প্রবন্ধ

বাংলার নবজাগরণ, বাঙালি সংস্কৃতির সংকটমোচন এবং নজরুল

বুধবার, ২৫ মে ২০২২ | ১০:০১ অপরাহ্ণ | 378 বার

বাংলার নবজাগরণ, বাঙালি সংস্কৃতির সংকটমোচন এবং নজরুল

।। স্বপন পাল ।।


 

প্রসঙ্গের সূত্রপাত
বাংলার নবজাগরণ তথা রেনেসাঁসের ইতিহাস যারা লিখেছেন, তাঁদের প্রতি শ্রদ্ধা রেখেই বলছি, অনেকেই তাঁদের দৃষ্টিভঙ্গিগত সীমাবদ্ধতার কারণে সেটিকে খণ্ডিতভাবে তুলে এনেছেন বলেই মনে হয়েছে। বাংলার রেনেসাঁস সম্পর্কে প্রধানত যে কথাটি বলা হয়, তা হলো বৈশিষ্ট্যগতভাবে এটি ছিল হিন্দুত্ববাদী এবং মুসলমান সম্প্রদায় এই রেনেসাঁসের বাইরে থেকে গিয়েছিল। এই ধারণাটি পুরো সত্য নয়। কিছুটা সত্য কিছুটা মিথ্যে মিশিয়ে এই ধারণাটি হয়ে উঠেছে অর্ধসত্য; আর এটা তো আমরা জানি, অর্ধ সত্য মিথ্যার চেয়েও ভয়ঙ্কর। ধনবাদী পাশ্চাত্য সভ্যতা ও সংস্কৃতির প্রভাবে উনিশ শতকের বাংলায় যে নবজাগরণ ঘটেছিল (যদিও সকল ক্ষেত্রে সমানভাবে ঘটেনি, অনেক মানুষের জীবনেই এর প্রভাব পড়েনি। উনিশ শতকের বাংলার নবজাগরণের এটি বড় সীমাবদ্ধতা।) একই সময়ে সমানভাবে তা হিন্দু ও মুসলমান সম্প্রদায়ে ক্রিয়াশীল হয়নি। জাগরণের প্রভাবের কার্যকারিতা হিন্দু সম্প্রদায়ের মধ্যে উনিশ শতকের প্রথম দিকে শুরু হলেও মুসলমান সম্প্রদায়ের মধ্যে শুরু হয় বিলম্বিত দ্বিতীয়ার্ধে। অনেকেই এটিকে আব্দুল লতিফ প্রতিষ্ঠিত ‘মোহামেডান লিটারেরি সোসাইটি’ (১৮৬৩) কিংবা মীর মশাররফ হোসেনের (১৮৪৭-১৯১১) সাহিত্যিক আত্মপ্রকাশ (১৮৬৯) থেকে মনে করেন অর্থাৎ এই দুই সম্প্রদায়ের মধ্যে জাগরণের ব্যবধান প্রায় পঞ্চাশ বছরের। বিশিষ্ট ইতিহাসবিদ এ এফ সালাউদ্দিন লিখেছেন, এই ব্যবধান ‘profundly affected the subsequent development of the two communities.’

দুই স্তরে দুই সময়ে ঘটা এই সাংস্কৃতিক জাগরণ উভয় সম্প্রদায়ের সম্পর্কের মধ্যেও একটি নাটকীয় জটিলতা তৈরি করে। উভয়ের মধ্যে শাসক হিসেবে ইংরেজদের উপস্থিতি ঘনিয়ে তুলে, ‘এগোলে সর্বনাশ পেছালে নির্বংশ’ ধরনের একটি ফাঁদ। এমন ধরনের জটিল সংকট থেকে পুরো বাঙালি জাতিকে মুক্ত করার সাংস্কৃতিক দায়িত্ব পালন করতে এসেছিলেন কাজী নজরুল ইসলাম। আমার এ মতের সাথে কারও দ্বিমত থাকতেই পারে, কিন্তু কেন বললাম কিংবা এমন একটি সিদ্ধান্তে কেন উপনীত হলাম, এর পেছনে নিশ্চয়ই যুক্তি আছে। সে নিয়েই কিছু কথা বলার চেষ্টা করছি নিম্নোক্ত আলোচনাতে।

 

অসূয়ার অন্তরাল এবং নজরুল
পাবনায় অনুষ্ঠিত কংগ্রেসের প্রাদেশিক সম্মেলনে সভাপতির অভিভাষনে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর বলেছিলেন,
‘আমরা গোড়া হইতে ইংরেজদের স্কুলে বেশি মনোযোগের সাথে পড়া মুখস্থ করিয়াছি বলিয়া গভর্নমেন্টের চাকরি ও সম্মানের ভাগ মুসলমান ভ্রাতাদের চেয়ে আমাদের অংশে বেশি পড়িয়াছে সন্দেহ নেই। এইরূপে আমাদের মধ্যে একটা পার্থক্য ঘটিয়াছে। এইটুকু কোনোমতে না মিটিয়া গেলে আমাদের ঠিক মনের মিলন হইবে না। আমাদের মাঝখানে একটা অসূয়ার অন্তরাল থাকিয়া যাইবে।’

রবীন্দ্রনাথ ঠিকই ধরতে পেরেছিলেন এবং সেই ভাষণে বলেছিলেন ‘একটা প্রকাণ্ড বিচ্ছেদের খড়গ দেশের মাথার উপর ঝুলিতেছে।’ এটা সবাই জানি যে, বাংলায় রেনেসাঁস বা নবজাগরণ শুরু হবার প্রথম দিকে হিন্দু সম্প্রদায় শিক্ষা-দীক্ষা, সমাজ সংস্কার, ধর্ম সংস্কার, সাহিত্য, সংস্কৃতি, চাকুরি, সমস্ত দিক থেকেই অনেকটা এগিয়েছিলেন। মুসলমান সম্প্রদায়ের মধ্যে নবজাগরণের এই প্রক্রিয়া একটু দেরিতে শুরু হলেও, এই সম্প্রদায় যখন এগিয়ে যেতে থাকে, তখন হিন্দু সম্প্রদায়ের একটা অংশের মধ্যে এক ধরনের স্পর্শকাতরতা তৈরি হয়। এর আঁচ রবীন্দ্রনাথের মতো মহাজনের দৃষ্টি এড়িয়ে যায়নি; তাই তিনি উপরোক্ত কথা বলেছেন এবং এমন কথা আরো অনেক লেখাতেই তিনি তুলে ধরেছেন এবং এই ‘অসূয়ার অন্তরাল’ দূর করার জন্য যথাসাধ্য চেষ্টা করেছেন। কিন্তু এটিকে ঝেটিয়ে বিদায় করার জন্য প্রয়োজন ছিল একজন ‘নজরুলের’ এবং নজরুল সেটাই করেছেন তাঁর সমস্ত সৃষ্টি ও কর্মের মধ্য দিয়ে; সবটা পেরেছেন এটা বলা না গেলেও যতোটা করে গেছেন, বাংলা সাহিত্যে এমন করে আর কেউ করেননি, করতে পারেননি। যদিও কুপমুণ্ডকরা নজরুলকে সেই স্থান দিতে রাজি নন, তাকে খণ্ড খণ্ডভাবে নানা জায়গায় নানা ভাগে বন্দী করে রাখতেই চেষ্টা চালিয়েছেন অবিরাম এবং সেটা এখনও চলমান আছে।
পরম আশাবাদী নজরুল স্বদেশের মুক্তি প্রত্যাশা করেছেন; ঔপনিবেশিক শক্তির বিরুদ্ধে সমগ্র জনগোষ্ঠীকে জাগ্রত হওয়ার আহবান জানিয়েছেন। উপনিবেশ বজায় রাখার মানসে ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদ সুচতুর কৌশলে সাম্প্রদায়িক বিভেদ সৃষ্টি করেছিল ভারতবর্ষে; ভারতের দুই বৃহৎ ধর্ম-সম্প্রদায় পরস্পর বিভেদে জড়িয়ে পড়েছে বারংবার। এর পশ্চাতে ছিল কতিপয় রাজনৈতিক দলের ইন্ধনও ছিল। এই সাম্প্রদায়িক বিভেদ নজরুলকে ব্যথিত করেছে। তাই তিনি সচেতনভাবে হিন্দু-মুসলিমের মধ্যে সম্প্রদায়-নিরপেক্ষ সম্প্রীতি প্রত্যাশা করেছেন। সত্য-সুন্দর-কল্যাণের পূজারি নজরুল চেয়েছেন সম্প্রদায়ের ঊর্ধ্বে মানুষের মুক্তি। বস্তুত, মানবতাবাদী চিন্তা তাঁর মানসলোকে সম্প্রদায়-নিরপেক্ষ মানবসত্তার জন্ম দিয়েছে। তাই আন্তঃধর্মীয় সম্প্রীতিকামী সাম্যবাদী নজরুল বলেন,
কাটায়ে উঠেছি ধর্ম-আফিম-নেশা
ধ্বংস করেছি ধর্ম-যাজকী পেশা
ভাঙি’ মন্দির, ভাঙি’ মসজিদ
ভাঙিয়া গির্জা গাহি সঙ্গীত,
এক মানবের একই রক্ত মেশা
কে শুনিবে আর ভজনালয়ের হ্রেষা।
(‘বিংশ শতাব্দী’, প্রলয় শিখা)

