শহরের কিশোরদের কৈশোরক মুহূর্তগুলি হয়ে ওঠে বিশিষ্ট, তাদের চলন বলন কল্পনা হয়ে পড়ে আবেগপ্রবণ; প্রকৃতির দিকে তাকানোর জন্যে তাদের চোখের ভেতরে তৈরি হয় নতুন চোখ, তারা নারকেল পাতার থিরিথিরি কম্পন দেখে কেঁপে ওঠে, চাঁদের নিচে মেঘের দৌড় দেখে তাদের মন চলে যায় কোনাে পাহাড়ের শীর্ষে।
শহরের তরুণীরা হয়ে পড়ে তীব্র রোমান্টিক, তারা চাঁদের আলোয় শাদা সিগ্রেট জ্বালাতে যায়, চড়ুইয়ের বুকের উষ্ণতাটুকু অনুভব করে নিজেদের হৃদয়ে হৃদয়ে, আর পথের ধারে যে বাচ্চাটা শীতের রাতে একা একা ড্রেনের পানিতে পা ভেজাচ্ছে, তাদের জন্যে কাঁদে। তরুণেরা সব যেতে চায় পাহাড়ে, তারা যাপন করতে চায় কাঠুরের জীবন; জ্যোৎস্না রাতে মহুয়ার মদ পান করে যদি যুগল নৃত্য করা যেতো বন্ধনহীন—তারা স্বপ্ন দেখে।
সঙ্গী বাছাইয়ের পুরোনো মূল্যবোধগুলো পাল্টে যায়, ক্রোড়পতির একটা দামী চেকের চেয়ে একগুচ্ছ চন্দ্রমল্লিকার বিনিময়ে কোনো তরুণী হাসিমুখে দিতে পারে তার হৃদয়, একটা চমৎকার চুটকি বলার বিনিময়ে একজন তরুণ লাভ করতে পারে কোনো সৌখিন বনেদি মহিলার নিজ হাতে বুনে দেওয়া কার্ডিগান। আকাশে রংধনু উঠলে শহরের সব যুবক-যুবতীরা ছাদে গিয়ে নাচতে থাকে ময়ূরের মতো।
তবে অন্যরকম চিঠি যে আসতো না, তা-ও না। কিশোরী আর তরুণীরা, যাদের কাছে এই নীলিমা এই মেঘ, এই পাতায় পাতায় আলোর নাচন প্রতিদিন ঝকমকে আয়নার মতো তুলে ধরে নিজেরই উজ্জ্বল মুখ, যারা ভেবে ভেবে ব্যথা পায়—যে বেদনা তার নয় তেমন বেদনাও, যারা আকাশে চিলের বিষণ্ন উড়াল দেখে মরমে মরে যায়, কেঁপে ওঠে, যাদের বুক ভরা অকারণ পুলক, অকারণ বেদনা—যারা এসবের কোনো কিছুর মানে বোঝে না, তাই সব কথার আগে পরে—কী জানি কেন রে আজি—অকারণে বারে বারে—কে জানে কাহার তরে—এই জাতীয় বাক্য ব্যবহার করে; তারা সহজেই প্রেমে পড়ে যায়। …
গল্পওয়ালা জানে—এই ভালোবাসা ব্যক্তি গল্পওয়ালার জন্যে নয়, এই ভালোবাসা হলো ভালোবাসাকে ভালোবাসা।
… তার মনে হয়—এই মেয়েটি পৃথিবীর নয়। হয়তো অন্য কোনো গ্রহ থেকে এসেছে সে, হয়তো স্বর্গের ফুল পারিজাতের বোন—পৃথিবীর মালিন্য একে স্পর্শ করেনি। গল্পওয়ালার একবার মনে হয়—মেয়েটাকে ছুঁয়ে দেখি। তখন মনে হয়, তার মলিন স্পর্শ সুস্মিতার সুস্মিত শুদ্ধতাতে মালিন্যের সূচনা করবে।
… দিন যায়। সবার দিনই যায়। দোয়েলের ফড়িঙের দিন, কেরানি, বেশ্যা ও ভবঘুরের দিন, ভিক্ষুক আর টোকাইয়ের—কার দিনই বা পড়ে থাকে, আটকে থাকে?
… প্রতিটা পিঠা বানানোর আগে তার মনে হয় সে পারবে না, এইবার সে ব্যর্থ হবে, আবার একটা আইডিয়া তাকে উত্তেজিত করে বালকের মতো, তারপর যখন একেকটা গল্প বানানো হয়ে যায়, সে এমন হয়ে যায়, যেন সে খুনের আসামী, আর ভোক্তারা হলো জজসাহেব, তাদের মতের ওপর নির্ভর করছে তার জীবন-মৃত্যু। এতোদিন হয়ে গেলো, নবীনসুলভ এই উত্তেজনা তার কিছুতেই যায় না।
বস্তিটা উঠিয়ে দেওয়া হয়েছে, জায়গাটা ফাঁকা, শুধু রয়ে গেছে মানব বসতির নানান চিহ্ন। প্রাচীরের পাশে কোথাও কোথাও ছিল বস্তিবাসীর চুলা, সেই জায়গাগুলো কালো হয়ে আছে। কারো কারো ছিল নিকোনো উঠোন, রয়ে গেছে। একটা দুটো সবজির গাছ, এখনো মাথা উঁচু করে জানিয়ে দিচ্ছে—এখানে মানুষ ছিল, ছিল মানুষের হাসি-কান্না, তন্দ্রা-জাগরণ—ছিল জন্ম-মৃত্যুর কোলাহল।
… ফুলির কথা মনে পড়ে! কী ভাবছে এই মেয়েটা? কী ধারণা হলো তার—মানুষের সম্পর্কে। ধারণা হলো এই যে, মানুষ হলো এক অকৃতজ্ঞ জীব। মানুষ যখন বিপদে পড়ে, তখন কতো কথাই বলে, আর বিপদ কেটে গেলে? তুমি কে, কী চাও!
