।। সুমন টিংকু ।।
আমি আজকে অ্যাম্বুলেন্স নিয়ে আসতে চাইনি। কিন্তু, এই অ্যাম্বুলেন্সের আরেক চালক সেলিমের মেয়েটা হঠাৎ অসুস্থ হয়ে পড়াতে আমাকেই আজকে ডিউটি করতে হচ্ছে। অথচ, আজ আমার এয়ারপোর্টে যাওয়ার কথা। বড় মামা এসেছেন সৌদি থেকে দশ বছর পর। রাত দুইটার দিকে ফ্লাইট ল্যান্ড করার কথা। আমার দায়িত্ব ছিল বড় মামাকে আনতে যাওয়ার। আমি ছাড়া আর আছেই বা কে এই দায়িত্ব নেয়ার মতন? কিন্তু তা আর হলাে কই?
প্রচন্ড বৃষ্টি হচ্ছে, রাস্তা ঠিকমত দেখা যাচ্ছে না। দশহাত দুরের জিনিসও ঠাওর করতে কষ্ট হচ্ছে। সাদা কুয়াশার একটা প্রলেপ যেন পুরো পৃথিবীটাকেই আচ্ছন্ন করে রেখেছে। হঠাৎ হঠাৎ এমন জোরে বিজলি চমকাচ্ছে, মনে হচ্ছে, সবকিছু পুড়িয়ে দেবে। গন্তব্যে পৌঁছতে আরও প্রায় ১০০ কিলোমিটার পথ বাকি। ঘড়ির দিকে তাকিয়ে বুঝলাম, রাত একটার কাছাকাছি। তার মানে শহর থেকে রওনা দিয়েছি প্রায় দুইঘণ্টা পেরিয়েছে।কিন্তু খুব একটা এগুতে পারিনি।
লাশ বহন করার এই ফ্রিজার অ্যাম্বুলেন্সগুলো ভাড়া ঘণ্টা হিসেবে। যদি কাস্টমার ইলেক্ট্রিসিটি ব্যবস্থা করে দেয়, তাহলে একরকম রেট আর যদি নিজেদের ব্যবস্থা করতে হয়, তাহলে ভিন্ন রেট। বেশিরভাগ সময় কাস্টমাররাই ব্যবস্থা করে। কারণ, তাতে ভাড়া কম পড়ে । তাছাড়া এখন তো গ্রামের ঘরে ঘরেও বিদ্যুৎ পৌঁছে গেছে। তবে, মাঝেমধ্যেই ঘণ্টার হিসেব নিয়ে কাস্টমারদের সাথে তর্কাতর্কি হয়। অনেকেই ঘণ্টার হিসেবটাকে কমিয়ে নিয়ে টাকা কম দিতে চায়।
হঠাৎ করে গাড়িটি প্রচন্ড ঝাঁকুনি খেলাে একটি গর্তে পড়ার কারণে। একে তো বৃষ্টি, তার উপর সামনের দিক থেকে আসা গাড়ির হেডলাইট চোখে পড়ায় সামনের গর্তটা দেখতে পাইনি। আমার পাশের সিটে বসে আছে একটা অল্পবয়সী ছেলে, সে মৃত ব্যক্তির দূর সম্পর্কের ভাগিনা। অনেকক্ষণ ধরে কান্নাকাটি করার পর এখন নাক ডেকে ঘুমাচ্ছে । জানালার দিকে ওর মাথাটা কাত হয়ে আছে। এই গাড়িটা মোটামুটি পুরনো। বাঁ পাশের দরজার গ্লাসটা পুরোপুরি লাগানো যায় না। মালিক এইসবের তেয়াক্কা করে না। ফ্রিজারটা ঠিক থাকলেই হলাে আর গাড়ির অন্য পার্টস খুলে পড়ে গেলেও কোনাে সমস্যা নেই। কারণ, এই গাড়ির আসল অংশ হলাে ফ্রিজার। ঐটাই ইনকাম ইন্জিন।দরজার গ্লাসের ফাঁক গলে আসা বৃষ্টির ছাঁটে ছেলেটার মুখটা ভিজে যাচ্ছে। কিন্তু তাতে ওর ভ্রূক্ষেপ নেই। চুলগুলো ভিজে জবজবে হয়ে আছে। চোখের ভ্রূতে রূপালি দানা হয়ে পানি জমে আছে। একটু পরপর সেগুলো বেশ ভারি হয়ে টুপ করে নীচে গড়িয়ে যাচ্ছে।
