॥ শাহেদ কায়েস ॥
আমার মা
যদিও আমরা ভাইবোন সবাই বাড়িতে আম্মা বলি, মনে মনে আমি মা বলি।
“আমি একদিন থাকমু না, ছবিটা থাকব, বালা কইরা তুলিছ” ছবি তুলতে গেলেই আম্মা এই কথাটা বলেন। আম্মা বেশি বেশি ছবি তোলা পছন্দ করেন না। আমি এখানে-সেখানে প্রচুর ছবি তুলি, আম্মা সাথে থাকলে বিরক্ত হন, বলেন— “এতো ছবি তুইলা কি মজা পাছ?”
আম্মা ছবি তোলার ব্যাপারে খুব চুজি, যখন-তখন ছবি তোলা পছন্দ করেন না, ছবি তুললে দেখতে চান, ভালো না লাগলে বলেন— ‘বালা হয় নাই, এইটা মুছে দে’। আম্মা ঘরে কখনো চশমা পরেন, কখনো পরেন না। কিন্তু চশমা ছাড়া ছবি তুলতে চান না।
আম্মার জন্ম, বেড়ে ওঠা শহরে, নরসিংদীতে; সাটিরপাড়া গার্লস স্কুলের ছাত্রী ছিলেন, বিয়ের পর আব্বার সরকারি চাকরির সুবাদে বাংলাদেশের বিভিন্ন শহরে শহরে… এরপর দাদা মারা যাওয়ার পর যখন আমি চতুর্থ শ্রেণিতে তখন দাদার বাড়ি সোনারগাঁয়ের ললাটি গ্রামে সেটেল হলাম আমাদের পুরো পরিবার।
আম্মার জীবনের বড়াে একটা সময় শহরে কাটলেও গ্রামে এসে গ্রামীণ জীবনে অভ্যস্ত হতে খুব সময় লাগেনি, গ্রামের পরিবেশ, মানুষকে ভালোবেসে ফেলেছেন খুব অল্প সময়েই। জীবনে যে কোনো পরিস্থিতিতে নিজেকে মানিয়ে নেওয়ার বিষয়টা আম্মার মধ্যে আমি সব সময়ই লক্ষ্য করেছি। আমার মধ্যেও এটা আছে। আমার মনে হয় এটা আমি আমার মায়ের কাছ থেকেই পেয়েছি।
আম্মা একজন সৎ, খুব সহজ-সরল, কিন্তু খুবই ব্যক্তিত্বসম্পন্ন মানুষ। সহজতার মধ্যে যে একটা দুর্দান্ত শক্তি লুকিয়ে থাকে এই বিশ্বাস আমার মনের মধ্যে দৃঢ় হয়েছে ছোটোবেলা থেকে আম্মাকে দেখে দেখে। গত ১৮ বছর যাবৎ আব্বা না ফেরার দেশে… এই পুরো সময়টা মা-ই আমাদের জীবনের কেন্দ্রে আছেন, মাকে ঘিরেই আমাদের অস্তিত্ব।
আমার বিরুদ্ধে নানা অভিযোগ থাকা সত্ত্বেও আমার প্রতি মায়ের ভালোবাসা প্রতি মুহূর্তেই আমি টের পাই। আমাকে বলেন— “এই যে লম্বা লম্বা চুল, তোর গরম লাগে না? ছেলেরা বড়াে চুল রাখে? চুল ছোটাে কর।” কিন্তু অন্য কেউ যদি আমার চুল নিয়ে কথা বলেন, তাহলে আম্মা আমার পক্ষ নিয়ে বলেন— “আরে আমার পোলা তো কবি, কবিরা একটু এমনই হয়।” তবে সমস্যা একটাই, বাড়িতে কেউ আসলেই আম্মার সব কথার শেষ কথা— “তোমরা যে হের বন্ধু হইছ, হেরে বিয়া করাও না ক্যা?” 😉
ছোটােবেলায় আম্মার দিকে অবাক হয়ে তাকিয়ে থাকতাম! আম্মা এত সুন্দর! মানুষের প্রতি, পশু-পাখির প্রতি আম্মার ভালোবাসা আমাকে মুগ্ধ করে এখনো। আমার মনে হয় আমার লেখক-কবি বন্ধুদের প্রতি আম্মার পক্ষপাত একটু বেশি, সেই নব্বই সাল থেকেই সেটা আমি লক্ষ্য করেছি, বাড়িতে কবি বন্ধুদের কেউ এলে আম্মা কি যে খুশি হন! 🙂
এখন আম্মার বয়স ৭২, গত ১ বছরে শরীর অনেক ভেঙে গেছে… এই করোনাকালীন সময়ে ভয়ে ভয়ে থাকি আম্মাকে নিয়ে… এখন মাকে নিরাপদ রাখার জন্য আমি নিজে আম্মার কাছে কম যাই। যেহেতু সুবর্ণগ্রামের সামাজিক কাজে বাইরে যেতে হয় আমাকে প্রায় প্রতিদিনই, তাই একই বাড়ির আলাদা ফ্লোরে দুইজন থাকি, তৃতীয় তলায় আম্মা, দ্বিতীয় তলায় আমি; তারপরও ভয় কাটে না… আম্মা অবশ্য এইসব পাত্তা দিতে চান না, বলেন— “তুই খালি খালি ভাবোছ, ওইসব করোনা-ফরনা কিছুই না”।
আমার মায়ের জন্য আপনাদের শুভকামনা প্রার্থনা করছি— আমার মা যেন থাকেন নিরাপদে।
~
২ জুন ২০২০
খাসনগর দিঘীরপাড় গ্রাম, সোনারগাঁ
কপিরাইট © ২০১৭ - ২০২০ ।। বইদেশ-এ প্রকাশিত কোনও সংবাদ, কলাম, তথ্য, ছবি, কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না
Design & Development by: TeamWork BD