যতদূর জানা যায় ভিনসেন্ট মোট ৯০টি সূর্যমুখী ফুল এঁকেছিলেন ১৮৮৬ সাল থেকে ১৮৮৯ সালের মধ্যে পরপর ৪টি বছরে।
ভিনসেন্ট মানে ভিনসেন্ট ভ্যানগঘ। তাকে নতুন করে পরিচয় করিয়ে দেওয়ার কিছু নেই। তিনি স্বনামেই অধিক পরিচিত। ক্ষণজন্মা এই চিত্রী ৩৭ বছরের জীবনের মাত্র বছর দশেক সময় ছবি আঁকতে পেরেছিলেন। তিনি আঁকতেন কমপ্লিমেন্টারি রং দিয়ে। কমপ্লিমেন্টারি রং হলো সেই রংগুলি যা পরস্পর সংঘর্ষ তৈরি করে, অভিঘাত ও বৈপরীত্য তৈরি করে; একটার সঙ্গে অন্যটা মিলে যায় না। নীল, বেগুনি, হলুদ, কমলা ইত্যাদি রং নিউটনের রংধনুর ক্রমবিরোধী। নিউটনের রংধনুতে কোনটার পর কোন রং আসবে তা বলে দেয়া যায়। কিন্তু কমপ্লিমেন্টারি রঙে তা বলা যায় না। ভিনসেন্ট তাই নিজস্ব এক টেকনিক দাঁড় করালেন। ক্যানভাসে প্রতিটি স্ট্রোকে যে রং চান তা প্রথমে কালার-প্যালেটে মিশিয়ে তৈরি করলেন, তারপর তা ক্যানভাসে পাশাপাশি সরু স্ট্রোক দিয়ে লাগালেন। প্রতিটি ব্রাশস্ট্রোক পাশের স্ট্রোক থেকে স্বতন্ত্র। এইভাবে ছোট ছোট স্ট্রোক মিলে ছোট ছোট ফর্মের সৃষ্টি হলো। এইভাবে বহু স্ট্রোককৃত ফর্ম মিলে বহির্মুখি হয়ে চারদিকে ছড়িয়ে পড়ল নদীর মতো, ভেঙে পড়ল তরঙ্গের মতো। এ যেনো মধ্যযুগের সেই কাঠখোদাইয়ের কৌশল।
ভিনসেন্টের নামেই হুহু করে ওঠে রঙের ঘূর্ণি, যেসব রং সূর্য থেকে বিচ্ছুরিত। ইম্প্রেশনিস্টরা ছবি আঁকতো রঙের স্বাভাবিক স্ট্রোক আর ডট দিয়ে। কিন্তু ভিনসেন্টের স্ট্রোক হয়ে উঠলো আঁকা-বাঁকা দীর্ঘ সুতোর মতো রঙের রেখা যেন। তার ছবি যেন সূর্যের আলোয় ভরা। তার কালারপ্যালেট থেকেই যেন চিরদিন উদ্গত হয় সূর্য আর সূর্যমুখীর ফুলগুলি, এমন আমার মনে হয়। তার রং কখনোই বিষয়ের আধিক্যে ভারাক্রান্ত হয়ে যায় না, তাতে যে বিস্তারিত আবেগের ছন্দময়তা তা চিত্র-নন্দনগত।
সূর্যমুখী সিরিজের ছবিগুলি নিয়ে আর্টের জগতে প্রথম সাড়া পড়ে যায় ১৯৮৭ সালের ৩১ মার্চ। লন্ডনে ক্রিস্টির নিলামে ভিনসেন্টের তেলরঙে ক্যানভাসে ফুলদানিতে ১৫টি সূর্যমুখী ফুলের ছবিটি প্রায় ৪ কোটি ডলারে কিনে নেন জাপানের একটা বিমা কোম্পানির মালিক ইয়াসুও গোতো। ওই সময়ে এটি ছিলো বিশ্বরেকর্ড।
প্রথম সূর্যমুখী ফুল আঁকার পর আলাদা ২টি সিরিজে সূর্যমুখী ফুল নিয়ে কাজ করেছেন ভিনসেন্ট। প্রথম সিরিজের ছবিগুলিতে ফুলগুলিকে দেখা যায় পড়ে আছে মেঝেতে। কিন্তু এক বছর পরে আর্ল শহরে আঁকা সিরিজে ফুলগুলিকে দেখা যায় ফুলদানিতে যে রৌদ্রকরোজ্জ্বল রূপ নিয়ে ফুটে আছে দেদীপ্যমাণ। দুটো সিরিজের সঙ্গেই গভীরভাবে জড়িয়ে আছে পল গগ্যাঁর নাম। আর্ল শহরের হলুদ বাড়িতে তাঁর সঙ্গে থাকতে আসা বন্ধু গগ্যাঁকে মুগ্ধ করতে চেয়েছিলেন তিনি সূর্যমুখীর ছবি দিয়ে।