 

অসাম্প্রদায়িকতা ধর্মহীনতা নয়, বরং তা সকল সম্প্রদায়ের ধর্মমতকে শ্রদ্ধা করার এক পরম অভিজ্ঞান। যেহেতু বাঙালি সমাজে বিরাজমান আছে একাধিক ধর্ম, তাই এখানে পরমতসহিষ্ণুতার ধারণাটি শতাব্দী-পরম্পরায় গুরুত্ব পেয়ে আসছে। অসাম্প্রদায়িক চেতনায় প্রচলিত ধর্মের চেয়ে আরেক ধর্ম বড় হয়ে ওঠে-যার নাম মানবধর্ম বা মনুষ্যত্ববোধ। এই দার্শনিক ডিসকোর্স সম্পর্কে রবীন্দ্রনাথের ব্যাখ্যাটা স্মরণ করা যায়, ‘জলের জলত্বই হচ্ছে ধর্ম, আগুনত্বই হচ্ছে আগুনের ধর্ম। তেমনি মানুষের ধর্মটিই হচ্ছে তার অন্তরতম সত্য’। রবীন্দ্রনাথের এই অন্তরতম সত্য যে মনুষ্যত্ববোধ তথা মানবধর্ম, তা বলার অপেক্ষা রাখে না। কাজী নজরুল ইসলামের অসাম্প্রদায়িক চেতনারও মূল কথা এই মানবধর্মের বন্দনা। সকল ধর্মের প্রতিই ছিল তাঁর গভীর শ্রদ্ধাবোধ-পৃথিবীর সব ধর্মবেত্তাকেই তিনি মানবের পরম সম্পদ জ্ঞানে মান্য করেছেন- বলেছেন,
‘অবতার-পয়গম্বর কেউ বলেননি, আমি হিন্দুর জন্য এসেছি, আমি মুসলমানের জন্য এসেছি, আমি ক্রীশ্চানের জন্য এসেছি। তাঁরা বলেছেন, আমরা মানুষের জন্য এসেছি আলোর মত, সকলের জন্য।’
এর সাথে যোগ করে নজরুল বলেন,
‘আলো নিয়ে কখনও ঝগড়া করে না মানুষে।’

 

ধর্মগ্রন্থ বা উপাসনালয়ের চেয়ে তাঁর কাছে বড় হয়ে উঠেছে মানুষ-দ্বিধাহীন চিত্তে উচ্চারণ করেছেন মানববন্দনার অসামান্য এই পঙক্তিমালা:
মানুষেরে ঘৃণা করি
ও’ কারা কোরান, বেদ, বাইবেল চুম্বিছে মরি’ মরি’
ও’ মুখ হইতে কেতাব গ্রন্থ নাও জোর ক’রে কেড়ে,
যাহারা আনিল গ্রন্থ-কেতাব সেই মানুষেরে মেরে,
পূজিছে গ্রন্থ ভণ্ডের দল! মূর্খরা সব শোনো,
মানুষ এনেছে গ্রন্থ;- গ্রন্থ আনেনি মানুষ কোনো।
আদম দাউদ ঈসা মুসা ইব্রাহিম মোহাম্মদ
কৃষ্ণ বুদ্ধ নানক কবীর,-বিশ্বের সম্পদ,
আমাদেরি এঁরা পিতা-পিতামহ, এই আমাদের মাঝে
তাঁদেরি রক্ত কম-বেশী ক’রে প্রতি ধমনীতে রাজে!

কাহারে করিছ ঘৃণা তুমি ভাই, কাহারে মারিছ লাথি?
হয়ত উহারই বুকে ভগবান্ জাগিছেন দিবা-রাতি!
(‘মানুষ’, সাম্যবাদী)

 

