।। নিঝুম ভূঁইয়া ।।
সিমিন আমার স্ত্রী। গতরাতে আত্মহত্যা করেছে। সিমিনের বাবা-মা আমার বিরুদ্ধে মামলা করেছে। আমিই নাকি সিমিনকে মেরে ফেলেছি। তাই পুলিশ আমাকে অ্যারেস্ট করেছে। আমি এখন লকআপে। একমাত্র মেয়ের এমন অকালে চলে যাওয়াটা কোনো বাবা-মাই মেনে নিতে পারে না। তাই তাঁদের মামলা করাটাই স্বাভাবিক।
সিমিনের সাথে আমার বিয়ে হয় এক বছর আগে।পারিবারিকভাবেই বিয়েটা হয়েছিল। সিমিনকে প্রথম যেদিন দেখেছিলাম সেদিনই ওকে ভালো লেগে গিয়েছিল আমার। অত্যন্ত শান্ত, স্নিগ্ধ দু’টো চোখে কী এক অদ্ভুত মায়ায় সেদিনই আমাকে বেঁধে ফেলল।
আমাদের বিয়ে হয়ে গেল। বাসর রাতে সিমিন আমাকে বলল ওর অতীত জীবনের কথা।
‘আমি তন্ময়কে ভালোবাসতাম। এত বেশি ভালোবাসতাম যে ওকে ছাড়া একটা মুহুর্তও কল্পনা করতে পারতাম না। তন্ময় যা বলতো আমি অন্ধের মতো সেটাই বিশ্বাস করতাম। একটা সময় আমি গর্ভবতী হয়ে পড়লাম। তন্ময়কে সব জানালাম। সে বলল এখন সে আমাকে বিয়ে করতে পারবে না। তার ক্যারিয়ার আগে। আমি যেন অ্যাবরশন করে ফেলি। আমি তাই করলাম। এছাড়া আমার আর কোনো উপায় ছিল না। আমি কিছুতেই আমার সন্তানকে মেরে ফেলতে চাইনি। কিন্তু আমি বাধ্য হলাম।
তন্ময় পরে আমার সাথে যোগাযোগ করা বন্ধ করে দিলো। একটা সময় ও বিদেশে চলে গেল। আমি চরমভাবে ঠকে গেলাম।’
আমি হতবাক হয়ে সিমিনের কথাগুলো শুনলাম। বাসর রাতে কোথায় নববধুর হাত ধরে নিজের স্বপ্নের কথা বলবো। অথচ আমি এসব কী শুনছি বুঝতে পারছিলাম না।
সিমিন কাঁদছে খুব। আমার কেমন মায়া হচ্ছে সিমিনের জন্য। এতে ওর তো কোনো দোষ নেই। চরমভাবে ঠকে গেছে মেয়েটা।
সিমিন কাঁদতে কাঁদতেই বলল, ‘আমাকে ক্ষমা করবেন। এই বিয়েটা আমি করতে চাইনি। বাবা-মা জোর করে দিয়েছে। আর আপনাকে বিয়ের আগে এসব কথা বলার কোনো সুযোগই পাইনি। মা সব জানতো। তাই আমার কাছ থেকে আমার ফোন কেড়ে নিয়েছিল। আমার বাইরে যাওয়াও বন্ধ করে দিয়েছিল।’
‘সিমিন যা হয়েছে সব ভুলে যাও। আবার নতুন করে সব শুরু করো।’ বলেই আমি রুমের বাইরে চলে এলাম। সিমিনকে একটু একা থাকতে দেওয়া দরকার। আমার কেমন অবসন্ন লাগছে। বুঝতে পারছি না আমি কী করবো। এক বুক স্বপ্ন নিয়ে যে মেয়ের জন্য আমি বসে আছি সে এগুলো কী শোনাচ্ছে আমাকে! আবার এটাও তো ঠিক না যে একজন মানুষের অতীতের কোনো ঘটনার জন্য তার সমস্ত জীবন নষ্ট হয়ে যাবে। আমি সিদ্ধান্ত নিলাম সিমিনকে আমি এই কষ্ট থেকে বের করে আনব।
এভাবেই দিন যেতে থাকে। কিন্তু সিমিন কিছুতেই স্বাভাবিক হয় না। ধীরে ধীরে যেন আরও নিজের ভেতর ডুবে যেতে থাকে। মাঝে মাঝে দেখি ডায়েরিতে কী যেন লেখে।
একদিন অফিস থেকে ফিরে দেখি সিমিন বারান্দায় দাঁড়িয়ে শূন্য হাত কোলে নিয়ে গান গাইছে।
‘কী করছো সিমিন?’
‘আস্তে, দেখছো না বাবুকে ঘুম পাড়াচ্ছি?’
‘বাবু কোথায়?’
