংলাদেশের প্রকাশনা জগতে নেতৃত্ব সংকট ক্রমশ স্পষ্ট হয়ে উঠছে। এই বাস্তবতায় প্রায় দুই মাস ধরে বেশ কয়েকজন সৃজনশীল প্রকাশকের উদ্যোগে সকল স্তরের প্রকাশকদের নিয়ে একাধিক মতবিনিময় সভার আয়োজন করা হয়।
এরই ধারাবাহিকতায় সম্প্রতি রাজধানীর একটি রেস্তোরাঁয় সর্বস্তরের সৃজনশীল প্রকাশকদের একটি মতবিনিময় সভা অনুষ্ঠিত হয়। অনুষ্ঠানে সভাপতি ছিলেন দ্য ইউনিভার্সিটি প্রেস লিমিটেড ইউপিএল)-এর প্রকাশক ও স্বত্বাধিকারী মাহরুখ মহিউদ্দিন। আলোচক হিসেবে ছিলেন প্রকাশনা প্রতিষ্ঠান ঐতিহ্য-এর কর্ণধার ও প্রকাশক আরিফুর রহমান নাঈম, বাতিঘর-এর প্রকাশক ও স্বত্বাধিকারী দীপংকর দাশ, আদর্শ-এর সিইও মাহাবুব রহমান, সূচিপত্রের সাঈদ বারী, আবিষ্কার প্রকাশনীর দেলোয়ার হাসান।
সরকারী ক্রয়নীতি, এসইডিপি প্রকল্প ও বিভিন্ন বইমেলা নিয়ে সর্বস্তরের প্রকাশকদের নিয়ে ‘প্রকাশক সংলাপ ১’ শীর্ষক ভিন্নধর্মী এই আয়োজন প্রকাশক মহলে ব্যাপক সাড়া ফেলেছে।বিগত ১৫ বছর ধরে বাংলাদেশ জ্ঞান ও সৃজনশীল প্রকাশক সমিতি এবং বাংলাদেশ পুস্তক প্রকাশক ও বিক্রেতা সমিতির নেতৃত্বে থাকা পরিচিত কিছু মুখের বদলে এ দিন মঞ্চে থাকা তরুণ ও নতুন প্রজন্মের প্রকাশক নেতৃত্ব সাধারণ প্রকাশকদের আশাবাদী করে তুলেছে।
এছাড়াও জাতীয়তাবাদী রাজনীতির ঘনিষ্ঠজন হিসেবে পরিচিত ইতি প্রকাশনীর স্বত্বাধিকারী ও প্রকাশক জহির দীপ্তিও নতুন নেতৃত্ব হিসেবে সাধারণ প্রকাশকদের পছন্দের তালিকায় আছেন।
উল্লেখ্য, সমিতির পদ-পদবী ব্যবহার না করেও ইউপিএল, ঐতিহ্য, বাতিঘর, আদর্শ বাংলাদেশের উল্লেখযোগ্য ও গুরুত্বপূর্ণ প্রকাশনা প্রতিষ্ঠান হিসেবে পাঠক ও লেখকমহলে বেশ পরিচিত। এই চারজন ছাড়াও জহির দীপ্তিসহ আরও কিছু নতুন প্রকাশককে সমিতি কিংবা প্রকাশনা প্রতিষ্ঠানের নতুন কোনো ফোরামে নেতৃত্বের আসনে দেখতে আগ্রহ প্রকাশ করেছেন অসংখ্য প্রকাশক।
ভাষাপ্রকাশ-এর প্রকাশক ড. মিজান রহমান বলেন, ‘বাংলাদেশের প্রকাশনা জগতকে আধুনিক হিসেবে গড়ে তুলতে হলে আমাদের প্রকাশনা ইন্ডাস্ট্রির চিহ্নিত দুর্বৃত্ত ও সুবিধাবাদী নেতৃত্বের বদল করতে হবে। আমরা মনে করি, নতুন ও তরুণ নেতৃত্বের মাধ্যমেই এই বদল সম্ভব।’