একটি অভিভাষণে নজরুল সরাসরি বলেছেন,
‘কেউ বলেন, আমার বাণী যবন, কেউ বলেন, কাফের। আমি বলি ও দুটোর কিছুই নয়। আমি মাত্র হিন্দু-মুসলমানকে এক জায়গায় ধরে এনে হ্যান্ডশেক করাবার চেষ্টা করেছি, গালাগালিকে গলাগলিতে পরিণত করার চেষ্টা করেছি।’
নজরুল মনে করতেন, হিন্দু-মুসলমান পরস্পর একত্র হতে পারেনি বলেই ভারতবর্ষে এত দুর্গতি ছিল। হিন্দু ও মুসলমানের মধ্যে বিরোধটাকে কাজে লাগিয়ে সাম্রাজ্যবাদী শক্তি সুদীর্ঘকাল ধরে ভারতবর্ষকে শাসন ও শোষণ করে চলেছে। আর তাদের ‘divide and rule’ নীতিও অবলীলায় মেনে নিয়েছে হিন্দু কিংবা মুসলমান নেতৃত্ব এবং এর প্রভাব পড়েছে সাধারণ মানুষে উপরেও। তাই হিন্দু ও মুসলমানের পারস্পরিক মিলনের জন্য নজরুল লিখেছেন অসামান্য এই বাক্যস্রোত:
‘ভারত যে আজ পরাধীন এবং আজও যে স্বাধীনতার পথে তার যাত্রা শুরু হয়নি- শুধু আয়োজনেরই ঘটা হচ্ছে এবং ঘটাও ভাঙছে- তার একমাত্র কারণ আমাদের হিন্দু-মুসলমানের পরস্পরের প্রতি হিংসা ও অশ্রদ্ধা।’
এই যে একটা বিভেদ বা অসূয়ার অন্তরাল তৈরি হচ্ছে দুই সম্প্রদায়ের মধ্যে তা ঠিকই বুঝেছিল চতুর ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদ।এটি তাদের প্রয়োজন ছিল। তাই এ বিষয়ে রবীন্দ্রনাথ ব্রিটিশদের উপর সব দোষ চাপিয়ে দিয়েই দায় সারেননি, নিজেদের দায় হিসাবেও দেখেছেন। ১৯০৫ সালের ২৬ অক্টোবর মল্লিকবাজার ট্রাম ডিপোর কাছে ব্যারিস্টার আবদুল রসুলের সভাপতিত্বে স্বদেশী সভায় যোগদান করেন রবীন্দ্রনাথ। সভাটিতে মুলতঃ মুসলমানদের উপস্থিতিই ছিল প্রধান। সেদিনের রবীন্দ্রনাথের বক্তব্যটি ‘ব্যধি ও প্রতিকার’ প্রবন্ধে ছাপা হয়েছে। এখানে তিনি প্রধানত হিন্দু-মুসলমান বিরোধের পরিপ্রেক্ষিত নিয়ে কথা বলেছিলেন। তিনি বলেছিলেন,
‘আজ আমরা সকলেই এই কথা বলিয়া আক্ষেপ করিতেছি যে, ইংরেজ মুসলমানদিগকে গোপনে হিন্দুর বিরুদ্ধে উত্তজিত করিয়া দিয়াছে। কথাটা যদি সত্যিই হয় তবে ইংরেজদের উপর রাগ করিব কেন? দেশের মধ্যে যতগুলো সুযোগ আছে তাহা নিজের দিকে টানিবে না, এই ইংরেজকে এতোবড়ো নির্বোধ বলিয়া নিশ্চিন্ত হইয়া থাকিব এমন কি কারণ ঘটিয়াছে।
মুসলমানকে যে হিন্দুর বিরুদ্ধে লাগান যাইতে পারে এই তথ্যটাই ভাবিয়া দেখিবার বিষয়, কে লাগাইল সেটা গুরুতর বিষয় নয়। শনি তো ছিদ্র না পাইলে প্রবেশ করিতে পারে না। অতএব শনির চেয়ে ছিদ্র সম্বন্ধেই সাবধান হইতে হইবে। আমাদের মধ্যে যেখানে পাপ আছে সেখানে জোর করিবেই- আজ যদি না করে তো কাল করিবে, এক শত্রু যদি না করে তো অন্য শত্রু করিবে। অতএব শত্রুকে দোষ না দিয়া পাপকেই ধিক্কার দিতে হইবে।’
রবীন্দ্রনাথ মনে করতেন হিন্দু-মুসলমানের বিরোধ দূর হতে পারে মেলামেশা চেনাজানার মধ্যে দিয়ে। সেটাই একমাত্র পথ। বিশ্বভারতী পরিষদে ১৩৩২ সনে বক্তৃতার তিনি বলেছিলেন,
‘যে অন্ধকারে ভারতবর্ষে আমরা পরস্পরকে ভালো দেখতে পাইনে সেইটাই আমাদের সকলের চেয়ে দুর্বলতার কারণ। …ভারতবর্ষের সেই রাত্রি চিরন্তন হয়ে রয়েছে। মুসলমান বলতে কী বোঝায় তা সম্পূর্ণ করে আপনার করে অর্থাৎ রামমোহন রায় যেমন করে জানতেন, তা খুব অল্প হিন্দুই জানেন। হিন্দু বলতে কী বোঝায় তাও বড়ো করে আপনার করে, দারাশিকো একদিন যেমন করে বুঝেছিলেন, অল্প মুসলমানই জানেন। অথচ এই রকম গভীরভাবে জানার ভিতরেই পরস্পরের ভেদ ঘোচে।’
যখন মুসলমান সম্প্রদায় এগিয়ে আসতে লাগলো, ইংরেজ সরকার সেটিকে এগিয়ে নিতে যতটা সম্ভব প্রণোদনা দিয়েছিলেন, যদিও সেটা তাদের স্বার্থেই। এই এগিয়ে আসাকে হিন্দু সম্প্রদায়ের সকল শ্রেণি-পেশার মানুষও সমানভাবে নিতে পারেননি এবং এর মধ্যে দিয়ে দুই সম্প্রদায়ের মধ্যে একটা বিভেদের রেখা তৈরি তো হচ্ছিলই। এটাই প্রত্যাশিত ছিল ইংরেজদের। এর সাথে যোগ হয় অগ্রসরতার কারণে বাংলার হিন্দু সম্প্রদায়ের অনেকেরই ব্রিটিশমুক্ত ভারত প্রতিষ্ঠা করতে বিপ্লবী আন্দোলনের সাথে যুক্ত হওয়া; এটিও এক ধরনের আতঙ্কের কারণ হয়ে গিয়েছিল ব্রিটিশ শাসকদের জন্য। তাই তারা হিন্দু-মুসলমানের মধ্যে বিভেদ যথাসম্ভব বাড়ানোর কাজটি করছিল, যাতে সেই আন্দোলন শক্তিশালী না হতে পারে। রবীন্দ্রনাথ যথাসময়ে বিষয়টি ধরতে পেরেছিলেন এবং জোরালোভাবে কথাও বলেছিলেন। কিন্তু এই জায়গাটাতে এমন একজনের দরকার ছিল, যে আসবে মুসলমান সম্প্রদায়ের মধ্য থেকে এবং বাঙালি চেতনার মূল সুর ধ্বনিত হবে তার কণ্ঠে প্রবলভাবে। কারণ সেই সময় মুসলমান সম্প্রদায়ের মধ্যে নবজাগরণের চেয়ে পুনর্জাগরণের শক্তি অনেক বেশি সক্রিয় ছিল, যা এখন আবার নতুন করে শুরু হয়েছে। তাই এমন একজনের দরকার ছিল, যে শুধু ধাক্কা দিয়ে নয়, ঝড়ের বেগে এসে সব পুরনো ধ্যান-ধারণাকে তছনছ করে দিয়ে নতুন চেতনার উন্মেষ ঘটাবে। নজরুল ঠিক সেই কাজটিই করেছিলেন। যুগসঞ্চিত নানা বাধা বিপত্তি ভেঙে মুক্তির গান হয়ে এসেছিলেন যেমন মুসলমান সম্প্রদায়ের জন্য, তেমনি গোটা বাঙালি জাতির জন্য। হিন্দু-মুসলিম দুই সম্প্রদায়ের মধ্যে পুনর্জাগরণবাদের একটা টান ছিল বেশ শক্তভাবেই। তাই এর বিরুদ্ধে নজরুলকেও বলতে হয়েছিল স্পষ্ট এবং বলিষ্ট কণ্ঠে,
‘মোরা এক বৃন্তে দু’টি কুসুম হিন্দু-মুসলমান
মুসলিম তার নয়ন-মণি, হিন্দু তাহার প্রাণ
এক সে আকাশ মায়ের কোলে
যেন রবি শশী দোলে
এক রক্ত বুকের তলে, এক সে নাড়ির টান।
এক সে দেশের খাই গো হাওয়া, এক সে দেশের জল,
এক সে মায়ের বক্ষে ফলাই একই ফুল ও ফল।
এক সে দেশের মাটিতে পাই
কেউ গোরে কেউ শ্মাশানে ঠাঁই
এক ভাষাতে মা’কে ডাকি, এক সুরে গাই গান।’

 

যদিও বিদ্রোহী কবি হিসেবেই বহুল পরিচিত নজরুল। কিন্তু বলা যায়, তিনি জাগরণের প্রয়োজনেই বিদ্রোহী হয়েছেন। মূলতঃ তিনি জাগরণের কবি, রেনেসাঁসের কবি।
উত্তরাধিকারের ব্যাপকতা সম্পর্কে সচেতন নজরুল পশ্চিম-এশীয় ইতিহাস এবং ভারতীয় ঐতিহ্যে শক্তির উৎস সন্ধান করেছেন বিদ্রোহকে বাস্তব রূপ দেওয়ার প্রত্যাশায়। তাঁর এই শক্তি-সঞ্চয় কেবলই ধর্ম-ব্যবসায়ীর বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করার জন্য, অসত্য-অমঙ্গল-অকল্যাণের বিরুদ্ধে সংগ্রাম করার জন্য, স্বৈরাচারী শাসককে আঘাত করার জন্য এবং ঔপনিবেশিক শক্তির ভিতকে কাঁপিয়ে দেওয়ার জন্য। তাই মহররমের আত্মত্যাগ আর মরুভাস্কর মুহাম্মদের (সা.) বিদ্রোহ কিংবা নটরাজ শিব আর অসুরনাশিনী দুর্গার শক্তি তাঁর কবি-আত্মাকে উদ্দীপ্ত করেছে মানুষের মুক্তি কামনায়। সাম্প্রদায়িক বিভেদের বিরুদ্ধে জন্ম-বিদ্রোহী নজরুল সংগ্রাম করেছেন তাঁর সবটুকু শক্তি দিয়ে- আমৃত্যু চেয়েছেন আন্তঃধর্মীয় সম্প্রীতি-স্বপ্ন দেখেছেন একটি বৈষম্যমুক্ত সুষম সমাজের-তথা মানুষের সার্বিক মুক্তির।