অনেকক্ষণ হয়ে গেল। কিন্তু বৃষ্টির তোড় একটুও কমেনি।সামনের বৃষ্টির সাদা পর্দা সরিয়ে খুব সাবধানে যেতে হচ্ছে, তাই গাড়ির গতি খুব একটা বাড়ানো যাচ্ছে না। বেশ জোরে বাতাসও বইছে। রাস্তার দুইধারের গাছগুলোর ডালপালা প্রচন্ড বেগে দোল খাচ্ছে, যেন মাটিতে গড়িয়ে পড়বে। তাই ভয়ও হচ্ছে এখন, গাছের ডাল অথবা আস্ত একটা গাছ ভেঙ্গে না পড়লেই হয় । রাস্তার মাঝখানে যদি বড় কেন গাছ ভেঙে পড়ে, তাহলে তো রাস্তাই বন্ধ হয়ে যাবে। আর যদি, কোনাে ডাল গাড়ির ওপর ভেঙে পড়ে, তাহলে তো আরেক বিপদ। আজ কী সিগন্যাল-টিগন্যাল কিছু ছিল না কী ! খবর-টবর দেখা হয় না আজকাল।টেলিভিশনে এত চ্যানেলের ছড়াছড়ি, কোন খবর যে ঠিক- সেটাই বোঝা মুশকিল। এক চ্যানেল যদি বলল দিন, আরেক চ্যানেল হয়তো বলবে রাত। অবশ্য এগুলো নিয়ে মাথা ঘামানোর সুযোগই বা কোথায়? ফেসবুকেই তো সবসময় শেষ। একবার ঢুকলে আর বেরুনো যায় না। অনেকটা গোলকধাঁধার মতাে।একবার ভেতরে ঢুকে গেলে, বাইরে বেরুনোর পথ খুঁজে পাওয়া কঠিন। ফেসবুকে অবশ্য অনেক খবর পাওয়া যায়। কিন্তু এগুলোও বিশ্বাস করা কঠিন। আমি খেয়াল করে দেখেছি, এখানকার প্রায় তথ্যই মিথ্যা এবং বানোয়াট। যার যা খুশি ইচ্ছেমতাে এবং সুবিধামত বানিয়ে পোস্ট করে দেয়। সিনেমার মতােন এখানেও সেন্সর থাকা উচিত।
না, এভাবে এগুনো যাবে না । সামনে একটা বাজার দেখে গাড়িটা থামাতে হবে। বৃষ্টি এবং বাতাসের বেগটা একটু কমলে তবেই আবার স্টার্ট দেব। তাছাড়া অনেকক্ষণ সিগারেট খাওয়া হয়নি। কাচটা নামিয়ে দিয়ে যে সিগারেট খাব তারও উপায় নেই। তাহেল একদম ভিজে যাব। আরও প্রায় এক ঘণ্টা চালানোর পরেও কোনাে বাজারের হদিশ পাওয়া গেল না। তাই আমাকে গাড়ি চালিয়েই যেতে হচ্ছে ।
হ্যাঁ, এখন বৃষ্টিটা একটু ধরে এসেছে। বাতাসের বেগও কমেছে। কাচটা নামিয়ে বাতাসের বেগ মাপলাম। বড় রাস্তা থেকে আমরা বাঁ পাশের ছোট রাস্তায় নেমে এসেছি, তাও অনেকক্ষণ। দুইপাশে জমি, কিন্তু কোনাে বাড়িঘর চোখে পড়ছে না। সামনে আরও কিছুদূর এগুতেই দেখলাম এই রাস্তাটার দুটো মুখ। কিন্তু এখন কোন মুখে যেতে হবে বুঝতে পারছি না। পাশের ছেলেটিকে ডেকে উঠানোর চেষ্টা করলাম।
এই ভাই, উঠাে, উঠাে।
ছেলেটির ঘুম ভাঙ্গতেই মামুরে… করে বিলাপ ধরে বসল।
আরে ভাই, পরে কাইন্দ। এখন কও কোনদিক যামু? সামনে তো দুই রাস্তার মাথা।
আমি তো চিনি না।
কও কি? চিনাে না? তাইলে? এত রাইতে আমি কারে জিগাই?
