‘দাদা’ সম্পর্কটার প্রতি প্রচণ্ড দুর্বল আমি। দুই ভাই আছে আমার, ছোট কিন্তু বড় কোনো দাদা না থাকায় যাকেই দাদা ডাকার সুযোগ পাই, তাকেই কেমন যেন নিজের, একান্ত নিজেরই মনে হয়। ছোট বেলায় দাদা বলতে জানতাম আমাদের বাড়িওয়ালার ছেলে গোবিন্দ দাদাকে। গোপালগঞ্জের প্রায় অধিকাংশ মানুষ জানত আমি দাদার ছয় বোনের কোনো এক বোন, আবার কেউ কেউ জানত আমি দাদার কাকাত বোন। কখনোই কেউ জানত না আমরা ভাড়াটিয়া আর ওনারা বাড়িওয়ালা। আশে পাশের সবাই কাকাত-জেঠাতো ভাই বোনই মনে করত। দাদার সঙ্গে আমার বোঝাপড়াটা ছিল অনেক অনেক বেশি।
দাদা ছিলেন যেমন রাগি, তেমনি ভালোবাসায় মোড়ানো ছিল অন্তর। দাদাকে যেমন ভয় পেতাম, তেমনি সম্মানও করতাম, শ্রদ্ধাও করতাম। আবার দাদাও আমাদের সঙ্গে কখনো বন্ধু, কখনো আদরের দাদা হয়ে থাকতেন। আবার কখনো শাসক, কখনো স্নেহের আপত্যে আমাদের বেঁধে রাখতেন। স্কুলের গণ্ডি পেরিয়ে যখন কলেজে যাই, তখন দাদার বক্তব্য ছিল, ‘কেউ কোনো ডিস্টার্ব করলে আগে চড় মেরে তারপর আমাকে বলবি, আমি পরে দেখব। আর যদি প্রতি-উত্তর না করে বাসায় এসে নালিশ করিস, তাহলে আমার কাছে মার খাবি।’ কলেজের নিত্যদিনকার কত ঘটনাই না দাদার সাথে শেয়ার করতাম। আবার বাইরে কোথাও যেতে চাইলে বাবা বলতেন, ‘গোবিন্দের কাছে থেকে অনুমতি নাও। ও যেতে দিলে আমার কোনো সমস্যা নেই।’ তাই সিনেমা দেখতে যাওয়া, কালী পূজার মেলায় যাওয়া, সার্কাস দেখতে যাওয়া, বান্ধবিদের বাসায় যাওয়া সব কিছুতেই দাদাকে জানিয়ে যেতাম। দাদা কখনো বাঁধা দিতেন না। শুধু বলতেন নিজেদেরকে সামলে চলতে।
দাদা ছিলেন বেশ মজার মানুষ। আমাদের আশে পাশে কোনো বিয়ে অনুষ্ঠান হলে দাদা আমাদেরকে বরযাত্রিদের মাথায় রং দিতে বলতেন, বাড়িতে কোনো জামাই বা বোনদের দেবররা এলে নিজে রং কিনে আমাদের দিতেন তাকে দেওয়ার জন্য। আমরা ছোটরা মাঝে মাঝেই চাঁদা তুলে পিকনিক করতাম। তবে দাদা ছিলেন আমাদের চিফ গেস্ট, অবশ্য তারও একটা কারণ ছিল! দাদা ছিলেন আমাদের বড় ডোনার। আমাদের সঙ্গে কলাপাতায় বসে কলাপাতাতেই বনভোজনের খাবার খেতেন। কোনো সপ্তাহ বাদ গেলে নিজেই বলে উঠতেন,‘কিরে তোদের কি ডায়াবেটিস হলো, না কি তোরা হার্টের রুগি হয়ে গেলি। আজ একটু পিকনিক করত, অনেকদিন কলাপাতায় খাই না।’ যেমনি বলা তেমনি কাজ। ছুটে যেতাম আমরা দাদার কাছে আমাদের প্রাপ্যটা নেবার জন্য। কোনো অনুষ্ঠানে যেতে না চাইলে নিজে নিয়ে যেতেন আমাদের। পরীক্ষা দিতে যাবার আগে শুধু বলতেন আমার মানটা রাখিস। রেজাল্ট ভালো হলে একদিন সিনেমার টিকিটের টাকা দিয়ে দিতেন। বাবা কোথাও যেতে দিতে রাজি না হলে দাদাকে বলতাম। দাদার এক কথায় বাবা মা ছেড়ে দিতেন।
