” জীবনে আমার যত আনন্দ পেয়েছি দিবস-রাত
সবার মাঝারে আজিকে তোমারে স্মরিব জীবননাথ। “
বইঃ রবি বাউলের শান্তি নিকেতন
লেখকঃ রয় অঞ্জন
প্রকাশনী : ভাষাচিত্র
প্রচ্ছদধ : বিপুল শাহ
মূদ্রিত মূল্য : ১৬০ টাকা মাত্র
লেখক রয় অঞ্জন ভীষণ ভ্রমনপ্রিয় মানুষ। চক্কর দিতে দিতে তিনি পৌঁছে গিয়েছিলেন খোয়াই নদীর তীরে, রাঙা ধুলার পাশের সেই কাঙ্ক্ষিত জায়গা!!
শান্তিনিকেতন
একবার নয়, বারবার গিয়েছিলেন। কি অদম্য টান! ঠিক নেশার মত, একবার যে পান করেছে সেই রূপসুধা, তাকে বারবার যেতেই হবে। লেখকের সেই কয়েকবারের ভ্রমনের অনুভূতি উঠে এসেছে বইটিতে।
★তুমি ডাক দিয়েছ কোন সকালে…
এটি মূলত প্রথম পরিচ্ছদ। লেখক ট্রেনে চেপে বোলপুরে পৌঁছালে হোটেল সমস্যায় পড়েন। রিকশাচেপে হোটেল খোঁজার কালে শোনেন চালকের মনোকষ্টের কথা, হোটেল মালিকপুত্রের আন্তরিকতায় মুগ্ধ হোন তিনি।
শান্তিনিকেতনে তখন পৌষমেলা,মেলা ভ্রমনের অনুভূতি এবং মেলার বর্ণনার পাশাপাশি প্রাজ্ঞজনের স্মৃতিকথা আছে এখানে। দু একটা টাইপিং মিস্টেকও পেয়েছি এখানে। যেমনঃ সাধরণ, অবদি, ব্রাম্ম ইত্যাদি। পুরো বইটিতে ব্রাহ্ম বানানটিকে ব্রাম্ম লেখা হয়েছে। বানানটি কি আমিই ভুল জানি?
★শান্তি নিকেতন শান্তিনিকেতন…
এই পরিচ্ছদে লেখক সীতানাথ মন্দিরের সম্ভাব্য স্থাপন কারণ আলোচনা করেছেন। অমর্ত্য সেন এবং রবিবাবুর বাড়ি যে এক প্রাচীরের দূরত্ব এখানেই জানা যাবে।
★সকল হৃদয়তন্ত্রে যেন মঙ্গল বাজে…
এটি প্রথম ভ্রমনের সময় নাকি পরবর্তী ভ্রমনের সময়ে লেখা সে বিষয়ে আমার কিছু ধোঁয়াশা রয়ে গেছে। তবে চমকপ্রদ বিষয় লেখক মানসিকভাবে বিপর্যস্ত অবস্থায় শান্তিনিকেতনে গিয়েছিলেন তখন। কিছুটা প্রশান্তির খোঁজে নিরলস হেঁটেছেন সেদিন। প্রচণ্ড তৃষ্ণা নিয়ে পথপাশের এক গেরস্ত বাড়িতে প্রবেশ করেন তিনি। সেখানেই গ্রহণ
করেন মধ্যাহ্নভোজন। শান্তি নিকেতনের লাল মাটির স্পর্ম পাওয়া মানুষগুলোর সারল্য তুলে ধরেছেন এখানে।
এরপর থেকে মূলত শান্তিনিকেতনের বর্ণনা।
উপাসনাগৃহ বা ব্রাহ্ম মন্দির (এখানে ব্রাহ্ম বানান ঠিক আছে): ১২৯৭ সালের ২২শে অগ্রহায়ণ মন্দিরের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করা হয়, ১৮৯২ সালে উদ্ধোধন করা হয়। বুধবার ব্রাহ্ম ধর্মের প্রতিষ্ঠা দিবস হিসেবে ৬.৩০-৭.৩০ উপাসনা করা হয় বিগ্রহবিহীন মন্দিরটিতে।