সামনে একটু রাখেন। কোনাে একটা ঘরে গিয়া গেরামের নাম কইয়া জিগাই।
আরে ভাই, এত রাইতে ওরা তোমারে দরজা খুইলা দিব বইলা মনে হয়? ঝড় বৃষ্টির রাইত। তাছাড়া, আশেপাশে বাড়ি-ঘরের কোনাে নিশানাও তো চোখে পড়তাছে না।
হঠাৎ শুনলাম কেউ একজন বলে উঠল, ডাইনে যাও। বললাম, এই যে কইলা চিনাে না, আর অহন কইলা ডাইনে যাও।
না ভাই, আমি তো চিনি না। আমি ক্যামনে কমু, ডাইনে না বাঁয়ে?
কিন্তু, আমি পরিস্কার শুনতে পেয়েছি। কেউ একজন বলেছে। তবে, কণ্ঠটা এই ছেলেটার কণ্ঠের মতাে মনে হয়নি। একটা অপরিচিত কণ্ঠ। কিন্তু, গাড়িতে আছিই তো আমরা দুইজন, ছেলেটি ছাড়া আর কে বলতে পারে? বোধহয় ঘুমকণ্ঠে বলেছে, তাই শব্দটা অন্যরকম শুনিয়েছে এবং সে হয়তো নিজেই আনমনে বলে ফেলেছে বলে বুঝতে পারছে না যে, শব্দগুলো তার মুখ দিয়েই বের হয়েছে।
মাঝরাস্তায় গাড়ি দাঁড় করিয়ে না রেখে ডানে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিলাম। বেশ কিছুদূর যাওয়ার পর একটা ভরসা পেলাম। দেখি, রাস্তার পাশে একটা লোক অলস ভঙ্গীতে বসে আছে। গাছের গুঁড়িতে হেলান দিয়ে। কিন্তু এত রাতে! তাও আবার ঝড় বাদলের রাতে? এই লোকটা এখানে বসে কী করছে। যা ইচ্ছা করুক, তাতে আমার কী?
আমি লোকটির পাশে গাড়ি দাঁড় করিয়ে কিছু একটা বলতে যাওয়ার আগেই লোকটি হাত উঁচিয়ে রাস্তা দেখিয়ে আমার দিকে একবারও না তাকিয়ে উল্টোদিকে হাঁটতে লাগল। এতক্ষণ আয়েশিভাবে বসে ছিল। আর এখন আমাদের দেখেই উঠে চলে গেল? বুঝলাম, মতলব ভালো না। নিশ্চয়ই চোর-ডাকাত হবে।হঠাৎ খেয়াল হলাে, ডাকাতও তো হতে পারত, যারা নির্জন রাস্তায় একা গাড়ি পেলে থামিয়ে ডাকাতি করে। অবশ্য, অ্যাম্বুলেন্স তো আর ডাকাতি করার জিনিস নয়। তার উপর, এইটা হচ্ছে লাশবাহী ফ্রিজার গাড়ি।
সাত-পাঁচ ভাবতে ভাবতে সামনের দিকে এগুতে থাকলাম।একটা পুকুরের কাছে এসেই হঠাৎ করে ব্রেক কষতে হলাে। এটা-সেটা ভাবতে ভাবতে খেয়ালই করিনি যে, রাস্তাটা এখানেই শেষ। একটা ঝাঁকি খেলাম। এভাবে কোনাে রাস্তা শেষ হয় নাকি! পুকুরটা দেখলাম বেশ বড়। পুকুর না বলে একে দীঘি বলাই যুক্তিসঙ্গত। মুশকিলে পড়ে গেলাম। এখন তো আর যাওয়ার উপায় নেই, গাড়ি থেকে নামতেই হবে।
গাড়ি থেকে নেমে দেখলাম, দীঘির আশেপাশে কোনাে রাস্তা নেই, শুধু বিল। অনেক দূরে একটা গ্রামের মতাে আবছা কিছু একটা দেখা যাচ্ছে, ঠিক বোঝা যাচ্ছে না। গ্রামও হতে পারে, আবার জঙ্গলও। কিন্তু, যদি গ্রাম হয়, তাহলে ঐ গ্রামের লোকজনই বা আসা-যাওয়া করে কীভাবে? দীঘি সাঁতরে যায়, নাকি বিলের উপর দিয়েই পার হয়? অথবা গ্রামের ঐ পাশে অন্য কোনাে রাস্তা আছে কি? কেমন অদ্ভুত! এভাবে হঠাৎ রাস্তা শেষ হয় নাকি?
