আবহমান বাংলা কবিতায় এক রসের জুয়াড়ি

শনিবার, ১৬ জানুয়ারি ২০২১ | ৮:৩৬ অপরাহ্ণ | 472 বার

আবহমান বাংলা কবিতায় এক রসের জুয়াড়ি

“অলোকদা তো জার্মানিতে, শঙ্খদাকেও পাওয়া কঠিন:
এই ছবিতেই রইল ধরা কৃত্তিবাসের পুরনো দিন!”

এক সারস্বত অনুষ্ঠান থেকে ফিরে উপর্যুক্ত দুই পঙ্‌ক্তি তথ্যে একটি সচিত্র স্ট্যাটাস দিয়েছিলেন গত শতাব্দীর পাঁচের দশকে আবির্ভূত কবিদের কণ্ঠস্বর ‘কৃত্তিবাস’-এর সম্পাদকমণ্ডলীর এক সদস্য— কবি প্রণবকুমার মুখোপাধ্যায়। অনুষ্ঠানটিতে চর্যার কবিদের দুই উত্তরসাধক অলোকরঞ্জন দাশগুপ্ত ও শঙ্খ ঘোষের সঙ্গে মঞ্চী ছিলেন তিনিও। এর কয়েকদিন আগে তাকে উৎসর্গকৃত কবি শরৎকুমার মুখোপাধ্যায়ের ‘কবিতাসমগ্র’র প্রকাশনা অনুষ্ঠান থেকে ফিরেও এমন একটি ‘স্ট্যাটাস’ দিয়েছিলেন তিনি।

শরৎকুমারও ‘কৃত্তিবাস’-এর একাধিক সম্পাদকের একজন ছিলেন। আড়াল-সম্পাদক সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় জীবিকাসূত্রে বড়োকাগজে কাজ করতেন বলে কবিতাপত্রটিতে তার নাম ছাপাতেন না। সুনীলদা-শরৎদার সঙ্গে পরিচয়-ঘনিষ্ঠতা থাকলেও প্রণবকুমার মুখোপাধ্যায়কে তখনও সামনাসামনি দেখিনি। চিঠি বা অন্য কোনও মাধ্যমেও যোগাযোগ ছিল না। সামাজিকমাধ্যম ফেসবুক এ অভাব পূরণ করে। ফেসবুক সুবাদে জানতে পাই, কোলকাতা পুস্তকমেলার বাংলাদেশ প্যাভিলিয়নস্থ প্রকাশনী ভাষাচিত্র’র স্টল থেকে তিনি আমার ‘শ্রেষ্ঠ কবিতা’ সংগ্রহ করেছেন। ফেসবুকে বন্ধুত্ব হওয়ার পর নিয়মিত ভাববিনিময় হতো প্রণবদার সঙ্গে। অনুজ কবিদের প্রতি ছন্দপ্রাণ এই কবির হার্দিক ব্যবহারে পুনঃপুন মুগ্ধ হয়েছি। জন্মদিন, বিয়েবার্ষিকী, এমনকি ফেসবুকীয় পরিচয়ের দিনও ছন্দবন্ধে প্রিয়জনকে শুভেচ্ছা জানাতেন তিনি। এমন একাধিক অভিজ্ঞতার সাক্ষী আমি নিজেও। একটি নমুনা—

“মিথ্যে কাঁটাতার, মিথ্যে সীমারেখা,
সত্যি কবিতার মায়াবী বন্ধন—
এ পারে আমি, শাহরিয়ার ওপারের,
সত্যি সখ্যের হৃদয়স্পন্দন!”

মন্দাক্রান্তা ছন্দবাহিত চার পঙ্‌ক্তির নিচে লেখা ছিল— ‘এই বন্ধুত্ব দীর্ঘজীবী হোক’।

যুগপৎ ঋজু ও বিনয়ী এই অগ্রজ কবির সঙ্গে আমার প্রথম ও শেষ দেখা ‘ডলির টি-স্টল’-এ। সাল— ২০১৮। আমার সঙ্গে দুই ভাষাচিত্রী আতাউল করিম ও মনিরা কায়েস ছিলেন (খুঁজে পেলাম না বলে সংযুক্ত কোলাজ ছবিতে Ataul Karim নেই)।
কোলকাতায় বহুবার গেলেও এবং কফিহাউস, বসন্ত কেবিনসহ একাধিক সারস্বত আড্ডাস্থল চিনলেও, মধুসূদন মঞ্চের পড়শি দক্ষিণাপন শপিংমলের শাড়িগন্ধা ‘ডলির টিস্টল’ আমার অপরিচিত ছিল। একান্ত কথোপকথনের চমৎকার জায়গা। সেদিনের অগ্রজ-অনুজ আড্ডায় জেনেছিলাম, প্রণবদার নিকটাত্মীয় হন কবি নীরেন্দ্রনাথ চক্রবর্তী। কবিতাজীবনের প্রথম প্রেরণাও। একজন অগ্রজ কবির মুখে তার কবিতাজীবনের সূচনাকথা আর ‘কৃত্তিবাসের পুরনো দিন’-এর গল্প শুনে ঋদ্ধ হয়েছিলাম। বয়স আশির ওপরে হলেও, স্মৃতিচারণকালে চিন্তার তারুণ্যে ঝলমল করছিল তার মুখ। আলাাপচারিতায় বুঝেছি, আমার মতো তিনিও অনুজ কবিদের সঙ্গলিপ্সু। এ-ও বুঝেছি, তিনিও অপছন্দ করেন অকালবৃদ্ধ তরুণদের শূন্যগর্ভা ঢক্কানিনাদ। আড্ডাচলাকালে কবি প্রণবকুমার মুখোপাধ্যায় অল্প কিছুদিন আগে প্রকাশিত নিজের ‘কবিতা সমগ্র’ বইটি উপহার দিয়েছিলেন আমাকে।


