ভাষাচিত্র বুক ক্লাব আয়োজিত ‘শনিবারের গল্প’ শীর্ষক আয়োজন থেকে বাছাইকৃত গল্প নিয়ে প্রকাশিত হচ্ছে “দেশের বই ঈদ সাময়িকী”। আজ প্রকাশিত হলো মুনীরা ফেরদৌসীর ছোটগল্প বিড়াল
মন্টি আজ দুপুরে এলো না কেন বুঝতে পারলাম না। পিংকির খুব আদরের বিড়াল মন্টি। পিংকিরা আমাদের প্রতিবেশী ভাড়াটে। ওদের গ্রামের বাড়ি ফরিদপুরে। ওর বাবার চাকরিসূত্রে ওরা শরীয়তপুরের এই ছোট্ট মফস্বল নড়িয়াতে থাকে। আমাদের বাড়ি আর ওবাড়ির মাঝে দুই গজের দূরত্ব। মাঝে মাথা তুলে দাঁড়িয়েছে এক দেয়াল। ঐ বাড়িতে মোট পাঁচজন ভাড়াটিয়া থাকেন। এবার ঈদের ছুটিতে সবাই যার যার গ্রামের বাড়ি চলে গেছেন। পিংকিরাও গেছে। এই পাঁচ বছরের পিংকির সাথে আমার খুব ভাব। যাওয়ার সময় তার আদরের বিড়ালটি সে আমার দায়িত্বে দিয়ে গেল। বলে গেল, “আপু আমার মন্টির খেয়াল রেখো কিন্তু।”
মন্টি আমাদের বাড়ি এলে আমি ওকে কিছু না কিছু খেতে দিতাম। ও দেয়াল টপকে আসত। কিন্তু আজ দুপুরে এলো না। হয়তো ঘুমাচ্ছে। ও বাড়ির বাড়িওয়ালা এবার ঈদের ছুটিতে বাড়ি এলেন না। ঢাকায়ই থেকে গেলেন।
পিংকিদের পেছনের ঘরের জানালা আর আমার ঘরের জালানা একেবারে বরাবর হওয়ায় রাতে ওরা কখন ঘুমায় আর আমি কখন লাইট অফ করি সেটা স্পষ্টতই দুই ঘর থেকে দেখা যায়। প্রতিদিনের মতো আজও মধ্যরাতে আমার ঘুম ভাঙলো। আমি জানি একটু উঠে হাঁটাহাঁটি করে আবার শুয়ে পড়লেই ঘুম আসবে। এ আমার একরকম বদঅভ্যাস। তাই আমি বিছানায় না থেকে উঠে সোজা চলে গেলাম জানালার সামনের বারান্দায়। ঝুম বৃষ্টি হচ্ছে। হঠাৎ দেখলাম আলোর আভা আমার বারান্দায় উঁকি মারছে। বিদ্যুৎ চমকালো হয়তো। কিন্তু না, এ আলো বিদ্যুৎ চমকানোর না। মনে হলো পিংকিদের ঘর থেকে আলোটা আসছে। জানালা বন্ধ থাকায় ভেন্টিলেটর দিয়ে আলো আসছিল। একটা সন্দেহ হলেও তেমন পাত্তা দিলাম না। দিনের বেলা ব্যাপারখানা বেমালুম ভুলেই গেলাম। ঠিক দুইদিন পর একই ঘটনা ঘটলো। পরপর তিনদিন দেখে গেলাম অদ্ভুত সেই আলোর ঝলকানি ঠিক রাত দেড়টায়। কিন্তু সপ্তাহ জুড়ে বৃষ্টির জন্য কীসের আলো সেটা ঠিক বুঝে উঠতে পারলাম না। রোজার ঈদের সময়টায় বৃষ্টিটা যেন একটা রুটিন হয়ে গেছে। ব্যাপারটা মাকে জানালাম আমি। মা বলল, ওরা ফিরলে ব্যাপারটা দেখা যাবে।
ঈদের ছুটি শেষ হয়েছে প্রায় এক সপ্তাহ হলো। একে একে সব ভাড়াটিয়া ফিরলেও পিংকিদের ফেরার নাম নেই। ফোনেও পাওয়া গেল না তাদের। আর মন্টির তো কোনো হদিসই নেই। পিংকি ফিরলে কী যে বলব তাই ভাবছি। আরও এক সপ্তাহ চারদিন কেটে গেল কিন্তু পিংকিরা ফিরলো না।
যেদিন থেকে বাড়িতে মানুষের আনাগোণা শুরু হয়েছে সেদিন থেকে সেই আলোর আভা আর দেখতে পাচ্ছি না। কয়েকদিন পর পিংকির এক চাচা এলেন পিংকির বাবার কী একটা জরুরি কাগজের খোঁজে।
তার পরিচয় পাওয়ামাত্র সবাই জেঁকে ধরলো তাকে। একটাই প্রশ্ন, ‘পিংকিরা কোথায়?’
প্রশ্ন শুনে মাথায় যেন তার সাত আসমান ভেঙে পড়লো। বিস্ফারিত চোখে বললেন, ‘আপনারা জানেন না? তারা তো কদিন আগেই…’ এটুকু বলেই থেমে গেল লোকটা। চোখে তার অঝোরে বৃষ্টি নামল। কেউই কিছু বুঝতে পারছি না। ওরা আসলে কোথায়?