হঠাৎ মনে হলাে, আমাদের জীবনের রাস্তাও বুঝি এভাবেই হঠাৎ শেষ হয়ে কোনাে একটা দীঘির কাছে এসে থেমে যায়।
নাকি, যাকে গ্রাম ভাবছি, সেটি আদতে একটা জঙ্গল। দীঘির পাড়ে দাঁড়িয়ে ভালো করে ঠাহর করতে চেষ্টা করছি। হ্যাঁ, এইবার নিশ্চিত হলাম, চারদিকে গাছগাছালিতে ঘেরা এটি একটি গ্রামই।টিনের চালাগুলো খুব অস্পষ্টভাবে সাদা হয়ে গাছের ফাঁক গলে উঁকি দিচ্ছে।
নিশ্চয়ই কোনাে না কোনাে রাস্তা থাকবে। ছেলেটাকে ডেকে তোলার চেষ্টা করলাম, কিন্তু সে কিছুতেই উঠল না, গভীর ঘুম।এদিক-সেদিক অনেক খুঁজেও কোনাে রাস্তা পাওয়া গেল না। তবে কি ভুল রাস্তায় চলে এলাম? মহাবিপদ তো? ভোর হওয়া পর্যন্ত অপেক্ষা করব নাকি আবার ফিরে যাব উল্টো রাস্তায়? কিন্তু উল্টো রাস্তায় ফিরে যাওয়া তো সম্ভব নয়, অনেকখানি চলে এসেছি।
গাড়ির কাছে এসে ছেলেটাকে প্রায় জোর করেই ঘুম থেকে ডেকে তুললাম। না, এইবার সে আর মামুরে করে বিলাপ করে উঠল না।
ভাই, এইখানে তো আর কোনাে রাস্তা নাই। কোন দিকে যামু বুঝতে পারতাছি না। তুমি কি একটু খোঁজ কইরা দেখবা?
ছেলেটি কোনাে কথা না বলে, কোনাে রাস্তা খোঁজার বিন্দুমাত্র চেষ্টাটুকু না করে নির্বিকারভাবে বিলে নেমে পড়ল এবং কাদা মাড়িয়ে দূরের গ্রামটির দিকে হেঁটে চলল, যেন গ্রামটিতে এভাবেই সে রোজ যাতায়াত করে। আমি তার দিকে অবাক হয়ে তাকিয়ে আছি। একসময় সে বিন্দু হয়ে মিলিয়ে গেল।
ঘড়ি দেখলাম, রাত চারটা বাজে। প্রায় ছয়ঘণ্টা গাড়ি চালিয়ে খুব ক্লান্ত লাগছে। সিটে বসে চোখ বুঁজে শরীরটা এলিয়ে দিলাম, একটু ঘুমিয়ে নিই বরং, ছেলেটি ফিরে আসা পর্যন্ত।
একটু পরে মনে হলাে, মুখটা ধুয়ে নিলে ভালো হতাে। একটা সিগারেট খাওয়াও দরকার। গাড়ি থেকে নেমে এলাম। হ্যাঁ, ডানদিকে একটা ঘাট দেখা যাচ্ছে, কিন্তু ঐ ঘাটে যায় কীভাবে? কোনাে রাস্তা তো চোখে পড়ছে না। দীঘির পাড়টাও এত সরু যে, হেঁটে যাওয়া যাবে না।
