করোনার তাণ্ডবে প্রায় দুই বছর বন্ধ দেশের সৃজনশীল বই প্রকাশনা জগত। করোনায় ক্ষতিগ্রস্ত হননি এমন প্রকাশক বিরল। গেল বছরের বেশি সময় তারা তালাবদ্ধ ঘরের ভাড়া গুনেছেন। ফলে পুঁজি সংকটে ভুগছেন প্রায় সবাই। এরইমধ্যে এ বছর করোনা পরিস্থিতি কিছুটা স্বাভাবিক হয়ে আসাতে আশায় বুক বেঁধেছিলেন তারা।
গতবছর মার্চে বইমেলা শুরু হলেও মাঝপথে স্থগিত করতে হয়েছে করোনা সংক্রমণ বেড়ে যাওয়ায়। এ বছর মেলার আয়োজক প্রতিষ্ঠান বাংলা একাডেমি পুস্তক প্রকাশকদের দুই নেতৃস্থানীয় সংগঠনের নেতৃবৃন্দের সাথে পরামর্শ করেই সিদ্ধান্ত নিয়েছে মেলা আয়োজনের। সে মতে, বাংলা একাডেমি চত্বর ও সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে পুরো উদ্যমে চলছে মেলার প্রস্তুতি পর্ব।
কিন্তু এরইমধ্যে আবার বাধ সাধছে করোনার নতুন ভ্যারিয়েন্ট ওমিক্রন। ইতোমধ্যে করোনার নতুন এ ধরনে আক্রান্ত হয়েছেন পার্শ্ববর্তী দেশ ভারতের বিপুল সংখ্যক মানুষ। আমাদের দেশেও এর বিস্তার লক্ষ্য করা যাচ্ছে। প্রাপ্ত খবর অনুযায়ী, করোনার সংক্রমণ ঠেকাতে ইতোমধ্যে কলকাতা আন্তর্জাতিক বইমেলা স্থগিতের পরিকল্পনা চলছে। কলকাতার পার্শ্ববর্তী নিউটাউন বইমেলা স্থগিত করা হয়েছে। এছাড়াও বাতিল হয়েছে আলি দুয়ার, মালদা বইমেলাও। এরকম একটা পরিস্থিতিতে মেলা হওয়া না হওয়া, বই ছাপা না ছাপার একটা দোলাচলে পড়েছেন বাংলাদেশের প্রকাশকরা।
বাংলাদেশ জ্ঞান ও সৃজনশীল প্রকাশক সমিতির সাবেক সভাপতি ওসমান গনি বলেন, এখন যে পরিস্থিতি, তাতে মনে হয় আমাদের নতুন করে ভাবতে হবে। গত বছর এক প্রকার জোর করেই মেলার আয়োজন করা হয়েছিল। কিন্তু মাঝপথে মেলা স্থগিত হয়ে যাওয়ায় সবাই ব্যাপক ক্ষতির মুখে পড়েছেন।
আগামী প্রকাশনীর প্রকাশক ও মেলা আয়োজক কমিটির সদস্য ওসমান গনি আরও বলেন, এখন প্রকাশকদের নিজেদের মধ্যেই আগে আলোচনা হওয়া দরকার। এরপর বাংলা একাডেমিসহ সবাই মিলে একটা যুগোপযোগী সিদ্ধান্ত নিতে হবে।
এদিকে বইমেলার আয়োজক প্রতিষ্ঠান বাংলা একাডেমির সদস্য সচিব জালাল আহমেদ বলেন, আমাদের দেশের পরিস্থিতি এখনও ভালো। তবে পরিস্থিতি খারাপ হলে সরকারের স্বাস্থ্যনীতি মেনে বাকি সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে। আগামী ১ ফেব্রুয়ারি মাননীয় প্রধানমন্ত্রী বইমেলা উদ্বোধন করবেন আমরা সে প্রস্তুতি নিয়েই এগুচ্ছি। প্রকাশকরা শঙ্কায় আছেন, তা আমরাও বুঝতে পারছি। কিন্তু পরিস্থিতি খারাপ না হলে বা ভালো থাকলে হঠাৎ করে তো প্রস্ততি নিতে পারবো না। এছাড়া সবারই মত, বইমেলা হলে যেন ফেব্রুয়ারিতেই হয়।
বাংলাদেশ পুস্তক প্রকাশক ও বিক্রেতা সমিতির সহ-সভাপতি এবং বইমেলা আয়োজন কমিটির সদস্য শ্যামল দত্ত বলেন, গত বছর আমরা অনেক ক্ষতির মুখে পড়েছি। আমরা আর ক্ষতিগ্রস্ত হতে চাই না। মেলার জন্য আমাদের (প্রকাশক) পূর্ণ প্রস্তুতি আছে। এখন পর্যন্ত পরিস্থিতি যেমন, তাতে মেলা হওয়া উচিত।
আহমদ পাবলিশিং হাউজের কর্ণধার ও বাংলাদেশ জ্ঞান ও সৃজনশীল প্রকাশক সমিতির পরিচালক মেজবাহ উদ্দীন বলেন, সরকার চাচ্ছে, আমরাও চাচ্ছি মেলাটা হোক। কিন্তু, যদি সরকার আশ্বস্ত করে যে, মেলা শুরু হলে তা শেষ পর্যন্ত চলবে, তবে মেলা হওয়া উচিত। মাঝপথে যদি মেলা বন্ধ বা স্থগিত হয়, তবে প্রকাশকরা বড় ক্ষতির মুখে পড়বে। সেটা পুষিয়ে নেওয়া কঠিন হবে।
