।। সাধনা সাহা ।।
“টেকনাফ ছাড়িয়ে এগিয়ে চলছে জাহাজ। মাস্টার ব্রিজের কাঁচের জানালায় নাফ নদীর প্রতিচ্ছবি। দেখি… ঘন নীল জলরাশি সরে সরে যাচ্ছে পেছনে। আমার হাতের মুঠোয় কমলা লেবুটা কোমল সুবাস ছড়াচ্ছে, বড়ো নষ্টালজিক সে ঘ্রাণ…!”
(সীমানা পেরিয়ে : গিয়াস আহমেদ)
অতীতের স্মৃতি আর তার ঘ্রাণ তো নস্টালজিক হবেই। তবে সেই স্মৃতিচারণ যদি হয় মনের গহীন থেকে গহীনতর এক অতলের তল থেকে কুড়িয়ে পাওয়া যা ঝিনুকের বুকে লুকিয়ে থাকা মুক্তোর মতো তা হলে তো কথাই নেই। আসলে মনের কোনো সীমাবদ্ধতা নেই। অপার সমুদ্রের মতো স্মৃতির রাশি নিয়ে বিরাজমান এই মন কখন যে কোথায় চলে যায় তার ঠিকানা কি রাখা এতই সহজ? কেউ কি পেরেছে? নাকি পারা যায়? তাই তো মন স্মৃতির দিগন্ত পাড়ি দিয়ে চলে যায় সীমানা পেরিয়ে কোন দূর দিগন্তের নীলিমায়। আর তখন অন্তরে বেজে ওঠে,
“মনের গোপন ঘরে, যে শাপদ ঘর করে
তাকেই লালন করে চলাই জীবন
অন্তবিহীন পথে চলাই জীবন।”
তবুও জীবন একসময়ে থেমে যায়। মন সীমানা পেরিয়ে গেলেও জীবন পারে না। তার আছে সীমানা, আছে সীমাবদ্ধতা! সীমাবদ্ধতার শৃঙ্খল আছে বলেই জীবনে আছে বিষাদ, আছে বেদনা। তবুও জীবন স্বপ্ন দেখায়, স্বপ্নে ভাসায়!
আমরা সুখের আস্বাদনে জীবনকে উপভোগ করতে পারি। গল্পের পরিসমাপ্তি সুখের দেখতে চাই। তেমনি এক ক্ষুদ্র জীবন বোধের সফল পরিসমাপ্তির গল্প গিয়াস আহমেদ-এর ‘সীমানা পেরিয়ে’। সৃষ্টি সুখের উল্লাস, হারানোর বেদনা, স্মৃতি এবং বাস্তবের এক অসাধারণ সমীকরণ এই ‘সীমানা পেরিয়ে’।
বই : সীমানা পেরিয়ে
লেখক : গিয়াস আহমেদ
প্রকাশক : ভাষাচিত্র
প্রথম প্রকাশ : ফেব্রুয়ারি ২০২২
প্রচ্ছদ : বিপুল শাহ্
মুদ্রিত মূল্য : ৪০০ টাকা
“জীবন গিয়েছে চলে আমাদের কুড়ি-কুড়ি বছরের পার
তখন হঠাৎ যদি মেঠো পথে পাই আমি তোমারে আবার!
সোনালী-সোনালী চিল-শিশির শিকার ক’রে নিয়ে গেছে তারে-
কুড়ি বছরের পরে সেই কুয়াশায় পাই যদি হঠাৎ তোমারে!”