… ‘কেনো দুঃখের গল্প নেই? যেসব কেউ সাধ করে কিনবে না?’
‘দুঃখের গল্প! সে সব তো আরো দামি। মানুষ দুঃখের গল্পই তো বেশি দাম দিয়ে কেনে। কেন যে কেনে, সে এক রহস্য’।
… সেই সময়, ঠিক সেই সময়, এই কংক্রিটের জঙ্গলের কোথায় একটা ঘুঘু ডেকে ওঠে—একটানা মন্দ্রস্বরে—ঘু ঘু। নবীন দুপুরে ভরা নির্জনতায় সেই ডাক হৃদয় মন আচ্ছন্ন করে ফেলে। তখন প্রতিটি ভবনের সংক্ষিপ্ত ছায়াও মায়া ছড়ায়।
‘কিন্তু সে থামতে পারে না। রোজ ঘরে ফিরে যখন সে দেখতে পায় তার গল্পের থলে শূন্য, তখন তার ভেতরে কী যে এক উন্মাদনা দেখা দেয়, কী যে এক দুনির্বার নেশা—সে আবার বসে যায় গল্প বানাতে। তখন তার খুব খারাপ লাগে। কান্না পায়। কিন্তু সে কাঁদে না। …’
‘তাকে কান্না চেপে যেতে হয়। অশ্রু সংবরণ করতে হয়। কিন্তু সে কাঁদে। চোখ থেকে এক ফোঁটা জল না ফেলেও সে কাঁদে। সেই অশ্রু-লুকানো রোদনহীন কান্না কাঁদা যে কত কষ্টের’।
… ‘ওই লোকটা যে পথ দিয়ে যায় তার সারা পথে দুঃখ আঁকা হয়ে যায়’।
… গল্পওয়ালার দিনরাতগুলো এখন অশ্রুময়; অবশ্য ফোঁটা ফোঁটা জল নয়, বাস্প, তার সারাটা দিন আর সারাটা রাত ছেয়ে থাকে বাষ্পকণা। তার বুকের মধ্যে যেন একটা পাষাণ বসে ছিল, ওই পাষাণকবাটের অর্গল খুলে গেছে—এখন তা দিয়ে বেরিয়ে আসতে চাইছে সব আবেগ। কিন্তু আবেগের বল্গাহীন প্রকাশের লোক গল্পওয়ালা নয়।
তবু তার একটু এলোমেলো হতে সাধ হয়। মনে হয়—এই সাজানো ছকবদ্ধ, বৃত্তাবদ্ধ জীবন সে ভেঙে ফেলে; রাত আর দিনের এই আবর্তনের বাইরে সে গিয়ে দাঁড়ায়—কোথাও কোনোখানে।
… গল্পওয়ালা হাঁটছে আসলে বাকেরের দোকানের দিকে। ওখানে, দোকানের পেছনের ছোট্ট পরিসরটিতে, কুসুম নামে এক নারী আছে। কুসুমকে মনে হয় সে জন্ম নিয়েছে বন্ধন ছিন্ন করার জন্যে, বৃত্ত ভেঙে দেওয়ার জন্যে। তার বেদেনির মতো কোমর, সাপিনীর মতো ফণা। শক্তপোক্ত সেই শরীরে যেন অমাবস্যার আদুরে স্পর্শ।
… গল্পওয়ালা গিয়ে দাঁড়াবে তার সামনে। তার চোখে চোখ রাখবে। কুসুম আশ্চর্য শীতল চোখে তাকাবে গল্পওয়ালার দিকে। গল্পওয়ালা তার চোখে চোখ রাখবে। সাপুড়ে যেমন সাপের চোখে চোখ রেখে তাকে মন্ত্রমুগ্ধ রাখে।
… ঘন অন্ধকার। শহরের উপকণ্ঠের এক মেঠো গ্রাম, মেঠো শহুরে পথ। রাত কতো হয়েছে কে জানে, ইতিমধ্যেই নেমে এসেছে রাজ্যের নিঃস্তব্ধতা। অবশ্য ঝিঁঝি ডাকছে, অবশ্য বাদুড় উড়ছে, অবশ্য কী একটা জিনিস—পাখি নাকি পতঙ্গ—চামচিকা বুঝি—এমন দ্রুতগতিতে চলাচল করছে মাথার ওপর। … অন্ধকারে গল্পওয়ালা হাঁটে।
… ‘অন্ধকারে, আরো অন্ধকারে, অন্ধকারের একদম পেটের ভেতর, নাকি ওই যে দূরে, নগরের আলো দেখা যাচ্ছে, সেদিকটায়।
গল্পওয়ালা নগরের দিকে হাঁটে। ফিরে যেতে চায় তার সেই বৃত্তাবদ্ধ কোণটিতে। সেই নৈমিত্তিক চক্রে।
কপিরাইট © ২০১৭ - ২০২০ ।। বইদেশ-এ প্রকাশিত কোনও সংবাদ, কলাম, তথ্য, ছবি, কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না
Design & Development by: TeamWork BD