এরপর আড়াই বছর গড়িয়ে গেলেও আর কোলকাতা যাওয়া হয়নি। ইতোমধ্যে শুরুতে উদ্ধারকৃত পঙ্‌ক্তিযুগল থেকে ‘অলোকদা তো জার্মানিতে’ তথ্যের সত্যতা মুছে গেছে। নীরেন্দ্রনাথ চক্রবর্তীও নেই। যাকে নিয়ে এই স্মৃতিগদ্য, জঙ্গি করোনার বৈশ্বিক সন্ত্রাসের শুরুতে যথাকালে যথাচিকিৎসা না-নেওয়ায় কিডনিজনিত ব্যাধিতে লোকান্তরিত হয়েছেন তিনিও। একইসঙ্গে ‘ডলির টিস্টল’ থেকে ফেরার সময় বলা আমার ‘এরপর কোলকাতায় এলে প্রথম আপনার সঙ্গে দেখা করব, প্রণবদা’ ইচ্ছেটিরও মৃত্যু ঘটেছে।

বারোয়ারি ফেসবুকে যে-গুটিকয় বন্ধুর বৈদগ্ধ্য আমাকে মুগ্ধ করে, প্রণবকুমার মুখোপাধ্যায় ছিলেন তাদের প্রথম সারিতে। খুব ব্যথিত হয়েছিলাম তার প্রয়াণসংবাদে। তাকে মনে পড়লে তার বই পুনর্পাঠে নিই। আজও নিয়েছিলাম। আজকের পাঠে ‘বাজি’ শিরোনামের একটি কবিতায় প্রাণপণ প্রত্যয়ী এক কবিকে বর্ষার পদ্মার মতো বয়ে যেতে দেখেছি। একুশ শতাব্দীর প্রথম কী দ্বিতীয় বর্ষে কবি ও সংগঠক Rashed Rouf-এর ‘শৈলী’ থেকে প্রকাশিত আমার ‘সে থাকে বিস্তর মনে বিশদ পরানে’ বইয়ের ‘রসের জুয়াড়ি আমি; কবিতায় বাজি ধরে আছি’ শিরোনামের কবিতাটির সঙ্গে প্রণবকুমার মুখোপাধ্যায়ের ‘বাজি’ কবিতার বোধসঞ্জাত আত্মীয়তা আছে। প্রেমে ও সামাজিকতায় একজীবনের সবটাই বাজি ধরতে না-পারলে কবির চূড়ান্ত সিদ্ধি নেই। শিল্পকাব্যে সিদ্ধিলাভের মন্ত্র ওই বাজি। এই স্মৃতিগদ্য যার পঙ্‌ক্তি দিয়ে শুরু, তার মন্ত্রপাঠেই ইতি ইতি টানা যাক-

” ‘যাই’— বলে চলে গেছ, একবারও
তাকাওনি পিছনে
শুরু থেকে প্রতিটি খেলায়
নিতান্ত সহজ ছলে বারবার গেছ তুমি জিতে ।
সর্বস্ব নিয়েছ যার, হেলায় নাওনি শুধু যাকে
সে কিন্তু ছাড়েনি জেদ, কোনোক্রমে শেষ খুঁটিটাকে
টাল খেতে খেতে ধরে ফেলেছে । এবং মনে-মনে
নিজেকেই পণ রেখে সর্বস্বান্ত চূড়ান্ত বাজিতে
দাঁড়িয়ে রয়েছে একঠায়।”

[বাজি/প্রণবকুমার মুখোপাধ্যায়]

 

Facebook Comments Box

কপিরাইট © ২০১৭ - ২০২০ ।। বইদেশ-এ প্রকাশিত কোনও সংবাদ, কলাম, তথ্য, ছবি, কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না

Design & Development by: TeamWork BD