অগত্যা ,প্যান্টটা মোটামুটি গুটিয়ে নিয়ে বিলেই নেমে পড়লাম। বিলে নামতেই প্রায় এক হাঁটু সমান কাদায় ডুবে গেলাম। এ তো মহা কেলেঙ্কারী! বুঝতে পারিনি, এতখানি কাদা। প্যান্টটা কাদায় মাখামাখি হয়ে গেল। এখন নিজের উপর খুব রাগ হচ্ছে, মুখ ধোয়ার বাতিকটা মাথায় ওঠার জন্য। অনেক কষ্টে এক পা ওঠাই তো, আর এক পা ডুবে যায়। এভাবে, কোনােমতে দীঘির ঘাটে এসে পৌঁছুলাম। আরে, এখানকার লোকজন কি এভাবেই কাদা মাড়িয়ে পুকুরে এসে আবার কাদা মাড়িয়ে ফিরে যায়? আশ্চর্য তো! বাপের জন্মে এরকম দীঘি দেখিনি।
দীঘির ঘাটে আসতেই মনটা প্রশান্তিতে ভরে উঠল। ঘাট লাগানো একটা শিউলি গাছ আর তার থেকে বৃষ্টির মতাে শিউলি ঝরে পড়ছে। একবার একটা হিন্দি সিনেমায় দেখেছিলাম, আমেরিকা না কোনাে একটা দেশে নায়িকা জানালা দিয়ে দেখছে , সাদা সাদা বরফ আকাশ থেকে ঝরে পড়ছে। এও যেন সেরকম।শিউলিতে ছেয়ে ঘাটটা একেবারে সাদা হয়ে আছে। আমি ঠিক গাছটার নীচে দাঁড়িয়ে রইলাম, শিউলি বৃষ্টিতে নিজেকে ভিজাব বলে। চারদিকে শিউলি ফুলের গন্ধে মৌ মৌ করছে। ভালো লাগায় আমি বুঁদ হয়ে রইলাম। আমার পুরো শরীর সাদা হয়ে উঠল। নিজেকে মনে হলাে শিউলিগন্ধা একজন।
দীঘিতে নেমে পা দু’খানা এবং প্যান্টটা ভালো করে ধুয়ে নিলাম। খেয়াল করলাম, পানির গন্ধটা খুব মিষ্টি। আমার মনে হলাে, এই পানি খাওয়া যায়। আমি আঁজলা ভরে পানি মুখে দিতেই প্রচন্ড তৃষ্ণায় আমি ক্রমশ অবশ হয়ে যেতে লাগলাম। দীঘি আমাকে তার দিকে টানতে লাগল। আমি হাঁটতে হাঁটতে দীঘির মাঝখানে চলে এলাম। একটা দীঘি, অথচ, তা এত অগভীর কেন? কিন্তু তা তো নয়। ঐ যে পাড়টাকে অনেক উঁচু লাগছে এবং দীঘির পানিও তো পাড় ছুঁইছুঁই। তবে কি আমিই অনেক লম্বা যে, দীঘির মাঝখানে অবলীলায় হেঁটে চলে আসলাম! কিন্তু, আমার উচ্চতা তো মাত্র পাঁচ ফুট।
খেয়াল করলাম, ফ্রিজারের পেছনের দরজা খুলে শুয়ে থাকা মৃত লোকটি নীচে নেমে এলাে। গায়ে এখনো কফিনের কাপড় জড়ানো।
এদিক-ওদিক না তাকিয়ে সোজা দীঘির পাড়ে নেমে এসে পানি পান করতে লাগল। আমার দিকে এক ঝলক তাকালো। আমার এমন মায়া লাগল যে, তাঁকে জিজ্ঞাসা না করে পারলাম না, চাচা খিদা লাগছে?
না। খালি পিপাসা।
শুয়ে থাকা অবস্থায় বোঝা যায়নি, এই লোকটি দেখতে খুব সুন্দর, অনেকটা পুরনো বাংলা ছবির নায়ক রহমানের মতাে। বয়স সত্তর, পঁচাত্তর হবে। লোকটি বলল, পানি খুব মিষ্টি।
হ, চাচা। আইচ্ছা, ঐডা কি আপনার গ্রাম?