 

দুই অন্দরমহলে, দুই ঐতিহ্যে সমানভাবে বিচরণ করেছেন নজরুল
নজরুল হিন্দু, মুসলমান উভয় ঐতিহ্য থেকেই কাব্যের উপাদান সংগ্রহ করেছেন, তাঁর সাহিত্যকর্ম উভয় সম্পদায়েই আদৃত হয়েছে। মোহাম্মদ মনিরুজ্জামান ‘আধুনিক বাংলা কাব্যে হিন্দু মুসলমান সম্পর্ক’ নামক গবেষণা গ্রন্থে নজরুলের কাব্য সাধনার বিশিষ্টতার কথা উল্লেখ করে বলেছেন,
‘মনে রাখা দরকার সমগ্র আধুনিক বাংলা কাব্যের ইতিহাসে কাজী নজরুল ইসলামই একমাত্র কবি, যিনি সমান দক্ষতার সঙ্গে হিন্দু মুসলমান উভয় ঐতিহ্যকে আপন কাব্যে ব্যবহার করতে সমর্থ হয়েছেন।’
নজরুলকে নিয়ে লেখা গোপাল হালদারের ইংরেজি গ্রন্থের অনুবাদক শিবপ্রসাদ সমাদ্দার লিখেছেন,
‘নজরুল আমাদের এত অল্প সময়ে এত বেশি দিয়েছিলেন যে, সেটা একটা মশালকে দুদিকে জ্বালানোর মতো। …হিন্দু ও মুসলিম ভাবধারার সমীকরণ করা; একদিকে সংস্কৃত অপরদিকে আরবী-ফার্সী সাহিত্য ও শব্দসম্ভার থেকে নিপুণ চয়ন; ভাষা ও ছন্দের উপর সহজাত কর্তৃত্ব।’

নজরুল হিন্দু মুসলিম সম্পর্কের পারস্পরিক ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়ার সংকীর্ণতা অতিক্রম করে দুই অন্দরমহলেই শুধু প্রবেশ করেননি, দুই ঐতিহ্যে সমানভাবে বিচরণও করেছেন। এটি নজরুলই একমাত্র পেরেছেন। একদিকে তিনি যেমন লিখেছেন হামদ, নাত, মর্সিয়া, গজল, তেমনি অন্যদিকে সমান তালেই রচনা করেছেন শ্যামা সংগীত, কীর্তনও।
এ প্রসঙ্গে বিশিষ্ট লেখক ও চিন্তক বিনয় সরকারের (২৬ ডিসেম্বর ১৮৮৭-২৪ নভেম্বর ১৯৪৯) বক্তব্যটি প্রণিধানযোগ্য। তিনি বলেন,
‘নজরুল একটা পন্ডিত। অবশ্য পরীক্ষায় পাশ কটা আছে জানি না। কিন্তু হিন্দু কাহিনীগুলো তার মুখস্থ আছে। কোন তথাকথিত হিন্দু কবি আরবী-ফার্সী সাহিত্যের গল্প নিয়ে কবিতা নাটক উপন্যাস লিখুক। আরবী-ফার্সী শব্দ, উপমা, অনুপ্রাস চালাতে থাকুক। তাকে কোন মুসলমান পাঠক মুসলমান বলবে কি? হিন্দুরাও তাকে মুসলমান বলবে না। বলবে লেখকটা লেখাপড়া জানে, মূখস্ত নয়। সত্যেন দত্ত আরবী-ফার্সী-চীনা মালের বেপারী ছিল। বিশ্বশক্তির সদ্ব্যবহার করতে পারে বলে তাকে আমরা সে যুগে তারিফ করেছি। আজ নজরুলকেও বিশ্বশক্তির বেপারীরূপে হিন্দু-মুসলমানের যৌথ সম্বর্ধনা করা উচিত। তাহলে বুঝবো, -বাঙালির বাচ্চারা শিখিয়ে-পড়িয়ে লোক। জ্ঞান-বিজ্ঞানের জগতে বাঙালি জাতকে ভদ্রলোকের পাতে দেওয়া যায়।’

 

পরিচয় সংকট, ভাষা এবং নজরুল
বিশিষ্ট গবেষক ও প্রাবন্ধিক শক্তিসাধন মুখোপাধ্যায় বলেছেন,
‘বাঙালি মুসলমানের আনুপূর্বিক ইতিহাস তার পরিচয় সংকটের ইতিহাস। বহকাল ধরে সে খুঁজছিল তার একটি নিজস্ব পরিচিতিপত্র। উনিশ শতকের বিলম্বিত জাগরণ তাকে আর কিছু না দিক আত্মপরিচয়ের সেই ঐতিহাসিক সংকট থেকে মুক্তির সুনির্দিষ্ট হদিশ দিয়েছে।’

 

বাঙালি মুসলমানের সামাজিক ইতিহাস আলোচনায় তাঁদের এই মানস-বৈশিষ্ট্যটিকে এড়িয়ে যাওয়ার উপায় নেই। কেননা সাংস্কৃতিক আত্মপরিচয়ের যে-সংকটে তাঁরা দীর্ঘকাল ভুগেছেন এবং এখনো কেউ কেউ ভোগেন, এটি তার সঙ্গে গভীরভাবে যুক্ত।
আমরা জানি, আমাদের দেশের কৃষিভিত্তিক আদিম কৌম সমাজের মানুষ আর্যদের দ্বারা পরাজিত হয়ে স্থান পায় বর্ণভিত্তিক শুদ্র পর্যায়ে। কিন্তু সামাজিক ন্যায়বিচার তো দূরের কথা, পাইনি একটু সুবিচারও। এরাই পরে একটু ভালো থাকার প্রত্যাশায় আশ্রয় নেয় বৌদ্ধ সম্প্রদায়ে। বৌদ্ধ ধর্মের প্রভাব শেষ হলে আশ্রয় নেয় ইসলাম ধর্মে। কিন্তু সেখানেও থেকে যায় অনেক যন্ত্রণার শিকার হয়ে। নিম্নবর্গের ব্যাপক সংখ্যক বাঙালি মুসলমান উত্তর-পশ্চিম ভারতবর্ষের উলেমা এবং লঘিষ্ঠ সংখ্যক উর্দুভাষী আশরাফ শ্রেণীর অবাঙালি মুসলমানের ধর্মীয় উপনিবেশে থেকে যায় আতরাফ শ্রেণি হিসাবে, অনেকটা অন্ধ প্রজার মতো।
কিন্তু সমস্যাটা শুরু হলো ভাষাকে কেন্দ্র করে। বাঙালি মুসলমানের ভাষা কি হবে? মধ্যযুগেও বাংলা ভাষায় সাহিত্যচর্চাকারী মুসলমান কবিদের ওপর ধর্মান্ধ, গোঁড়া, রক্ষণশীলদের আক্রোশ ছিল এবং বাংলা ভাষা ও সাহিত্যের প্রতি তাদের বিরূপতাও ছিল অত্যন্ত উগ্র। আবদুল হাকীম তাঁর ‘নূরনামা’ গ্রন্থে বাংলা ভাষা ও সাহিত্যবিরোধীদের উদ্দেশে তাই লিখেছিলেন সেই অমিয় বাণী,
যেসব বঙ্গেতে জন্মি হিংসে বঙ্গবাণী।/সেসব কাহার জন্ম নির্ণয় ন জানি/দেশি ভাষা বিদ্যা যার মনে ন জুয়ায়।/নিজ দেশ ত্যাগী কেন বিদেশে ন যায়/মাতা-পিতামহ ক্রমে বঙ্গের বসতি।/দেশি-ভাষা উপদেশ মনে হিত অতি’।
আবদুল হাকীম যাদের উদ্দেশে এই কথাগুলো বলেছিলেন, মধ্যযুগের পরেও বাঙালি মুসলমান সমাজ থেকে তাদের প্রাদুর্ভাব দূরীভূত হয়নি। আধুনিককালে এসেও আমরা দেখেছি বাঙালি মুসলমানের মাতৃভাষা উর্দু, না বাংলা-এ নিয়ে পত্র-পত্রিকায় হাস্যকর তর্কবিতর্ক।