গোপালগঞ্জের পড়া শেষ হলো। ঢাকায় জগন্নাথে চান্স হলো। মা গোপালগঞ্জের বাইরে পড়তে দিতে রাজি নয়। শুধু দাদার কথার ভরসায় আমি পড়ার সুযোগ পাই। বিয়ের ব্যাপারটাও তেমনি। কয়েক জায়গা থেকেই বিয়ের কথা-বার্তা চলেছে, কিন্তু দাদা যেখানে মত দিয়েছিলেন বাবা আমায় সেখানেই বিয়ে দিয়েছেন। আমার হাজবেন্ডও দাদার বেশ প্রিয় পাত্র ছিলেন।
দাদা চলে গেছেন না ফেরার দেশে। ২০০৩ সালে আমাদের প্রিয় দাদা আমাদের ছেড়ে চলে গেছেন অমৃত নগরের উদ্দেশ্য। জানিনা তিনি এখন কোথায় আছেন, কেমন আছেন! তবে আমার বিশ্বাস ঈশ্বর ওনাকে স্বর্গবাসী করেছেন। দাদাকে হারিয়ে প্রচণ্ড ভাবে মুসরে পরেছিলাম। দাদা চলে যাবার তিন মাস পরে বাবাও চলে গেলেন। স্নেহ, আশীর্বাদ পাবার আরও একটা হাত হারালাম। মানসিকভাবে প্রচণ্ড আঘাত পেলাম। অনেক কষ্ট হলো নিজেকে সামলে নিতে। সেই থেকে অপত্য স্নেহ পাবার আশায় মনটা ব্যাকুল হয়ে থাকে।
দাদা ডাকার লোভে, দাদার স্নেহ পাবার আশায়, দাদার ভালবাসা পাবার হতাশায় মাঝে মাঝে মনটা অতি লোভি হয়ে ওঠে। ইদানিং মনটাকে বেশ শান্ত মনে হয়। মনে হয় দাদা ডাকের যে হতাশা ছিল আমার ভেতরে সে হতাশার কিছুটা যবনিকাপাত হচ্ছে। হয়তো আমি আর একজন সুন্দর মনের অধিকারী, একজন সুন্দর মানুষের সন্ধান পেয়েছি, যিনি আমার দাদার আসনে উপবিষ্ট হয়েছেন। তাকে আমি এখনো চাক্ষুষ দেখিনি, তাতে কি? তার স্নেহের টান এতটাই বেশি যে তিনি অকাতরে সবার মনের মাঝখানে দিব্য আসন গেড়ে বসতে পারেন। তার স্নেহ, ভালবাসা, বন্ধুত্বপূর্ণ আচরণ এতটাই প্রখর যে, চাইলেই সে শ্রদ্ধার আসন এতটুকু টলানো কারো পক্ষে সম্ভব নয়। তিনি যে ‘রবি’র আলোয় আলোকিত একজন মানুষ। সেই আলোর বিচ্ছুরণের কণা মাত্রও যদি আমার জীবনে এসে পড়ে নিজেকে অনেক সৌভাগ্যবতী মনে করব।
আমার এই দাদা হলেন স্বনামধন্য লেখক রয় অঞ্জন। যার হাতধরে আমরা পেয়েছি ‘রবি বাউলের শান্তিনিকেতন’। রবি প্রেমে এতটাই মুগ্ধ তিনি, যার সুরভী আমাদের মাঝে অকাতরে বিলিয়ে চলেছেন। তাই তো তিনি ‘পথিক পরাণ’ এর খোঁজে বেরিয়েছেন। সঠিক সন্ধান তিনি অবশ্যই পাবেন। পথেরও যে আনন্দ থাকে, বেদনা থাকে, পথিকের সাথে সেই আনন্দ, বেদনা যে মিলে মিশে একাকার হয়ে যায় দাদার ‘পথিক পরাণ; তার-ই বহিঃপ্রকাশ। দাদার জন্মদিন। শুভ জন্মদিন দাদা। শুভেচ্ছা ও শুভকামনা রইল। উত্তরোত্তর সাফল্য কামনা করছি।
দাদার লেখা ‘রবি বাউলের শান্তিনিকেতন’ থেকে ধার করে দাদার জন্য এক অনাহুত বোনের আজলা ভরা শ্রদ্ধাঞ্জলি নিবেদন করলাম।
‘আমার প্রাণের মানুষ আছে প্রাণে
তাই হেরি তায় সকল খানে।
আছে সে নয়নতারায়, আলোকধারায়,
তাই না হারায়…
ওগো তাই দেখি তায় যেথায় সেথায়
তাকাই আমি যেদিক পানে।’
দেশের বই পোর্টালে লেখা ও খবর পাঠাবার ঠিকানা : desherboi@gmail.com
কপিরাইট © ২০১৭ - ২০২০ ।। বইদেশ-এ প্রকাশিত কোনও সংবাদ, কলাম, তথ্য, ছবি, কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না
Design & Development by: TeamWork BD