জানি না।
কী বলেন? নিজের গ্রাম চেনেন না?
নিজের বলে কিছু কি আছে? আপন ঔরষজাতরাও কি নিজের?
বুঝলাম না। এত কঠিন কইরা কন!
কঠিন বুঝি? সবই আসলে সোজা, আবার সবই কঠিন। তুমি যেভাবে দেখতে চাও।
মৃত লোকটি আমার কাছাকাছি এসে দাঁড়িয়েছে। অথচ, আমার একটুও ভয় লাগছে না। লোকটি বলল, আচ্ছা তোমার কাছে সিগারেট হবে? জ্বি হইব, কিন্তু এই ব্র্যান্ড কী আপনে খাইবেন?
লোকটি বলল, মরা মানুষের আবার ব্র্যান্ড? ঐসব ব্র্যান্ড ফ্র্যান্ড সব দম থাকা পর্যন্তই। দম ফুরালে এসবের কোনাে মূল্যই নেই।দাও, একটা সিগারেট দাও। মর্গে আর তোমার গাড়িতে শুয়ে থেকে থেকে পানির পিপাসা যেমন লেগেছে, সিগারেটের পিপাসাও জেগেছে। গলাটা একদম শুকিয়ে আছে।
আমি সিগারেট বের করে লোকটিকে ধরিয়ে দিলাম। সিগারেট জ্বালানোর সময় খুব কাছ থেকে লক্ষ্য করলাম, এই লোকের চেহারাটা বেশ সমীহ জাগানিয়া। দারুণ একটা ব্যক্তিত্বের আভা তাঁর চেহারাকে উজ্জ্বল করে রেখেছে। লোকটির সামনে সিগারেট খেতে আমার খুব সঙ্কোচ বোধ হলাে, তাই সেই ইচ্ছে তে তালা দিলাম। লোকটি সিগারেটে লম্বা একটা টান দিয়ে একমুখ ধোঁয়া গিলে, তারপর তৃপ্তি করে ধোঁয়া ছাড়তে ছাড়তে বলে যেতে লাগল, ও, তোমার সাথে তো আমার পরিচয়টাই হলাে না। যদিও তোমার কাছে আমি নিতান্তই গোবেচারা একটা লাশ। কিন্তু লাশ হওয়ার আগে আমার একটা পরিচয় ছিল। আমার নাম — না, নাম দিয়ে কাজ কি? আমি একজন অবসরপ্রাপ্ত শিক্ষক। কলেজে পড়াতাম, ইতিহাস। ইতিহাস খুব ইন্টারেস্টিং একটা সাবজেক্ট বুঝলে। ইতিহাসের মজার ব্যাপার হচ্ছে, ইতিহাস ফিরে ফিরে আসে। আরও একটা মজার ব্যাপার হচ্ছে , এই ফিরে আসার পরেও ইতিহাস থেকে মানুষ কখনোই শিক্ষা নেয় না। দারুণ না? জানাে, এই মানুষ প্রাণীটা না খুব অদ্ভুত ধরনের বোকা এবং স্ববিরোধী। নিজেকে সৃষ্টির সেরা বলে সে প্রচার করে আত্মশ্লাঘায় ভোগে। অথচ, সে জানে না, সে মর্মে মর্মে স্বার্থপর, নোংরামিই তার বিনোদন এবং লক্ষ্য। জানে না বলাটা ঠিক হবে না। সে জানে, কিন্তু স্বীকার করতে চায় না, পাছে প্রাণীকুলে তার তথাকথিত শ্রেষ্ঠত্ব প্রশ্নের সম্মুখীন হয়। এই দেখাে, কী বলতে কী বকা শুরু করলাম। আসলে, শিক্ষকতা করেছি তো সারাজীবন, তাই বকবকানির রোগটা আর সারলই না। কী ব্যাপার তুমি সিগারেট খাবে না? গাড়ি চালাতে চালাতে তুমি তো বেশ কয়েকবার সিগারেট খেতে চেয়েছ, আমি লক্ষ্য করেছি। আমার আমতা আমতা দেখে লোকটি বলল, আরে সঙ্কোচের কিছু নেই, খাও। সিগারেট খাওয়া না খাওয়া নিয়ে সম্মান-অসম্মান মাপা যায় না, সেটা মাপার মাপকাঠিও নয়।সিগারেট খেলে না ঠিকই, পিছনে আমার ক্ষতিটুকু করে দিলে, এটাকে কী সম্মান প্রদর্শন বলে? ওসব হচ্ছে সামন্তবাদী চিন্তাধারা।
তারপরও আমি সিগারেট ধরালাম না। লোকটি আবার কথায় ফিরে গেল।
