॥ সুমন টিংকু ॥
আবু হাসান শাহরিয়ার, নামই যার পরিচয়- একজন কবিবৃক্ষ এবং আচরণে ঠোঁটকাটা সত্য কথক। সত্য উচ্চারণে তিনি অকপট এবং দুঃসাহসী, তা আপনি যেই হোন না কেন বা তাঁর যত কাছেরই হোন না কেন, সেটি যদি আপনার বিরুদ্ধেও যায়, তাতে তাঁর কিসসু যায় আসে না।
১৯৯৭/৯৮ সালের কথা। তিনি তখন ‘দৈনিক মুক্তকন্ঠ’ সংবাদপত্রে কর্মরত, তখনই তাঁকে চাক্ষুষ দেখি ( তাঁর সাথে আমার প্রত্যক্ষ পরিচয় আরও কুড়ি বছর পরে)। আমি তখন ঐ পত্রিকাটিতে অনিয়মিতভাবে নাট্য সমালোচনা লিখছি, তাই মাঝে মাঝেই সেখানে যেতাম। তাঁকে দেখতাম। কখনও পরিচিত হবার সাহসটুকু করে উঠতে পারিনি। তাঁর সম্পাদিত ‘খোলা জানালা’র অবারিত ঋদ্ধ হাওয়ায় তখন গা ভেজাচ্ছি।’খোলা জানালা’র হাওয়া গোগ্রাসে গিলতাম। পরবর্তীতে ‘মুক্তকণ্ঠ’র সঙ্গে সম্পর্ক শেষ হয়ে যাওয়ার পরেও বেশ কিছুদিন তিনি এই সাহিত্য পাতাটি নিজ উদ্যোগে প্রকাশ করেছিলেন। সপ্তাহজুড়ে প্রতীক্ষায় থাকতাম ‘খোলা হাওয়া’র জন্য।
কবিতার সাথে আমার ওঠাবসা তরুণ বয়সেই। নীরেন্দ্রনাথ চক্রবর্তীর ‘কবিতার ক্লাস’ আমার সিথানে থাকত। কলিকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র থাকা অবস্থায় কলেজ স্ট্রিটের লিটলম্যাগপাড়ায় আমার নিত্য যাতায়াত। সেইসূত্রে কবি তুষার চৌধুরীর (প্রখ্যাত ভাষাচিত্রী শ্যামল গঙ্গাপাধ্যায়ের জামাতা) সাথে আমার বন্ধুত্ব বেশ গভীরে গিয়ে পৌঁছে। সেটা অন্য প্রসঙ্গ।
আসল প্রসঙ্গে আসি। কবিতার প্রতি ভালোবাসার কারণেই কবিতা চর্চা আমার মজ্জায় গেঁডে বসে। আমি লেখার চেষ্টা চালিয়ে যাই। ফেইসবুকে লিখি, পত্রিকায় লিখি।
২০১৬ সালের দিকে সাহস করে কবি আবু হাসান শাহরিয়ারকে ফেসবুকে বন্ধুত্বের আহ্বান জানিয়ে বসি এবং তিনি তাতে সাড়া দিয়ে আমাকে সম্মানিত করেন।
আমাকে অবাক করে দিয়ে তিনি আমার কবিতায় মন্তব্য করতে থাকেন।আমি বিস্মিত হই, আপ্লুত হই। কারণ, এই সংস্কৃতির সাথে আমি পরিচিত নই। ফেসবুকে আমার বন্ধু বলয়ে অনেক কবি আছেন, যাঁরা কখনও আমার কবিতায় মন্তব্য দূরে থাক, লাইক ইমো অব্দি দিতে দ্বিধায় তাড়িত হন। তাঁদের কবিতা নিয়মিত ছাপার জন্য পত্রিকাওয়ালারা হাপিত্যেশ করে বসে থাকেন। কবিতা পাঠের আসরে তাঁদের নিয়মিত আলোকিত উপস্থিতি। সেই তাঁরা কোথাকার কোন ব্রাত্য সুমন টিংকুর কবিতায় লাইক মারবেন- নৈব নৈব চ। একটা উন্নাসিকতা — ‘ সবাই কবি নয়, কেউ কেউ কবি’।