 

আহমদ ছফা বাঙালি মুসলমানের এই ভাষা সংকটের স্বরূপটি খুব ভালোভাবেই তুলে ধরেছেন এইভাবে যে,
‘বাঙালি মুসলমানরা আরবি ফারসি উর্দু এই তিনটি ভাষায় তালিম গ্রহণ করার প্রাণান্তকর চেষ্টা করে যখন দেখলেন কোনটাই তাদের পক্ষে রপ্ত করা সম্ভব নয় তখন ওই বর্ণমালাতে বাংলা লেখার চেষ্টা করেছেন। যখন দেখা গেল আরবি হরফে বাংলা লিখে চালানো যায় না তখন বাংলা ভাষার সঙ্গে এস্তার আরবি-ফারসি শব্দ মিশেল দিয়ে কাব্য রচনা করতে আরম্ভ করলেন। আরবি ফারসি উর্দু হিন্দি মিশ্রিত একটি জগাখিচুড়ি ভাষাদর্শের মধ্যে তারা থিতু হবার চেষ্টা করেছেন। নবাবী আমলের পতন ও কোম্পানি শাসনের অভ্যূদয়ের কাল হচ্ছে এই মিশ্র ভাষারীতির বিকাশকাল’।
এটিকে আনিসুজ্জামান চিহ্নিত করেছেন ক্ষয়িষ্ণু সাংস্কৃতিক ধারার নিদর্শন হিসাবে। এই সময়ের মিশ্র ভাষারীতির পুঁথি সাহিত্যের মূল কথা ছিল নিজ ধর্মের শক্তির কাছে বহিঃশক্তির তুচ্ছতা প্রদর্শন। কাল্পনিক গৌরব বোধ এর কাছে পতিত এই কাব্যাদর্শ ছিল প্রবাহহীন।
বিষয়টি বোঝার জন্যে মফিজ উদ্দিন আহমদ রচিত ‘কেচ্ছা আলেফ লায়লা’ থেকে দুটি ছত্র নিম্নে উল্লেখ করা হলো,
ভেজ আয় রব মেরে দরুদ ছালাম
আপন পিয়ারে নবী পার ভেজ মুদাম।

 

এই ভাষাদর্শ মূলতঃ বাঙালি মুসলমানকে তার মাতৃভাষা, তার অস্তিত্বের শেকড় থেকে সরিয়ে নেবার এক অপপ্রয়াস ছিল। এমন অপপ্রয়াস আমরা পাকিস্তান আমলেও প্রত্যক্ষ করেছি। এই ভাষাদর্শে রচিত সাহিত্য একটা সময়ের জন্যে গরিষ্ঠসংখ্যক বাঙালি মুসলমানকে প্রতিক্রিয়াশীল ও পশ্চাৎপদ মানসিকতার শেকলে বেঁধে রাখার কাজটি মূলত করতে পেরেছিল।
আনিসুজ্জামান এটিকে বলেছেন,
‘সব মিলিয়ে মনে হয় যে ইংরেজ শাসনের প্রথম একশ বছর বাঙালি মুসলমানের এক মানসিক অবসাদের যুগ।’
অনেক গবেষক অভিমত দিয়েছেন যে, এই অবস্থা থেকে মুক্তি ঘটেছিল উনিশ শতকের দ্বিতীর্যাধে মীর মোশারফ হোসেনের সাহিত্যিক হিসেবে আত্মপ্রকাশ এর মাধ্যমে। তবে বাংলা যে শেষ পর্যন্ত জগাখিচুড়ি ও পশ্চাদমুখী জীবনাদর্শে নিমজ্জিত বাঙালি মুসলমানকে অগ্রগামী জীবনাদর্শে পৌঁছানোর কাজ করেছিল, তার মূলে নজরুলের অবদান ছিল অনস্বীকার্য। নজরুল মুসলমান সম্প্রদায়কে বাঙালি সমাজেরই একটি অংশ হিসেবে প্রমাণ করেছেন। বুঝিয়ে দিয়েছেন- ‘আমরা বাঙালি। বাংলা ভাষায় আমাদেরও অধিকার সমান।’ এই একটি কারণে হলেও বাঙালি মুসলমান সমাজ নজরুলের কাছে ঋণী, নজরুল তাদের ভাষায় দীন পরিচয় ঘুচিয়ে তাদের সামাজিক ভাষাকে সাহিত্য সৃষ্টির ভাষা হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করেছেন। নজরুল কাব্য ও গদ্যে মুসলমানদের ঘরসংসারে ব্যবহৃত শব্দসমূহ ব্যবহার করে এমন একটা প্রক্রিয়ার সূচনা করেছেন, যার ফলে বাংলা ভাষার ‘অভিধান’ সংকলকদের নতুন সংস্করণে নতুন নতুন শব্দ-সংযোজনের একটা বাধ্যবাধকতা সৃষ্টি হয়েছে। এটা বাংলা ভাষায় নজরুল ইসলামের অন্যতম কৃতিত্বও।
উনিশ শতকে বাঙালি মুসলমানের সামনে দুটো পথ ছিল; একদিকে রিভাইভ্যালিজম বা পুনর্জাগরণবাদ আর অন্যদিকে ছিল রেনেসাঁস বা নবজাগরণ, -যার মূল কথা ছিল ঐতিহ্যকে গ্রহণ করতে হবে যুক্তি ও মানবতার কষ্টি পাথরে ঘষে ঘষে এবং তার সঙ্গে মেলবন্ধন ঘটাতে হবে আধুনিক ও যুগোপযোগী চিন্তা-চেতনার। এই সময়ই রেনেসাঁসের ধারক ও বাহক হয়ে আবির্ভূত হয়েছিলেন কাজী নজরুল ইসলাম।

 

মুসলমান সম্প্রদায়ের মধ্যে রিভাইভ্যালিজম বা পুনর্জাগরণের ধারা একসময় শক্তিশালী হয়ে উঠেছিল, -যার পরিণতিতে হয়েছিল পাকিস্তান। এই রিভাইভ্যালিজম বা পুনর্জাগরণবাদ আর রেনেসাঁস বা নবজাগরণ এর মধ্য দ্বন্দ্ব চলমান ছিল এবং একাত্তরের এসে জয়ী হয় রেনেসাঁস। অর্থাৎ নজরুল যে পথ দেখিয়ে গিয়েছিলেন, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবের নেতৃত্ব সেই পথেই সাফল্যের জায়গায় নিয়ে গিয়েছিলেন এই ভূখণ্ডের মানুষকে, জন্ম হয়েছিল স্বাধীন বাংলাদেশের এবং সংবিধানে যুক্ত হতে পেরেছিল ধর্মনিরপেক্ষতা, গণতন্ত্র, সমাজতন্ত্র, জাতীয়তাবাদ।
বাঙালি মুসলমানের জীবনে নজরুল ‘নির্ঝরের স্বপ্নভঙ্গ’। রবীন্দ্রনাথ নজরুলের আগমনকে স্বাগত জানিয়েছিলেন বিপুলভাবে এবং স্মরণ করিয়ে দিয়েছিলেন ইতিহাসের নির্ধারিত দায়িত্বের কথা, -ধুমকেতু পত্রিকায় আশীর্বাণীতে লিখেছিলেন,
‘দুর্দিনের এই দুর্গশিরে
উড়িয়ে দে তোর বিজয়-কেতন।…
জাগিয়ে দে রে চমক মেরে
আছে যারা অর্ধচেতন।