বলছিলাম, আমার তিন ছেলে, সবাই বিদেশে থাকে। আমার স্ত্রী মারা গেছে দু বছর আগে। সেই থেকে আমি ভীষণ একা। তবে, মারা যাওয়ার পরেও আমাকে দূরে সরিয়ে দেয়নি। নিয়ম করে আমার সঙ্গে প্রতিদিন গল্প করার জন্য চলে আসত। কি অবাক হলে? মৃত লোক কীভাবে গল্প করে? এই এখন আমি যেমন তোমার সঙ্গে করছি। তো, আমাদের খুব শখ ছিল, ছেলে, ছেলের বউ, নাতি-নাতনি নিয়ে একটা ভরা সংসার হবে। নাতি-নাতনির সঙ্গে হুটোপুটি করব, হৈ হৈ করে বাডি মাথায় তুলব, বিকালে বাগানে এসে বসব, ছেলের বউ চা করে এনে দেবে। কিন্তু, ছেলেরা খুব ক্যারিয়ারিস্ট। এই পচা দেশে ওরা একেবারে পচে মরবে, এই আশঙ্কায়, ওরা তল্পিতল্পা গুটিয়ে দেশ ছেড়ে পালাল। আমরা বুড়ো-বুড়ি একা পড়ে রইলাম। নাতি-নাতনিগুলোকে একটু ছোঁয়ার জন্য, বুকে একটু লেপ্টে নেয়ার জন্য মনটা আকুলি বিকুলি করত।
লোকটা অনেকক্ষণ একনাগাডে কথা বলার পর একটু দম নিতে চাইল।
এই ফাঁকে আমি জিজ্ঞাসা করলাম, আপনারা পোলাগো কাছে গিয়া থাকলেই পারতেন?
তা পারতাম। কিন্তু আমার বাবা-মায়ের কবর ফেলে কীভাবে যাই। তাঁরা দায়িত্ব নিয়ে আমাদের মানুষ করেছেন। সন্তান হিসেবে তাঁদের দেখভাল করাটাও তো আমাদের দায়িত্বের মধ্যে পড়ে। এমনকি তাঁদের মৃত্যুর পরেও। নিয়মিত তাঁদের কবর জিয়ারত করা, সেটাও দায়িত্ব। তাছাড়া আমার ছেলেরা খুব ব্যস্ত। আমাদের দেখাশোনা করার সময়ই বা কোথায়। দু’বছর আগে যখন তাদের মা মারা যায়, সেই গর্ভধারিণীকেও শেষবারের জন্য দেখতে আসার সময় তাদের হয়নি।
লোকটির দু’চোখে জলের ধারা। লোকটি শেষ হয়ে যাওয়া সিগারেট পানিতে ছুঁড়ে দিয়ে আবার বলতে শুরু করল, আমি মারা গেছি আজ তিন দিন। আমাকে মর্গে রাখার জন্য আমার আত্মীয়-স্বজনদের নির্দেশ দিয়েছে আমার ছেলেরা। ওরা আসার পরেই আমাকে কবর দিবে। ওরা সবাই আজ রাতেই দেশে এসে পৌঁছেছে। না, আমাকে শেষ দেখা দেখবে বলে নয়। ওদের আশঙ্কা, এই সময় যদি অন্তত দেশে না আসে, তাহলে আমার কষ্টার্জিত সম্পদ, জায়গা-জমি সব বেহাত হয়ে যাবে। সেই জায়গা সম্পত্তি, ব্যাংকের আমানত সব ভাগ-বাটোয়ারা হবে- এইটুকু বলে লোকটি প্রচন্ড হাসতে লাগল। হাসি যেন আর থামতেই চাইছে না। তারপর একটা লম্বা দম নিয়ে আবার বলতে শুরু করল- কিন্তু ওরা জানে না, ব্যাংকে আমার তেমন কোনাে আমানত নেই। শহরে আমার ভাড়া বাসা। আর, গ্রামে যে জায়গা সম্পত্তি আছে, তাও আমি গ্রামের স্কুলের নামে উইল করে গেছি। আমি জানি, এসব ওরা যখন জানতে পারবে, আমাকে খুব করে বদদোয়া দেবে, আফসোস করবে এই ভেবে যে, কেন এতদূর থেকে এত কষ্ট করে ওরা এলাে।
লোকটি হঠাৎ আমার হাত ধরে বলল, তুমি আমার একটা উপকার করাে বাবা। আমাকে এদের হাতে তুলে দিও না। তুমি আমাকে ফিরিয়ে নিয়ে যাও।
আমি জিজ্ঞাসা করলাম, কই নিমু?