অনেকক্ষণ পর নিজেকে সামলে নিয়ে লোকটা ধীরে ধীরে বলল, ‘ঈদ শেষে বাড়ি থেকে ফেরার পথে আমার ভাই আর ভাবি এক দুর্ঘটনার শিকার হন। পুলিশের সহায়তায় তাদের লাশ আমরা রাস্তায় পাই।’ তার কথা শুনে সবাই বাকরুদ্ধ প্রায়। জিজ্ঞেস করলাম, ‘পিংকিও কি?’ বলল, ‘না ও বেঁচে আছে। মারাত্মক আহত হয়েছিল। অনেক রক্তবমি হয়েছে। এখনও সারেনি। ডাক্তার বলেছে সময় লাগবে।’ এটুকু বলেই সে পিংকিদের ঘরে যেতে চাইল। তালা ভেঙে ঢুকলাম সবাই।
এটা ঘর না আফ্রিকার জঙ্গল! সারাঘর ভর্তি আধপোড়া কাগজের টুকরো, ছাই, ছেঁড়া পাতা, আর কেমন বিকট একটা গন্ধ। ঘরের অবস্থা দেখে সবারই চোখ চড়কগাছ। এরকম কী করে হতে পারে! কাগজগুলোর মধ্যে নখের আঁচড় দেখা গেল। প্রথম দেখায় সবাই ধরেই নিলো এটা মন্টিরই কাজ। কিন্তু মন্টি পাতা দিয়ে কী করবে! বিড়াল তো আর ছাগল না যে পাতা খাবে। আমাদের মুখে মন্টির কথা শুনে লোকটা চমকে উঠে বলল, ‘এটাই বুঝি সেই বিড়াল যাকে আমার ভাই-ভাবির দাফন-কাফনের সময় দেখা গেছে!’ সবাই ভাবলাম কী যা তা বলছে লোকটা! এবার সে বিস্তারিত বলল। পিংকির মা-বাবার মৃত্যুটা স্বাভাবিক মনে হলেও স্বাভাবিক ছিল না। বাড়ি থেকে ফেরার আগের দিন দুজনেই অসুস্থ হয়ে পড়ে কিন্তু জরুরি কাজ থাকায় তারা পরেরদিন রওনা হয়ে যায়। মাঝপথে ঘটে দুর্ঘটনা। তবে তা কেমন দুর্ঘটনা তা নিয়ে সন্দেহ রয়েছে। তাদের দেহে তেমন কাটাছেঁড়া ছিল না। কোনো গাড়ি-ঘোড়া আশেপাশে চোখে পড়েনি প্রত্যক্ষদর্শীদের। তবে পুলিশ দুর্ঘটনা বলেই চালিয়ে দিয়েছে।
লাশের শেষ গোসল দেবার সময় বারবার তাদের শরীরের নানা স্থান রক্তাক্ত হতে দেখা গেছে। অথচ সেই স্থানগুলো কোনোরূপ দুর্ঘটনা আক্রান্ত ছিল না। দাফন কাজের পুরোটা সময়জুড়ে একটা বিড়ালকে লাশগুলোর আশেপাশে দেখা গেছে। কেউই কোনোভাবেই পুরোপুরি তাড়িয়ে দিতে পারেনি তাকে। দফন কাজ সম্পন্ন হওয়ার পর বিড়ালটি উধাও! তাকে আর খুঁজে পাওয়া যায়নি। অথচ তাকে কবরে শেষ মাটিটুকু দেয়ার আগ পর্যন্ত দেখা গেছে। সাধারণ কৌতুহলবশত তারা বিষয়টি নিয়ে নিকটস্থ মসজিদের ইমামের কাছে যায়। ইমাম সাহেব সব শুনে কী বুঝলেন তিনিই জানেন। তিনি বললেন, লাশ তুলে আবার গোসল দিয়ে দাফন করতে। তার কথামতো তাই করা হলো কিন্তু এবার গোসলের সময় আর রক্তপাত হলো না। পরে ইমাম সাহেব বললেন, তাদের মৃত্যুটা আসলেই স্বাভাবিক নয়। যদিও মৃত্যু খোদার হাতে, যার মৃত্যু যেভাবে লেখা আছে সেভাবেই হবে। হয়তো তাদের মৃত্যু এভাবেই লেখা ছিল। এখানে বিড়ালটাকে কোনো বিশেষ কাজে ব্যবহার করা হয়েছে।
এত এত কাগজের ভিড়ে লোকটা কিছু আধপোড়া সোনালি রঙের কাগজ খুঁজে পেলো যাতে কী সব যেন লেখা। এগুলোর সন্ধানেই সে এখানে। ইমাম সাহেব বলেছেন এখানে কিছু পাওয়া যেতে পারে যা এই ধাঁধার অংক মেলাতে সাহায্য করবে। কাগজগুলো নিয়েই সে রওনা দিলো। কয়েকজনের ফোন নম্বর দিয়ে দেয় হলো। পরের সপ্তাহে সে জানালো, তার ভাই-ভাবির মৃত্যুর পেছনে হাত আছে তার ভাইয়ের বন্ধুসম এক কলিগের। যা কিছু করা হয়েছে এ বাড়ি থেকেই হয়েছে। বাড়ি যখন ফাঁকা ছিল তখন হয়েছে এ কাজ। তা আর কিছু নয়, কালোজাদু। ফাঁকা বাড়িতে গভীর রাতে তাদের ঘরেই তান্ত্রিক এনে কাজটা করা হয়েছে। আর সেই তুরুপের আগুনের আলোই ঠিক রাত দেড়টায় আমি দেখতে পেতাম। কালো জাদু প্রয়োগ করা হয়েছিল তাদেরই পোষ্য বিড়ালটির মাধ্যমে। যার কারণে বিড়ালটা সারাক্ষণ তাদের লাশের কাছে ছিল। আর আমার কাছে ছিল সে নিরুদ্দেশ।
কপিরাইট © ২০১৭ - ২০২০ ।। বইদেশ-এ প্রকাশিত কোনও সংবাদ, কলাম, তথ্য, ছবি, কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না
Design & Development by: TeamWork BD