তালধ্বজ
শান্তিনিকেতন বাড়ি
ছাতিমতলা
তিনপাহাড়
দেহলী বাড়ি
নতুনবাড়ি
আম্রকুঞ্জ : এখানেই নোবেল কমিটি রবিবাবুকে নোবেল প্রদান করে। নেহেরু, মহাত্মা গান্ধী, ইন্দিরা গান্ধী, নেলসন ম্যাণ্ডেলা, মান্না দে, শেখ হাসিনা সবাই এই বেদীতে সংবর্ধিত হয়েছেন। একই বেদীতে মাদার তেরেসা কে নোবেল প্রদান করে নোবেল কমিটি।
বকুলবিথী
শালবিথী
ঘন্টাতলা
সিংহ সদন
পূর্ব তোরণ ও পশ্চিম তোরণ
পাঠভবন দপ্তর
প্রাক কুটির, শমীন্দ্র শিশু পাঠাগার
দ্বিজবিরাম
হিন্দীভবন
চীনা ভবন
মুকুট ঘর
সন্তোষালয়
বেণুকুঞ্জ
দিনান্তিকা
চৈতী বা চৈত্য
কলাভবন বা নবনন্দন
সঙ্গীত ভবন
কালোবাড়ি
নাট্যভবন
বাংলাদেশ ভবন
সবগুলো ভবনের খুব সংক্ষিপ্ত বর্ণনা আছে।
এখানে একটু মন্দলাগা, লেখক যা বর্ণনা করেছেন তার কিছুটা গুগল করেও পাওয়া যেতে পারে। তিনি আর একটু চমকপ্রদ করে আলোচনা করতে পারতেন। আমার কাছে কেন যেন হৃদয়ছোঁয়া বর্ণনা মনে হয় নি।
সবচেয়ে বেশী মিস করেছি আলোকচিত্র বা ছবি। কয়েকটা ছবি সংযুক্ত করলে এ অংশটা আরো আনন্দ দিতে পারতো।
★অতঃপর ঠাকুর বাড়ি
পরের কোন এক অভিযানে লেখক ঠাকুরবাড়ি দর্শনে গিয়েছিলেন। ঠাকুরবাড়ির আভিজাত্য আর প্রাচুর্যের ছাপ লেখকের বর্ণনায় উঠে এসেছে।
★মরণ রে, তুঁহু মম শ্যামসমান…
রবিবাবু জীবদ্দাশয় স্বজন হারানোর যে তীব্র বেদনা সয়েছেন তার বর্ণনা করা হয়েছে এখানে। বইয়ের নাম বা বিষয়বস্তুর সাথে না মিললেও তথ্য, উপাত্ত ও কবিতার সম্মিলনে এ অংশটুকু ভীষণ চমকপ্রদ।
★মৃত্যুঞ্জয়ী প্রাণ…
“যত বড়ো হও
তুমি তো মৃত্যুর চেয়ে বড়ো নও।
আমি মৃত্যুর চেয়ে বড়ো এই শেষ কথা বলে
যাব আমি চলে।”
রবিবাবু নিজেকে মৃত্যুর চেয়ে বড়ো প্রমাণ করতে পেরেছিলেন। তার মহাপ্রয়াণ, অসুস্থতা, অস্ত্রোপচার এবং ২নম্বর ফটক দিয়ে চিরতরে বেড়িয়ে যাওয়া।
★ওরে গৃহবাসী খোল দ্বার খোল লাগল যে দোল…
এ অংশে লেখক দোল উৎসবে শান্তিনিকতে ভ্রমনের সৌন্দর্য তুলে ধরেছেন। মাথায় লাল সবুজের পতাকা বেঁধে উৎসবে ভ্রমণ কালে সেখানে যে আন্তরিকতা পেয়েছেন তাতে লেখকের বর্ণনায় পাঠকও আপ্লুত হবে।
★আমাদের রবি বাউল…
“ও আমার মন যখন জাগলি না রে