১৮৮৬ সাল। প্রথম সূর্যমুখী ফুল আঁকেন ভিনসেন্ট। একটা সোনালি গামলার মতো পাত্রে সাজানো গোলাপ ও অন্যান্য ফুলের সঙ্গে। ওই ছবিতে সূর্যমুখী ছিলো ৪টি। উক্ত বছরের আগস্ট থেকে সেপ্টেম্বর মাসে তেল রঙের ক্যানভাসে এই ছবি এঁকেছিলেন তিনি। তখন থাকেন ভাই থিওর সঙ্গে প্যারিস শহরে।
১৮৮৭ সাল। এই বছর আগস্ট থেকে অক্টোবরের মধ্যে স্টাডি হিশেবে ভিনসেন্ট তাঁর প্রথম সূর্যমুখী সিরিজের ৪টি ছবি আঁকেন। ৪টি ছবিতে মোট সূর্যমুখীর সংখ্যা ১০ টি। ক্ষেত থেকে কেটে এনে মাটিতে শুইয়ে আঁকা কাটা সূর্যমুখী।
এই বছরের নভেম্বর-ডিসেম্বরে প্যারিসের রেস্তোরাঁ দ্যু শালের একটা চিত্র প্রদর্শনীতে খুব সম্ভবত প্রথম দেখা হলো গগ্যাঁ আর ভিনসেন্টের। গগ্যাঁর চেয়ে বছর পাঁচেকের ছোট ভিনসেন্ট। সেই বছরই ভিনসেন্ট প্যারিসে বসবাসরত ছোটভাই থিওর কাছে ফিরেছেন। আর গগ্যাঁ এসেছেন মার্তিনিক দ্বীপ থেকে।
প্রর্দশনীতে দেখা হওয়ার পর নিজেদের আঁকা ছবি বিনিময় করলেন পরস্পর। ভিনসেন্ট ১টি সূর্যমুখী ফুলের ছবি দিলেন গগ্যাঁকে, ছবিটার ইংরিজি নাম ‘ফোর সান ফ্লাওয়ার্স গন টু দ্য সিড’। তেল রঙে ক্যানভাসে আঁকা এই ছবিতে ৪টা কাটা সূর্যমুখী মাটিতে পড়ে আছে, তার মধ্যে একটা উল্টানো। আর গগ্যাঁ ভিনসেন্টকে দিলেন মার্তিনিকে আঁকা নদীতীরে এক নারীর সঙ্গে একটি বালক ও একটি গরুর কম্পোজিশনে একটা ছবি। ছবিটার ইংরিজি নাম ‘অন দ্য শোর অব দ্য লেক, মার্তিনিক’।
১৮৮৮ সাল। গগ্যাঁ প্যারিস ছেড়ে চলে গেলেন উত্তর-পশ্চিম ফ্রান্সের ব্রিটানির দিকে। আর ফেব্রুয়ারি মাসে ছবি আঁকার জন্য দক্ষিণ ফ্রান্সের আর্ল শহরে চলে এলেন ভিনসেন্ট, ২, প্লেস-লেমারটিনে ১ মে একটা বাড়ির নিচতলার কয়েকটা ঘর ভাড়া নিলেন। তারপর বাড়িটিকে হলুদ রং করে বানিয়ে নিলেন হলুদবাড়ি। দরজা আর জানালার রং করলেন সবুজ। আর ঠিক করলেন, ওই হলুদবাড়িই হবে তার দক্ষিণের স্টুডিও। আর পল গগ্যাঁ হবেন সেই স্টুডিওর প্রধান। জুন মাসে, গগ্যাঁর ৪০তম জন্মদিনের আগে আগে, ৫০ ফ্রাঁ-সহ একটা নিমন্ত্রণপত্র পাঠিয়ে দিলেন ভিনসেন্ট তার ঠিকানায়। গগ্যাঁর পকেট বলতে গেলে একবারেই খালি তখন। প্রথমে দ্বিধায় পড়ে গেলেন তিনি। কিন্তু পরে মানে বেশি কিছুদিন পরে নিমন্ত্রণে সাড়া দিলেন। এলেন। আর হলুদ বাড়িতে ভিনসেন্টের সঙ্গে কাটালেন জীবনের ৬৩টি দিন, আনন্দ-বেদনা আর ঝগড়া-আপোসে। এর মধ্যে হলুদবাড়িটাকে সাজাতে ক্লান্তিহীন একের পর এক ক্যানভাস ভরিয়ে তুললেন ভিনসেন্ট। তারমধ্যে সূর্যমুখী সিরিজের ছবি অন্যতম। পরে ভিনসেন্ট ভাই থিওকে আর্ল সম্পর্কে একটা চিঠিতে লিখেছিলেন, ‘আশ্চর্য সহজ, সরল এক সময় গেছে আমার। চারপাশে প্রকৃতি তখন এত অপরূপ ছিলো যে নিজেকে হারিয়ে ফেলেছিলাম যেন আমি। স্বপ্নের মতো এক একটা ছবি ধরা দিয়েছে আমার কাছে।’