 

সন্ধ্যাকাব্য’র ‘বাংলার আজিজ’ কবিতায় নজরুল লিখেছেন,
‘পোহায়নি রাত, আজান তখনো দেয়নি মুয়াজ্জিন,
মুসলমানের রাত্রি তখন আর সকলের দিন।
অঘোর ঘুমে ঘুমায় যখন বঙ্গ মুসলমান…।’
এমন অবস্থায়ই নজরুল জাগরণের বাণী নিয়ে এসেছিলেন। সেই সময়ে তাঁকে দেওয়া এক সংবর্ধনাপত্রে লেখা হয়,
‘তুমি বাংলার মধুবনে শ্যাম কোয়েলার কন্ঠে গুলবাগিচার বুলবুলে বুলি দিয়েছ, রসালের কণ্ঠে সহকার সাথে আঙুর লতিকার বাহুবন্ধন রচনা করিয়াছ। তুমি বাঙালির শ্যাম শান্ত কণ্ঠে ইরানি সাকীর লাল শিবাজীর আবেশ বিহ্বলতা দান করিয়াছ।’

 

বাংলা সাহিত্যে ও সংস্কৃতিতে পরিপূর্ণ একটি জীবনবাদের ধারা যুক্ত করেন নজরুল
ইতালির রেনেসাঁস ছিল মধ্যযুগীয় চার্চতন্ত্রের বিশুষ্কতা থেকে জীবনের উদ্ধারের পথ। লিওনার্দো দা ভিঞ্চি, জর্জিনো, রাফায়েল টিশিয়ান প্রমুখ শিল্পীদের কর্মের দিকে তাকালে বোঝা যায়, পরিপূর্ণ জীবনবাদ ও সৌন্দর্যের চোখ দিয়ে তারা জীবনকে দেখেছিলেন। রবীন্দ্র-পরবর্তী বাংলা সাহিত্যে ও সংস্কৃতিতে এমন পরিপূর্ণ একটি জীবনবাদের ধারা যুক্ত করেন নজরুল।
সেই সময়ে মুসলমান সম্প্রদায়ের মধ্যেও নানা চিন্তা কাজ করছিল। অনেকেই নবাব জমিদার ইংরেজদের কাছ থেকে যতোটা সম্ভব সুবিধা নেওয়া যায়, এমন মনোভাব নিয়ে এগিয়ে এসেছিলেন; কারণ হিন্দু সম্প্রদায়ের মধ্যেও এমন একটি ধারা ভালোভাবে সক্রিয় ছিল। এই বিষয়টি আনিসুজ্জামান দেখেছেন এভাবে,
‘আধুনিক সমাজ আন্দোলনের আরেক দিকে ছিল ইংরেজ শাসনের সঙ্গে আপোষের এবং হিন্দু … স্বাতন্ত্র্যের উপর গুরুত্ব আরোপের চেষ্টা। … দু-একজন ব্যতিক্রম ছাড়া সকল লেখকই ইংরেজ শাসকদের প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করেছেন এবং তাদের পক্ষপুটে প্রসারিত অধিকার লাভ করার স্বপ্ন দেখেছেন। তবে বাস্তব জীবনের সংঘাতে ইংরেজ শাসন সম্পর্কে সমালোচনার মনোভাব ধীরে ধীরে প্রবেশ করছিল। এর আকস্মিক বিস্ফোরণ দেখা যায় নজরুল ইসলামের রচনায়।’

 

নজরুল লিখেন,
‘কারার ঐ লৌহ কপাট
ভেঙ্গে ফেল কর রে লোপাট।’ -যা ছিল পরাধীনতার বিরুদ্ধে সরাসরি প্রতিবাদ। ব্রিটিশ সরকার তাঁকে কারারুদ্ধ করেছিল, বাজেয়াপ্ত করেছিল একটি গদ্য গ্রন্থ ও চারটি কাব্যগ্রন্থ। এতেই বুঝা যায়, সেই সময়ে মুসলমান সম্প্রদায় তো বটেই বাঙালি জাতির মধ্যে জেগে উঠায় যে দোদুল্যমানতা কাজ করেছিল, নজরুলের সজোর ধাক্কায় তা অনেকটাই দূর হয়ে গিয়েছিল।
বাংলার প্রথমার্ধের জাগরণে রামমোহন রায়, ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর, ইয়ং বেঙ্গল গ্রুপ মধ্যযুগীয় জড়ত্ব, মৃত ধর্মীয় অনুশাসন তথা কায়েমী কানুন ও ব্যবস্থার সমালোচনা করেছেন তীব্রভাবে এবং অনেক ব্যবস্থা বদলে দিয়ে নতুন ব্যবস্থা চালু করেছেন। এঁদের অধিকাংশ কাজের ক্ষেত্র ছিল হিন্দু রিভাইভালিজম-এর বিরুদ্ধে।
পরবর্তী পর্যায়ে অর্থাৎ বিলম্বিত নবজাগরণের সময় নজরুল হিন্দু মুসলমান উভয় সম্প্রদায়ের রিভাইভালিস্ট বা পুনর্জাগরণবাদীদের বিরুদ্ধে কথা বলেছেন একজন মানবতাবাদীর দৃষ্টিতে। হিন্দু মুসলমান প্রবন্ধে তিনি লিখেন,
‘হিন্দুত্ব মুসলমানত্ব দুই সওয়া যায় কিন্তু তাদের টিকিত্ব দাড়িত্ব অসহ্য, কেননা দুটোই মারামারি বাধায়। টিকিত্ব তো হিন্দুত্ব নয়, ওটা হয়তো প-িত্ব। তেমনি দাড়িত্ব ইসলামত্ব নয়, ওটা মোল্লাত্ব। এই দুই ‘ত্ব’-মার্কা চুলের গোছা নিয়ে এত চুলোচুলি’।
এর সাথে মুসলমান তরুণ সমাজকে এও তিনি স্মরণ করিয়ে দিয়েছেন,
‘আজ বাঙালি মুসলমানদের মধ্যে একজনও চিত্র-শিল্পী নাই, ভাস্কর নাই, সঙ্গীতজ্ঞ নাই, বৈজ্ঞানিক নাই, ইহা অপেক্ষা লজ্জার আর কি আছে? এই সবে যাহারা জন্মগত প্রেরণা লইয়া আসিয়াছিল, আমাদের গোঁড়া সমাজ তাহাদের টুঁটি টিপিয়া মারিয়া ফেলিয়াছে ও ফেলিতেছে। এই অত্যাচারের বিরুদ্ধে আমাদের সমস্ত শক্তি লইয়া যুঝিতে হইবে। নতুবা আর্টে বাঙালি মুসলমানদের দান বলিয়া কোনো কিছু থাকিবে না। পশুর মতো সংখ্যাগরিষ্ঠ হইয়া বাঁচিয়া আমাদের লাভ কি, যদি আমাদের গৌরব করিবার কিছুই না থাকে। ভিতরের দিকে আমরা যত মরিতেছি, বাহিরের দিকে তত সংখ্যায় বাড়িয়া চলিতেছি। এক মাঠ আগাছা অপেক্ষা একটি মহীরুহ অনেক বড়-শ্রেষ্ঠ’।
নজরুল তাঁর মসীকে অসীতে পরিণত করেছিলেন। ব্যঙ্গ-বিদ্রুপ, জ্বালাময়ী কবিতায়-কথায় তিনি সকল অসুন্দরকে আক্রমণ করেছেন। নজরুল যেমন আক্রমণ করেছিলেন সমাজের প্রতিক্রিয়াশীলতাকে, সাম্প্রদায়িকতাকে তেমনি ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক শাসন শোষণের বিরুদ্ধে তার আক্রমণ ছিল সমান তেজে। তাই তাঁকে দু’দিক থেকেই প্রবল বিরোধিতার মুখোমুখি হতে হয়েছে। তাঁকে যেমন ‘শয়তান’, ‘কাফের’ অভিধা দেওয়া হয়েছে, ব্রিটিশ সরকারও হেনস্থা কম করেনি। যা পূর্বেই উল্লেখ করা হয়েছে।