তো, সেই অখ্যাত সুমন টিংকুর কবিতায় কি না আবু হাসান শাহরিয়ার মন্তব্য করেন এবং তাও নিয়মিত প্রায়। আমার কাছে তো হাতে চাঁদ পাওয়ার দশা। তাঁর একটি স্ট্যাটাসে তিনি বলেছিলেন, ম্যাসেন্জারে ইনবক্স করে পিরিত জমানো তাঁর পছন্দ নয়, যা কিছু হবে খোলাখুলি, তো সেই ভয়ে তাঁর সাথে কথার সখ্য আর হয় না।
গতবছর একুশে বইমেলার আগে আগে তিনি কার কার বই সংগ্রহ করবেন তার একটা তালিকা ফেসবুকে দিলেন। দেখলাম, বেশিরভাগই নবীন কবি। আমি আনন্দে কেঁদে ফেললাম, না আমার কোনাে বই বের হয়নি। আমি আপ্লুত হলাম, তাঁর দায়িত্ববোধ দেখে। যেখানে, প্রতিষ্ঠিত কবিরা নবীনদের পাত্তাই দেন না, সেখানে তিনি এগিয়ে এসে হাতটা ধরছেন। অবশ্য, এটি তাঁর মজ্জাগত। তিনি বিভিন্ন পত্রিকায় সম্পাদক থাকাকালীন এবং তাঁর ‘খোলা জানালা’য় অসংখ্য, অসংখ্য নবীন লেখকদের সম্মান জানিয়েছেন। এ প্রসঙ্গে বলি, গতবছর একুশে ফেব্রুয়ারির সংখ্যায় ছাপানোর জন্য চট্টগ্রামের একটি নামী এবং কুলীন দৈনিকের সাহিত্য পাতার জন্য একটা কবিতা পাঠিয়েছিলাম, সেটি ডাস্টবিনে স্থান পেয়েছে। এই কবিতাটি অবশ্য পরে অন্য আর একটি নামি দৈনিকে ছাপা হয়। তো, সেইদিন থেকে প্রত্যাখ্যাত হওয়া ঐ পত্রিকাটিতে আর কোনাে কবিতা পাঠানোর দুঃসাহস দেখাইনি (তাতে অবশ্য ঐ পত্রিকাটিরও নিশ্চয়ই কিছু যায় আসে না)।
এ বছর একুশে বইমেলায় প্রথমবারের মতাে শাহরিয়ার ভাইয়ের সাথে আমার প্রত্যক্ষ সাক্ষাৎ। দুজনে মিলে কবিতা নিয়ে অনেকক্ষণ আড্ডা দিলাম। তাঁর অনুরোধে (আমার কাছে নির্দেশ) এইবার বোধহয় কবিতার একখানা বই বের করেই ফেলব।
তাঁকে দেখে একটা কথাই মনে হয়, ‘উত্তম নিশ্চিন্তে চলেন অধমের সাথে, তিনিই মধ্যম , যিনি চলেন তফাতে’।
কবি আবু হাসান শাহরিয়ার বলেন, ‘পদক-পদবী নয়, পাঠকই কবির শেষ ঠিকানা।’ এই সাহসেই এখনো লিখে যাচ্ছি। পাঠকের ভালোবাসায় আপ্লুত হই। শেষ পর্যন্ত পাঠকই তো লেখককে বাঁচিয়ে রাখেন।
কপিরাইট © ২০১৭ - ২০২০ ।। বইদেশ-এ প্রকাশিত কোনও সংবাদ, কলাম, তথ্য, ছবি, কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না
Design & Development by: TeamWork BD