মেডিক্যালে। ওখানে আমার শরীরটা দান করে দাও। ওদের সঙ্গে আমার চুক্তি হয়েছে। আমার বাসায় বেডরুমের আলমারিটার নীচের দিকে একটা ছোট দেরাজের ভিতর ঐ চুক্তিপত্রটা আছে। তোমাকে বললাম না, মানুষ মর্মে মর্মে খুব স্বার্থপর, নোংরামিই তার বিনোদন এবং লক্ষ্য। আমার ছেলেরা সেই স্বার্থপরদের প্রতিনিধি। তাই ওদেরকে শেষ দায়িত্বটা থেকেও আমি মুক্তি দিলাম।
লোকটি এবার শব্দ করে হা হা করে কাঁদছে। কাঁদতে কাঁদতে লোকটি পুকুরের মাঝখানে গড়াগড়ি দিচ্ছে। এই কান্না আমার মাঝেও সংক্রমিত হলো। হু হু কান্নায় আমার বুকও ভেসে যাচ্ছে।দীঘির মাঝখানে দাঁড়িয়ে আমি শব্দ করে কাঁদতে লাগলাম।
আমার ঘুম ভেঙ্গে গেল। আমি অনুভব করলাম, আমার দু’চোখ কান্নায় ভিজা। আমি তাড়াতাড়ি গাড়ি ছেড়ে নেমে এলাম। পেছনে ফ্রিজারের দিকে গেলাম। ফ্রিজারের গ্লাসে চোখ রেখে লোকটির দিকে তাকালাম এবং অবাক হয়ে খেয়াল করলাম, লোকটির চোখ বেয়ে তাজা কান্না নেমে আসছে। নাকের পাতা ফুলে ফুলে উঠছে।
কাদামাখা পায়ে ছেলেটি দূরের গ্রামটি থেকে ফিরে এলাে। বলল, আশ্চর্য গেরাম! একটা মানুষও নাই। ঘর-বাড়ি সব খালি। দরজা জানালা হাঁটা কইরা সব খোলা। আলনায় কাপড় গুছাইয়া রাখছে, থালা বাসন সাজাইয়া রাখছে। কিন্তু কোনাে লোকজন নাই। অনেকগুলান ঘরে গেলাম। সবগুলাতেই এক কারবার।গেরাম জুইড়া কব্বরের নীরবতা। বাপের জন্মেও এমন দেখি নাই।
আমি বললাম, চলাে ফিইরা যাই। ছেলেটি আর কোনাে কথা না বলে গাড়িতে উঠে পড়ল।
আমিও লোকটিকে তাঁর স্বার্থপর ছেলেদের হাতে তুলে দেব না বলে গাড়ি স্টার্ট দিলাম।
পূবের আকাশে তখন নতুন ভোর উঁকি দিচ্ছে।
কপিরাইট © ২০১৭ - ২০২০ ।। বইদেশ-এ প্রকাশিত কোনও সংবাদ, কলাম, তথ্য, ছবি, কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না
Design & Development by: TeamWork BD