(কুড়ি বছর পরে : জীবনানন্দ দাশ)
দেখতে দেখতে কুড়িটা বছর পার হয়ে গেল। কুড়ি বছর আগে একদল অসম বয়সের কিন্তু সমমনের মানুষের সঙ্গে ভ্রমণপিপাসু লেখকের ঢাকা থেকে সেন্টমার্টিন যাত্রা বা পরিভ্রমণের আত্মকথা এই ‘সীমানা পেরিয়ে’ বইটি।
কুড়ি বছর পরে স্মৃতির রোমন্থন করে শব্দের জাদুতে তিনি ভরিয়ে তুলেছেন পাতার পর পাতা। তার এই স্মৃতিকথায় সবাই কি অসীম পূর্ণতার প্রাপ্তিতে জীবন্ত হয়ে উঠেছে, মনে হচ্ছে এই তো, এখনই ঘটনাগুলো ঘটে গেল চোখের সামনে! কী অপরিসীম বর্ণনার বাক্যালাপ, স্বপ্নছোঁয়া শুভ্রতার আমেজ, আদুরে শব্দের মায়াজাল বইটিকে আছন্ন করে রেখেছে।
‘সীমানা পেরিয়ে’ বইটিতে লেখকের সম্মোহনী জাদুর পরশে যেমন উঠে এসেছে ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র ঘটনা, তেমনি উঠে এসেছে অসংখ্য নাম, অসংখ্য চরিত্র। এদের কেউ ছবি আঁকিয়ে, কেউ গায়ক, কেউ সাংবাদিক, কেউ বা আবার শিল্পমনা। তাদের সবার গন্তব্য সেন্টমার্টিন দ্বীপ, যাত্রার উদ্দেশ্য সাগরের বুক চিরে সুনীল শুভ্র আকাশে ওড়াতে হবে ঘুড়ি, করতে হবে ঘুড়ি উৎসব।
ভাবনায় পড়েছে সবাই। কোনো উৎসব তো আর এমনি এমনি করা যায় না, তার জন্য টাকার প্রয়োজন হয়। যদিও সেন্টমার্টিন যাওয়া ও খাওয়ার খরচ যার যার ব্যাক্তিগত তবুও ঘুড়ি, সুতো, লাটাই, মাজন এসবের জন্য তো টাকার প্রযোজন! সমমনা মানুষগুলো প্রতিদিন অফিস শেষে মিলিত হতেন সোহরাওয়ার্দী উদ্যানের গেটের মুখে একখণ্ড ভূমিতে। চলতো তাদের আড্ডা গল্প, ছবি আঁকা, গান শোনা। বন্ধুরা মিলে নাম দিয়েছিল ‘ছবির হাট’। ব্যাক্তিগত কাজ সেরে সবাই চলে আসেন এখানে। ঘুড়ি উৎসবের খরচ যোগান দিতে শুরু করেন ‘সরাচিত্র’। এই সরাচিত্র বিক্রি করে সেই টাকায় করা হবে এই উৎসব। শিল্পীরা রঙতুলির আঁচড় কেটে মাটির সরায় ভরিয়ে তোলেন, বাংলার লোকজ ইতিহাস, ঐতিহ্য, বাস্তবতা এবং তাদের আদুরে স্বপ্নগুলো। আর এই সব আঁকিয়েদের সঙ্গ দিতে কণ্ঠশিল্পীরা মেলে ধরেন তাদের কণ্ঠের জাদু। কেউ গান, কেউ আবৃত্তিতে মন ভরিয়ে তোলেন। আর যারা সাংবাদিক বা শিল্পমনা তাদের জন্য গেয়ে ওঠেন,
“তুমি আমার পাশে বন্ধু হে
বসিয়া থাকো, একটু বসিয়া থাকো।
আমি মেঘের দলে আছি
আমি ঘাসের দলে আছি
তুমিও থাকো বন্ধু হে
বসিয়া থাকো, একটু বসিয়া থাকো।”
লেখক কি অপূর্ব শব্দ কথনে ভরিয়ে তুলেছেন এই ছবির হাট। হাটের প্রত্যেক ‘হাটুরে’ থেকে শুরু করে মোল্লার দোকানের মোল্লা চাচা, ইমন, হটপেটিস বিক্রেতা বুড়ো চাচা, বাঁশি বিক্রেতা লাল ভাই সবাইকে তিনি সমান তালে সমান আধিক্যে উপস্থাপন করেছেন। ছোট্ট শিশুদল থেকে শুরু করে ছবির হাটের বৃদ্ধ দাদু পর্যন্ত সব চরিত্রই পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে প্রজ্জ্বলিত হয়েছে তার কলমের ছোঁয়ায়। একজন দক্ষ, উন্নত মানসিকতা এবং প্রকৃত লেখকেরই থাকে এই মহৎ গুণটি। তিনি যে একজন কত বড়ো মাপের লেখক তা আপনারা বইটি পড়লেই বুঝতে পারবেন।