উপস্থিত সকল প্রকাশক অবিলম্বে অমর একুশে বইমেলা, সরকারি ক্রয়সহ বিভিন্ন নীতিনির্ধারণী মহলে প্রকাশকদের পক্ষ থেকে যোগ্য প্রতিনিধি পাঠানোর ওপর গুরুত্ব আরোপ করেন। অমর একুশে বইমেলা ২০২৫ সফল করে তোলার জন্যও বিভিন্ন পরামর্শ দেন।
বাতিঘর-এর প্রকাশক দীপংকর দাশ বলেন, ‘একটি শক্তিশালী ট্রেড বডি তৈরি করতে না পারলে প্রকাশক ইন্ডাস্ট্রি নিয়ে স্বপ্ন দেখা খুব কঠিন। সর্বস্তরের প্রকাশকদের নিয়েই এই ট্রেড বডি সংস্কারের মাধ্যমে আমাদের এগিয়ে যেতে হবে।’
ঐতিহ্যের স্বত্বাধিকারী ও প্রকাশক আরিফুর রহমান নাঈম বলেন, ‘সৃজনশীল প্রকাশকদের কোনো সভা-সমিতিতে আমার কখনও যাওয়া হয়নি। এবারই প্রথম। আমরা মনে করি, বিগত সময়ে যেভাবে আমাদের সমিতির কর্মকাণ্ড পরিচালিত হয়েছে তা স্বচ্ছতার ভিত্তিতে হয়নি। এই সংস্কৃতির আমূল পরিবর্তন প্রয়োজন। সমিতি পরিচালিত হতে হবে সকল সদস্য প্রতিষ্ঠানের স্বার্থ রক্ষার্থে, ন্যায্যতার ভিত্তিতে। স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতার চর্চাও জরুরি।’
সভাপতির বক্তব্যে মাহরুখ মহিউদ্দিন বলেন, ‘আমরা চাই ন্যায্যতা ও স্বচ্ছতার ভিত্তিতে প্রকাশনা জগতের জন্য ক্রয়নীতি প্রণয়ন করা হোক। লেখক বা প্রকাশনা প্রতিষ্ঠান নয়, বইয়ের কনটেন্ট বা মেরিট দেখে বই ক্রয়ের সিদ্ধান্ত নেয়া হোক। সর্বস্তরের প্রকাশকদের ঐক্য প্রতিষ্ঠার মাধ্যমেই আমাদের সকল দাবি-দাওয়া সরকারের নীতি নির্ধারকদের কাছে পৌঁছে দেয়া সম্ভব।’
উল্লেখ্য, বিগত বছরগুলোতে সমিতির বিভিন্ন পদ-পদবী ব্যবহার করে স্বৈরাচারী কায়দায় একদল প্রকাশক সিন্ডিকেট করে সকল ধরনের সুযোগ-সুবিধা নিয়েছে বলে অভিযোগ রয়েছে। সাধারণ প্রকাশকরা তাই সমিতির নেতৃত্বে নতুন মুখ দেখতে আগ্রহী। অসংখ্য প্রকাশক এরইমধ্যে আগ্রহী হয়ে উঠেছেন নতুন নেতৃত্বের ব্যাপারে। ইউপিএল, ঐতিহ্য, বাতিঘর, আদর্শ এবং ইতি প্রকাশনীর প্রকাশকদের হাতেই কি দেখা যাবে প্রকাশনা জগতের নতুন নেতৃত্ব? উত্তর খুঁজতে হয়তো আরও কিছুদিন অপেক্ষা করতে হবে প্রকাশকদের।
কপিরাইট © ২০১৭ - ২০২০ ।। বইদেশ-এ প্রকাশিত কোনও সংবাদ, কলাম, তথ্য, ছবি, কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না
Design & Development by: TeamWork BD