 

বাংলার রেনেসাঁস এবং নারী-মুক্তির প্রশ্ন
নজরুলের কবিতার এই লাইন দু’টি অনেক বেশি পরিচিত-
‘এ পৃথিবীতে যা কিছু সৃষ্টি চির কল্যাণকর
অর্ধেক তার করিয়াছে নারী অর্ধেক তার নর।’
কিন্তু নজরুল এটিও লিখেছেন,
‘আজও রবি শশী ওঠে ফুল ফোটে নারীদের কল্যাণে
নামে সখা ও সাম্য শান্তি নারীর প্রেমের টানে
নারীর পুণ্য প্রেম আনন্দ রূপ রস সৌরভ
আজও সুন্দর করিয়া রেখেছে বিধাতার গৌরব।’
(নারী, সাম্যবাদী, ১৯২৫)

 

প্রখ্যাত ইতিহাসবিদ বুর্খহাউট লিখেছেন, ‘ইতালীয় রেনেসাঁসে নারী পেয়ে পুরুষের সমকক্ষ মর্যাদা।’ যদিও এ নিয়ে ভিন্নমত আছে। এখনো সারা পৃথিবীজুড়ে নারীকে সমতা এবং ন্যায্যতার জন্যে লড়তে হচ্ছে। প্রশ্নটি সার্বিকভাবে সমাজ বদলের লড়াইয়ের সাথে জড়িত। তবে সার্বিকভাবে ইতালীয় রেনেসাঁস মুক্তির যে বার্তা নিয়ে এসেছিল, তা নারীর জীবনেও এনেছিল এক অভূতপূর্ব পরিবর্তন। বাংলায় রেনেসাঁস-এর শুরুতেও ক্ষণজন্মা যুগমানুষ ডিরোজিও তাঁর ‘দি ফকির অব জঙ্গিরা’ কাব্য লিখেছিলেন, ‘নারী অপরের খেলনামাত্র নয়।’ রামমোহন, বিদ্যাসাগর, রবীন্দ্রনাথ, শরৎচন্দ্র পর্যন্ত প্রথমার্ধেও গোটা রেনেসাঁসের যুগে চলেছিল সামাজিক অনুশাসন, শোষণ, নিষ্পেষণের হাত থেকে নারীর অধিকার ও মর্যাদা প্রতিষ্ঠায় ধারাবাহিক সংগ্রাম। নারীর এই দুঃসহ নীপিড়ন ও লাঞ্ছনার বিরুদ্ধে এক দূঃসাহসিক সংগ্রামে ব্রতী হয়েছিলেন বেগম রোকেয়া সাখাওয়াত হোসেন। বাংলার রেনেসাঁসে এটি এক অমূল্য এবং যুগান্তকারী সংযুক্তি। অথচ কেউ কেউ এটিকেও পাশ কাটিয়ে যেতে চান।

 

১৯৩২ খ্রিস্টাব্দের ৫ ও ৬ নভেম্বর সিরাজগঞ্জের নাট্যভবনে অনুষ্ঠিত বঙ্গীয় মুসলিম তরুণ সম্মেলনের সভাপতি হিসেবে এক অভিভাষণে নজরুল বলেছিলেন,
‘কন্যাকে পুত্রের মতোই শিক্ষা দেওয়া যে আমাদের ধর্মের আদেশ, তাহা মনেও করিতে পারি না। আমাদের কন্যা-জায়া-জননীদের শুধু অবরোধের অন্ধকারে রাখিয়াই ক্ষান্ত হই নাই, অশিক্ষার গভীরতর কূপে ফেলিয়া হতভাগিনীদের চির-বন্দিনী করিয়া রাখিয়াছি। আমাদের শত শত বর্ষের এ অত্যাচারে ইহাদের দেহ-মন এমনি পঙ্গু হইয়া গিয়াছে যে, ছাড়িয়া দিলে ইহারাই সর্বপ্রথম বাহিরে আসিতে আপত্তি করিবে। ইহাদের কী দুঃখ কিসের যে অভাব তাহা চিন্তা করিবার শক্তি পর্যন্ত ইহাদের উঠিয়া গিয়াছে। আমরা মুসলমান বলিয়া ফখর করি, অথচ জানি না সর্বপ্রথম মুসলমান নর নহে-নারী।
বৃদ্ধদের আয়ুর পুঁজি ত ফুরাইয়া আসিল, এখন আমাদের- তরুণদের সাধনা হউক আমাদের এই চির-বন্দিনী মাতা-ভগ্নিদের উদ্ধার সাধন। জন্ম হইতে দাঁড়ে বসিয়া যে পাখি দুধ-ছোলা খাইয়াছে, সে ভুলিয়া গিয়াছে যে, সেও উড়িতে পারে। বাহিরে তাহারই স্বজাতি পাখিকে উড়িতে দেখিয়া অন্য কোনো জীব বলিয়া ভ্রম হয়। এই পিঞ্জরের পাখির দ্বার মুক্ত করিয়া দিতে হইবে। খোদার দান এই আলো-বাতাস হইতে তাহাদিগকে বঞ্চিত করিবার অধিকার কাহারও নাই। খোদার রাজ্যে পুরুষ আজ জালিম, নারী আজ মজলুম। ইহাদেরই ফরিয়াদে আমাদের এই দুর্দশা, আমাদের মতো হীনবীর্য সন্তানের জন্ম’।

 

রেনেসাঁস হচ্ছে discovery of man I discovery of the world
রেনেসাঁসের পূর্বে ইউরোপে মানুষ বলতে বোঝাত একজন খ্রিস্টানকে। রেনেসাঁসের মধ্য দিয়ে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে মানবতাবাদ। বাংলায় রামমোহনকে মনে করা হয় এর উদগাতা এবং তা রবীন্দ্রনাথ হয়ে নজরুলে এসে একটা পূর্ণতা লাভ করেছিল। নজরুলের সাহিত্য সাধনায় ফুঁটে উঠেছিল সমস্ত রকমের ধর্ম বর্ণ পরিচয়ের উর্ধ্বে মানবতাবাদীর রূপটি।
এটা সত্যি যে, রেনেসাঁস মানুষকে নিখিল বিশ্বের অধিবাসী করে দেয়। এর মধ্য দিয়ে জাতি ধর্ম দেশ পরিচয়ের গণ্ডি পেরিয়ে মানুষ হতে চেয়েছে ‘ইউনিভার্সাল ম্যান’-বিশ্ব মানব। প্রিন্স অব হিউম্যানিটিস খ্যাত এরাজমুজ সম্পর্কে বলা হয়, he belonged to no nation’। রামমোহন থেকে রবীন্দ্রনাথ এমন অনেকের মধ্যেই ছিল বৈশ্বিক মানুষ হবার তীব্র আকুতি। রবীন্দ্রনাথ তো তাঁর ‘নো-নেশন’ নিয়ে অনেক কথাই বলেছেন। নজরুলও ছিলেন সেই পথেরই মানুষ। তাঁর মধ্যেও বৈশ্বিকতার আহ্বান ছিল ভালোভাবেই। মানসিকভাবে এমন একটি পর্যায়ে তিনি নিজেকে উন্নত করতে পেরেছিলেন,
‘যেখানে আসিয়া এক হয়ে গেছে সব বাধা ব্যবধান
যেখানে মিশেছে হিন্দু বৌদ্ধ মুসলিম ক্রীশ্চান’। (সাম্যবাদী, ১৯২৫)

 