১৮৮৮ সাল। আগস্ট মাসে দ্বিতীয় সিরিজের প্রথম পর্বের সূর্যমুখী ফুলের ছবি আঁকার কাজে মনোনিবেশ করেন ভিনসেন্ট। এইবার আর মেঝেতে শোয়ানো সূর্যমুখী নয়, ফুলদানিকে সূর্যমুখী। হলুদ-বাড়িতে গগ্যাঁর শোবার ঘরের দেয়ালে ঝুলিয়ে দেন এই সিরিজের একটা ছবি। ফুটে ওঠা থেকে শুরু করে শুকিয়ে ঝরে পড়ার আগ পর্যন্ত সূর্যমুখী ফুলের জীবনের প্রতিটি পর্যায় যেন ছোট ও মাঝারি আলাদা ক্যানভাসে তেলরঙে ধরে রাখার চেষ্টা করেন ভিনসেন্ট। আর ক্যানভাসে সূর্য থেকে নেয়া হলুদ রং যেন হয়ে ওঠে অসামান্য মহিমায় বিশিষ্ট। ভাই থিওর কাছে এক চিঠিতে ভিনসেন্ট লিখছেন, ‘এই ছবি হলো এমনই যার চরিত্র বদলে যায় বারংবার। যতই দেখতে থাকো তুমি, ততই আরো রূপময় হয়ে তা ধরা দেয় তোমার চোখে। তাছাড়া তুমি তো জানোই, ছবিগুলি ভীষণ পছন্দ করেছে গঁগ্যা। কথার মাঝে একদিন সে আমাকে বললো, ‘এই যে… এটা… এর নামই তো ফুল।’
এই সিরিজের দ্বিতীয় ছবিটা দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় জাপানের আশিয়ানায় আগুনে পুড়ে ছাই হয়ে যায়। তেলরঙে ক্যানভাসে আঁকা এই ছবিতে সূর্যমুখী ফুল ছিলো ৫টি। ৩টি ফুলদানিতে, আর ২টি ফুলদানির পাশে শোয়ানো।
আর্লের হলুদ-বাড়িতে আঁকা এইসব সূর্যমুখী বিষয়ে ভিনসেন্ট একবার বলেছিলেন, ‘গগ্যাঁ আর আমি একসঙ্গে যখন নিজেদের স্টুডিওতে থাকতে যাচ্ছি তখন স্টুডিওটাকে আমি সাজাতে চাই নতুন করে। আর কিছু নয়, শুধু বড় বড় ফুল দিয়ে।…’
সহজে কারো সঙ্গে তাঁর সখ্য হয় না। কেবল যে চিরদিনের বাসনা এই যে তার সমমনা কোনো চিত্রীকে সঙ্গে নিয়ে একটা স্টুডিও গড়বেন, সেইখানে একসঙ্গে ছবি আঁকবেন। সেই ভেবে গগ্যাঁকেই তার সমমনা মনে হলো।
এই বছর ডিসেম্বরে পল গগ্যাঁ আঁকেন ভিনসেন্টের সূর্যমুখী ফুল আঁকারত ছবি। তেল রঙে আঁকা এই ছবি ইংরেজি নাম ‘দ্য পেইন্টার অব সানফ্লাওয়ার্স।’ এই ছবি দেখে ভিনসেন্ট তেমন খুশি হতে পারেন নাই, তিনি ভেবেছিলেন গগ্যাঁ ইচ্ছে করেই তাকে পাগলের মতো করে এঁকেছেন। কেমন ক্লান্ত আর ক্লিশে।
১৮৮৯ সাল। এই বছরের জানুয়ারি মাসে দ্বিতীয় সিরিজের দ্বিতীয় পর্বের আরো ৩টি ছবি ছবি আঁকেন ভিনসেন্ট। এইগুলিকে অবশ্য এই সিরিজের প্রথম দিকের ২টি ছবির রিপিটেশন বলা যায়। এই বছরই তিনি উপলব্ধি করেন আত্মপ্রতিকৃতির বাইরে সূর্যমুখী ফুলের ছবিগুলির মধ্যেই সবচেয়ে বেশি প্রকট হয়েছেন তিনি, যেন বা এইসব ফুলই তার আত্মার রূপ।
কপিরাইট © ২০১৭ - ২০২০ ।। বইদেশ-এ প্রকাশিত কোনও সংবাদ, কলাম, তথ্য, ছবি, কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না
Design & Development by: TeamWork BD