তোর মনের মানুষ এলো দ্বারে।
তার চলে যাবার শব্দ শুনে
ভাঙল রে ঘুম…”
এ অংশে উঠে এসেছে রবিঠাকুর বাউল সঙ্গীত দ্বারা কতটা প্রভাবিত ছিলেন তার আলোচনা। রবিঠাকুরের সৃষ্টিকর্মে বাউল সংস্পর্শের প্রমাণ পাওয়া গেছে বারবার। হাছনরাজা, লালন সাইঁজ, গগন হরকরা রবিবাবুর লেখার খোরাক জুগিয়েছেন। বঙ্গভঙ্গের সময় রবিবাবু যে গানগুলো রচনা করেছেন সেগুলো এ পর্যায়ে আলোচিত হয়েছে। শুধু পরিচ্ছেদ না বইটিরও শেষ করেছেন জাতীয় সংগীত দিয়ে।
এটি লেখকের পটুতার প্রমাণ দেয়।
তবে প্রয়াণের পর অন্যকোন আলোচনাতেই আমি মন বসাতে পারছিলাম না। হৃদয় বেদনার্ত হয়েছিলো, আকর্ষণ ছুটে গিয়েছিলো। তাই অন্যসবকিছু আলোচনা শেষ করে লেখক যদি সমাপ্তিতে প্রয়াণ আলোচনা করতেন তবে বোধহয় বেশী ভালো,হতো।
বইটি আরো একটু গোছালো হতে পারতো।
পাঠকের দায়বদ্ধতা থেকে এতসব অভিযোগ করতে পারছি। আর একটু অভিযোগ জমা না করলেই নয়, লেখক কি বইটা প্রকাশে তাড়াহুড়ো করে ফেলেছেন? আর একটু সময় নিয়ে, আরো সম্পাদনা করে, ছবি সংযোজন করে এই তথ্যগুলোরই সম্মিলনে বইটিকে আরো হৃদয়গ্রাহী করা যেতো কী?
আমি ছোটবেলা থেকেই রবিবাবুর পাড় ভক্ত। জীবযাপনের অনেক পর্যায়েই নির্মল আনন্দ ও ক্লান্তি দূর করতে আমি রবিবাবুর দারস্থ হই। এই বইটি রবিবাবুকে চেনাতে ও জানাতে আগ্রহ সৃষ্টি করবে, শান্তি নিকেতনের প্রতি প্রীতি সৃষ্টি করবে।
বইটির প্রচ্ছদ চমৎকার, দুই ছায়ার উপস্থিতি ভ্রমনের প্রতি, শান্তিনিকেতন দর্শনের প্রতি লোভ বাড়িয়ে দেয়। পেছনের রবিবাবুর আবক্ষমূর্তি বইটির সাথে, শান্তিনিকেতনের সাথে রবিবাবুর সম্পৃক্ততার প্রমাণ দেয়।লেখকের প্রথম সন্তান রবিবাউলের শান্তি নিকেতন ফি বছর মূদ্রণের মুখে পড়ে ছোট ছোট ভুলগুলো সংশোধিত হয়ে ফুল হয়ে পাঠকমনে সুরভী দান করুক, বাংলাসাহিত্যের সুসন্তান হয়ে বেঁচে থাকুক অনেকদিন।
[ বই-পুস্তক-প্রকাশনা এবং বাংলাদেশের প্রকাশনা জগতের যে কোনো সংবাদ প্রকাশের জন্য সংশ্লিষ্ট ছবিসহ আমাদের ই-মেইল করতে পারেন : desherboi@gmail.com ]
কপিরাইট © ২০১৭ - ২০২০ ।। বইদেশ-এ প্রকাশিত কোনও সংবাদ, কলাম, তথ্য, ছবি, কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না
Design & Development by: TeamWork BD