মানুষের হৃদয়-ধর্মকে তিনি দিয়েছেন অনেক উঁচু স্থান। তাইতো তিনি বলতে পেরেছেন, ‘হৃদয়ের চেয়ে বড় কোন মন্দির-কাবা নাই’ এবং মানুষকে তিনি দেখেছেন সবচেয়ে বড় করে, মানুষ ছিল তার কাছে শ্রেষ্ঠ। উদাত্ত কণ্ঠে বলেছেন,
‘মানুষের চেয়ে বড় কিছু নাই নহে কিছু মহীয়ান।’ রেনেসাঁস হচ্ছে discovery of man I discovery of the world। রেনেসাঁসের কবি ছাড়া আর কে বলতে পারবে
‘পাতাল ফেঁড়ে নামব নীচে,
উঠব আমি আকাশ ফুঁড়ে,
বিশ্ব জগৎ দেখব আমি
আপন হাতের মুঠোয় পুরে।’
অথবা,
‘মহাবিশ্বের মহাকাশ ফাড়ি
চন্দ্রসূর্য্য গ্রহ তারা ছাড়ি
ভূলোক দ্যুলোক গোলক ভেদিয়া
খোদার আসন আরশ ছেদিয়া
উঠিয়াছি চির-বিস্ময় আমি বিশ্ববিধাতৃর’।

 

বাঙালি সংস্কৃতির সংকট মোচনে নজরুল
সমকাল কিন্তু যথাযথভাবেই চিনেছিল নজরুলকে। বাংলার মুসলিম জাগরণের মধ্যে পুনর্জাগরণ এবং নবজাগরণের যে দুটি ধারা সক্রিয় ছিল, সে সময় নজরুলের উপস্থিতি ও সক্রিয়তা কোন পক্ষেরই নজর এড়িয়ে যায়নি। সেই সময়ের পত্রিকার পৃষ্ঠা থেকে উভয়পক্ষের নজরুল মূল্যায়ন তুলে ধরলেই সেটা আরো ভালোভাবে বোঝা যাবে। ‘ইসলাম দর্শন’ পত্রিকা তাঁর সম্পর্কে লিখেছিল,
‘এই উদ্দাম যুবক যে ইসলামী শিক্ষা আদৌ পায় নাই, তাহা ইহার লেখার পত্রে পত্রে ছত্রে ছত্রে প্রকাশ পাইতেছে। হিন্দুয়ানী মাদ্দায় ইহার মস্তিষ্ক পরিপূর্ণ। হতভাগা যুবকটি ধর্মজ্ঞান সম্পন্ন মুসলমানের সংসর্গ কখনো লাভ করে নাই, অন্ততঃ সেটুকু লাভ করিলেও পবিত্র ইসলাম ধর্মের বিরুদ্ধে স্বীয় পৈশাচিক খড়গ উত্তোলন করিত না। থাকুক তাহার লেখায় যথেষ্ট শক্তি, হউক সে বিখ্যাত কবি, তজ্জন্য মুসলমানের গৌরব করিবার কিছু নাই’।

 

অন্যদিকে যারা নজরুলের আগমনকে স্বাগত জানিয়েছিল, সেই তরুণ মুসলমান সম্প্রদায়ের পত্রিকা মোয়াজ্জিন-এ লেখা হয়ে,-
‘কবি নজরুলের পূর্ব্বে বঙ্গ-মোসলেম সমাজে কাব্য-সাহিত্যিকের অভাব অনুভব হইতেছিল; কিন্তু আজ এ সমাজ একজন মুসলমান কাব্য-সাহিত্যেকের অপূর্ব সৃষ্টি সম্পদের মহান দানে বঙ্গসাহিত্যের আসর গৌরবান্বিত হইয়াছে দেখিয়া বুক ভরা তৃপ্তি অনুভব করত ক্রমশ প্রাণবন্ত হইয়া উঠিতেছে। ‘বিষের বাঁশি’র বাদক এই কবি মরণোন্মুুখ মোসলেমের-শুধু মোসলেমের নয় অমোসলেমেরও প্রাণে এক অভিনব স্পন্দন আনিয়া দিয়াছে। তাঁহার রচনা বৈশিষ্ট্য, ছন্দ নৈপুণ্য, শব্দায়ন চাতুর্য্য, উদ্দাম উদ্দীপনায় বিচ্ছুরিত বহ্নিশিখা বঙ্গসাহিত্যে নবযুগ আনয়ন করিয়াছে। আর মুসলমান আজ তাহার একজন ভাইকে বঙ্গসাহিত্যের সুউচ্চ আসনে সমাসীন দেখিয়া জাতীয় অস্তিত্ব উপলব্ধি করিতেছে’।
বাংলা সাহিত্যে নজরুলের সুউচ্চ আসন দেখে যে মুসলমান সম্প্রদায় জাতীয় অস্তিত্ব উপলব্ধি করেছিল, তারাই একদিন সত্যিকার যুদ্ধ পেরিয়ে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবের নেতৃত্বে প্রতিষ্ঠিত করেছেন স্বাধীন বাংলাদেশ।

 

এই আলোচনায় অনেকের কখনও কখনও মনে হতে পারে যে নজরুলকে মুসলমান সম্প্রদায়ের জাগরণের কবি হিসেবে চিহ্নিত করার একটা প্রবণতা আছে। কিন্তু তেমনটি মনে করা হলে আমার প্রয়াস সম্পূর্ণ বিফলে যাবে। কারণ আমি চেষ্টা করেছি সেই সময়ের বাঙালি সংস্কৃতির মূল সংকটটি তুলে ধরে সেখানে নজরুলের ভূমিকা নির্ধারণের। সে সময়ে শিক্ষায়-দীক্ষায় পিছিয়ে-পড়া মুসলমান সম্প্রদায়ের মধ্যে বিভাজনের একটা ধারা খুব বেশি সক্রিয় ছিল, যা মুসলমান সম্প্রদায়কে আরও পিছনের দিকে টেনে নিয়ে যাচ্ছিল। তাই নজরুলের উপর একটি বড় দায় এসে পড়েছিল মুসলমান সম্প্রদায়কে সামনে নিয়ে আসার পাশাপাশি বাঙালি সংস্কৃতির সংকট মুক্তির দায় এবং সেজন্য দরকার ছিল মুসলমান সম্প্রদায়ের কেউ একজনের। নজরুল সেই দায়মুক্তির কাজটি করেছিলেন, বলতে পেরেছিলেন,-
‘অসহায় জাতি মরিছে ডুবিয়া জানে না সন্তরণ
কা-ারী! আজ দেখিব তোমার মাতৃমুক্তিপণ!
‘হিন্দু না ওরা মুসলিম?’ এই জিজ্ঞাসে কোন জন?
কাণ্ডারি! বল, ডুবিছে মানুষ, সন্তান মোর মার’।

 

রিভাইভালিজমের কবি হলে তিনি হয়ে থাকতেন শুধুমাত্র একটি ধর্মীয় সম্প্রদায়ের কবি। নজরুল রেনেসাঁসের কবি,-নবজাগরণের কবি। তাই তিনি হতে পেরেছিলেন বাঙালির কবি তথা মানবতার কবি। পুনর্জাগরণবাদ হিন্দু-মুসলিম দুই সম্প্রদায়কেই টান দিয়েছিল বিপরীত দিকে, -পেছন দিকে; আর রেনেসাঁসের বা নবজাগরণের প্রগতিশীল ধারা দুই সম্প্রদায়কে একই মানবিক বলয়ে উত্তীর্ণ করে দিতে চেয়েছে। নজরুল সেই চাওয়াকে যথার্থভাবেই উদ্ভাসিত করেছেন তাঁর সৃষ্টির উজ্জ্বলতায়।

Facebook Comments Box

কপিরাইট © ২০১৭ - ২০২০ ।। বইদেশ-এ প্রকাশিত কোনও সংবাদ, কলাম, তথ্য, ছবি, কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না

Design & Development by: TeamWork BD