‘এই যে আমার কোলে।’
সিমিন আবার গান গেয়ে বাবুকে ঘুম পাড়াতে ব্যস্ত হয়ে পড়ল।
আমার বুক থেকে একটা দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে এলো। সোফায় বসে চোখ বন্ধ করলাম।
আরেকদিন বাসায় গিয়ে দেখি একটা দোলনা। সিমিন দোলনা দুলিয়ে দুলিয়ে গান গাইছে। বাসায় কত রকমের বাচ্চাদের জামা কাপড়, জুতা খেলনা। সব মেয়ে শিশুদের। আহারে! বাচ্চাটা বুঝি মেয়ে ছিল। কে জানে।
‘সিমিন চলো আমরা একটা বাচ্চা নিয়ে নেই। তোমার সময় কাটবে।’
সিমিন তড়াক করে আমার দিকে তাকালো।
‘আমাদের তো মেয়ে আছে। এই যে দেখো।’ শূন্য দোলনাটা দেখালো।
আমি কী বলবো বুঝতে পারছি না। কেন যেন সিমিনের উপর আমি রাগ করতে পারি না। একটা অদ্ভুত মায়ার ক্ষমতা ওর মাঝে।
সিমিন আর আমি এখানে একাই থাকি। একটা ছুটা মেয়ে এসে সব কাজ করে দিয়ে যায়। সিমিনের সংসারের প্রতি একেবারেই মনোযোগ নেই। সবসময় কেমন একটা ঘোরের মধ্যে থাকে।
একরাতে ঘুম ভেঙে শুনি সিমিন কার সাথে যেন কথা বলছে। আমি চুপচাপ শুনি।
‘তন্ময়, তুমি আমার সাথে এমন করলে কেন? কেন এভাবে আমাকে ঠকালে? আমার বাচ্চাকে আমি মেরে ফেলেছি। কিন্তু আমি ওকে মারতে চাইনি।’ সিমিন ফুপিয়ে ফুপিয়ে কাঁদছে।
আমার কেমন কষ্ট লাগছে সিমিনের জন্য। সিমিন ওর অতীত ভুলতে পারছে না। আমি সিমিনকে বুকের মধ্যে জড়িয়ে নেওয়ার চেষ্টা করলাম। সিমিন নিজেকে ছাড়িয়ে নিয়ে অন্য পাশ ফিরলো।
আমি সিদ্ধান্ত নিলাম সিমিনকে নিয়ে কোথাও ঘুরে আসব। তাতে যদি ওর মনের পরিবর্তন হয়।
সিমিনকে নিয়ে বিভিন্ন জায়গায় ঘুরতে গেলাম। কিন্তু কোনো লাভ হলো না। সিমিন নিজের মধ্যেই ডুবে থাকে। বাচ্চা হারানোর কষ্টে নিজেকে কিছুতেই ক্ষমা করতে পারে না সে।
ইদানিং কেমন আমাকেও সহ্য করতে পারে না। বিরক্ত হয়। অকারণে চিৎকার চেঁচামেচি করে।
সিমিন ওর মা-বাবাকে পছন্দ করে না। তাই তাঁরা আমাদের বাসায় আসেন না। সিমিনই না করেছে। আমি ভাবছি সিমিনকে সাইকিয়াট্রিস্ট-এর কাছে নিয়ে যাব। সিমিন রাজি হবে না। কিছু একটা বলে নিতে হবে। এতদিন ভেবেছিলাম আমি চেষ্টা করে দেখি সিমিনকে স্বাভাবিক জীবনে ফিরিয়ে আনতে পারি কি না। কিন্তু এখন দেখছি সেটা আর সম্ভব নয়। কালই একবার নিয়ে যাব যেভাবেই হোক।
রাতে সিমিন বারান্দায় দাঁড়িয়ে শূন্য হাত বাড়িয়ে কী যেন করছে।
‘কী করছো সিমিন?’
‘বাবুকে আদর করছি। তুমি একটু আদর করে দিবে আমার মেয়েকে?’
বলেই সিমিন শূন্য হাত আমার কোলে দিলো।
আমিও কোলে নেওয়ার ভান করলাম।
‘সিমিন কাল এক জায়গায় যাবে আমার সাথে?’
‘কোথায়?’
‘যাবো এক জায়গায়।’ আমি কথা খুঁজছিলাম কী বলা যায়।
সিমিন আমার দিকে তাকিয়ে রইল অনেকক্ষণ। তারপর বলল, ‘আমাকে সাইকিয়াট্রিস্ট-এর কাছে নিয়ে যাবে তাই না?’
আমি একটা ধাক্কা খেলাম। সিমিন কী করে বুঝল?
‘না মানে…’
‘আসিফ তুমি অনেক ভালো একজন মানুষ। কোনো ছেলে এতটা মেনে নিতো না। আমার খুব অপরাধবোধ কাজ করে। আমি তোমাকে সুখী করতে পারব না। পারলে ক্ষমা করে দিও আমাকে।’
আমি খুব অবাক হলাম। সিমিন এতটা স্বাভাবিকভাবে কথা বলছে দেখে।
‘সব ঠিক হয়ে যাবে সিমিন।’
সিমিন ঘুমাতে চলে গেল।
এটাই ছিল সিমিনের সাথে আমার শেষ কথা। তারপর আমিও গিয়ে ঘুমিয়ে পড়লাম। কখন যে ও এতগুলো ঘুমের ঔষধ খেয়ে নিয়েছিল বুঝতেই পারিনি। এক অদ্ভুত মায়া ছড়িয়ে দিয়ে সিমিন চলে গেল পৃথিবী ছেড়ে।
কপিরাইট © ২০১৭ - ২০২০ ।। বইদেশ-এ প্রকাশিত কোনও সংবাদ, কলাম, তথ্য, ছবি, কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না
Design & Development by: TeamWork BD