বাংলাদেশ জ্ঞান ও সৃজনশীল প্রকাশক সমিতির নির্বাহী পরিচালক খান মাহবুব বলেন, মেলাটা যেন সঠিক সময়েই হয়, আমি তা চাই। কিন্তু পরিস্থিতি যদি নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যায়, যদি অতিমারী হয়, তবে তো কারও কিছু করার থাকবে না। এখনও পর্যন্ত যে পরিস্থিতি, তাতে মনে হচ্ছে মেলা হবে।
ভাষাচিত্র প্রকাশনীর স্বত্বাধিকারী ও বাংলাদেশ জ্ঞান ও সৃজনশীল প্রকাশক সমিতির সাবেক অতিরিক্ত নির্বাহী পরিচালক খন্দকার মনিরুল ইসলাম বলেন, অমর একুশে গ্রন্থমেলার আয়োজন নিয়ে গত বছর এবং এ বছরও সাধারণ প্রকাশকদের আগ্রহ এবং ব্যবসায়িক অবস্থা বিবেচনা না করে অল্প কিছু সংখ্যক প্রকাশকের আগ্রহকে প্রাধান্য দেয়া হয়েছে। করোনা পরিস্থিতিতে অনেক সাধারণ প্রকাশক বইমেলা আয়োজনের বিপক্ষে। আমরা কিছু প্রকাশককে দেখেছি যারা নিয়মিত বইমেলায় অংশ নিলেও এ বছর স্টল বরাদ্দে আগ্রহ দেখায়নি।
গত বছর পৃথিবীর সর্ববৃহৎ ফ্রাঙ্কফুর্ট বইমেলা, পার্শ্ববর্তী দেশ ভারতের দিল্লী, কলকাতা বইমেলাসহ বিশ্বের বিভিন্ন দেশের বইমেলাসমূহ স্থগিত করা হলেও বাংলাদেশের বইমেলা আয়োজন করা হয়েছে। মেলায় অংশগ্রহণকারী সকল প্রকাশনা প্রতিষ্ঠান বিপুল পরিমান বাণিজ্যিক ক্ষতির সম্মুখিন হয়েছেন। সরকারের কাছে প্রণোদনার দাবি করলেও কোনো ধরনের প্রণোদনা পাননি প্রকাশকগণ। এবছরও একই ক্ষতির আশংকায় আছি আমরা। যদি বইমেলার স্টল ভাড়া এবং প্রণোদনা বিষয়ে সরকারের কাছ থেকে কোনো আশ্বাস পাওয়া যেত তাহলে প্রকাশকগণ আশাবাদী হতেন।
বইমেলার আয়োজন নিয়ে সবচেয়ে বেশি শঙ্কা দেখা দিয়েছে তুলনামূলক কম পুঁজির প্রকাশকদের মধ্যে। তরুণ প্রকাশকদের মধ্যে বইমেলা আয়োজন নিয়ে ভিন্ন সুর লক্ষ্য করা যায়। এ প্রসঙ্গে শব্দশৈলী প্রকাশনীর প্রকাশক ও বাংলাদেশ জ্ঞান ও সৃজনশীল প্রকাশক সমিতির নবনির্বাচিত পরিচালক ইফতেখার আমিন বলেন, মেলা নিয়ে আমরা এতদিন পজেটিভ ছিলাম। সারা বছর ধরেই প্রায় মেলার জন্য প্রস্তুতি নিয়েছি। কিন্তু মেলা শুরুর পর যদি বন্ধ হয়ে যায়, তবে তা সামাল দেওয়া কঠিন হবে। আমরা দেউলিয়া হয়ে যাব। একটা স্টল বানাতে অনেক খরচ। গত বছর স্টল ভাড়া অর্ধেক করা হয়েছিল। এ বছর আমরা দাবি করছি ভাড়া না নেওয়ার। ধরুন ভাড়ার টাকা দিয়ে দিলাম, স্টলও বানালাম, কিন্তু মেলা হলো না। তাহলে কী হবে? দায় কে নেবে, আমাদের কী হবে? তাহলে এ পেশায় অনেকেই আর টিকতে পারবে না।
তিনি বলেন, শুধু আবেগ দিয়ে বইমেলা হবে না। দুই পক্ষকে বিষয়টি চিন্তা করতে হবে, বুঝে শুনে যুগোপযোগী সিদ্ধান্ত নিতে হবে। প্রকাশকরা যে ক্ষতির মুখে পড়বেন, তা কিভাবে পোষাবেন সে বিষয়ে একটা সিদ্ধান্ত আসতে হবে।
পরিবার প্রকাশনীর প্রকাশক সোহানুর রহিম শাওন বলেন, গত বছর আমরা পরিস্থিতি বুঝে মেলা করতে চাইনি। আমাদেরকে দিয়ে জোর করে ফেব্রুয়ারির বইমেলা মার্চে করানো হয়েছে। আমরা বাধ্য হয়েছি অংশ নিতে। ফলে ক্ষতির মুখে পড়েছি। অথচ কলকাতা বইমেলা হয়নি।
তিনি আরও জানান, এ বছরও মেলার জন্য প্রস্তুতি নিয়েছি। মেলা না হলে অবশ্যই ক্ষতির মুখে পড়বো। বেশি ক্ষতি হবে, যদি মেলা শুরু হয়ে বন্ধ হয়ে যায়।
কপিরাইট © ২০১৭ - ২০২০ ।। বইদেশ-এ প্রকাশিত কোনও সংবাদ, কলাম, তথ্য, ছবি, কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না
Design & Development by: TeamWork BD