পুরো ‘ছবির হাট’ এর বর্ণনা থেকে শুরু করে ‘ঘুড়ি উৎসব’ পর্যন্ত লেখকের অভাবনীয় বর্ণনায় পাঠক আপনি বসে থাকতে পারবেন না। লেখকের বাচনভঙ্গি, কাহিনি বিন্যাস বর্ণনার ধারাবাহিকতায় হারিয়ে ফেলবেন নিজেকে, প্রতিষ্ঠিত করবেন আপনিও একজন ছবির হাটের ‘হাটুরে’, আপনি একজন ঘুড়িয়াল বা উড়িয়াল। সেন্টমার্টিন দ্বীপের জোনাকজ্বলা বালির ওপর দাঁড়িয়ে সাগরের বুকের সব ভালোবাসা, ধৈর্য, সাহস সঞ্চয় করে দ্বীপের আকাশে উড়িয়ে দেবেন আপনার কল্পনার ঘুড়িটি।
পাঠক বন্ধুরা, টেকনাফ থেকে সেন্ট মার্টিনের পথে যেতে যেতে আপনারা দেখতে পাবেন টেকনাফ সৈকত, যেখানে সোনালি বালুকাবেলায় রং-বেরংয়ের নাও রাজসিক অধিষ্ঠানে অধিষ্ঠিত থাকে আর থাকে বিচিত্র আল্পনায় আঁকা লাল কাঁকড়ার বাড়ি আর হিজলের ফুলের মতো পুরো বিচ জুড়ে ছড়িয়ে থাকা লাল কাঁকড়া, মৃত ঝিনুকের খোলস বিছানো পথ, কোথাও কোথাও কোরাল পাথরের বিন্যাস। আর আসবে ইতিহাস বিজড়িত এক রাখাইন কিশোরীর বিচ্ছেদময় প্রেমের অনবদ্য সমাধিস্থল ‘মাথিনের কূপ’। এই কূপের রহস্য, কাহিনি সবই উন্মোচিত হবে লেখকের লেখনীতে হয়তো লেখকের সাথে আপনারাও অনুভব করবেন,
“মধু হই হই বিষ হাওয়াইলা
হন হারনে ভালোবাসার দাম ন দিলা
হন দোষখান পায় ভালবাসার দাম ন দিলা।”
তারপর জাহাজ ঘাটে দেখা হবে জাহাজের সারেং সুলতান চাচার সাথে। তার দুচোখের জলের ধারায় লেখকের সাথে আপনিও বলবেন,
“কার তরে কোন চোখে জল ভরে।” সাগরের মতো উদার আর মায়ায় জড়ানো চাচার মন।
বাড়ি, ঘরে ফেরা হয় না তার অনেকদিন। তাইতো লেখকের উদাস মনের গহীনে জমে থাকা চাচার কষ্টগুলো ঝরে পড়ে,
“জলের খাতায়, জলের কালিতে যে নাম লিখিয়েছে, সে নাবিক মরেছে, তার আর অবসর নেই, অব্যাহতি নেই, জলের টান বড়ই সর্বনাশা।”
এতক্ষণে জাহাজ কুতবদিয়া সাবরাং পার হয়ে এগিয়ে যাবে। আবারও লেখকের হাতে উঠে আসবে কলম। রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর ইতিহাস-ঐতিহ্য তুলে ধরবেন আর তুলে ধরবেন তাদের মানবেতর জীবনযাপনের করুণ উপাখ্যান। প্রিয় পাঠক শাহপরীর দ্বীপের আখ্যানও কম যায় না। তাইতো শাহ সুজার পত্নী পরীবানুর মর্মান্তিক কাহিনির কাব্যগাঁথা ঝরে পড়ে লেখকের কলমে, হয়তো আপনারা অবচেতন মনে গেয়ে উঠবেন,
“সাগরে ডুবালি পরীরে
হায়! হায় দুখে্খ মরিরে।”
অতঃপর সেই কাঙ্ক্ষিত সেন্টমার্টিন দ্বীপ। সেই ব্যানারে চোখ আটকে যাবে আপনার,
“ছবির হাটের ঘুড়ি উৎসব
দ্বীপ নারকেল জিঞ্জিরা।”
ছবির হাটের ঘুড়িয়ালরা যারা এক সপ্তাহ আগে এসেছে সীমানা পেরিয়ে কটেজে তাদের উষ্ণ অভ্যর্থনায় আপনিও হবেন মাতোয়ারা, ক্রাউন অব লাভ মাথায় পরে রাজাধিরাজের মতো প্রবেশ ঘটবে আপনারও। পাঠক এবার আপনি মিশে যাবেন ঘুড়িয়ালদের বিশাল কর্মযজ্ঞে। কত রকম ঘুড়ি! কী বিচিত্র তার রং! জীবনের সব রংগুলো যেন উঠে এসেছে এই ঘুড়িতে। এক একজনের বিচিত্র জীবনের ইঙ্গিত বহন করে চলেছে এই ঘুড়ি।
সীমানা পেরিয়ে রিসোর্টের গেট পেরুলেই পাবেন ডাব চাচার টং দোকান। সেখানে বসে লেখকের সঙ্গে ডাবের সুমিষ্ট জল আর শাঁস খেয়ে যেমন মিটাবেন পেটের ক্ষুধা তেমনি নারকেল জিঞ্জিরা থেকে সাধু মার্টিনের দ্বীপ বা সেন্ট মার্টিন দ্বীপের ইতিহাস জেনে নিজেকে করবেন সমৃদ্ধ। তারপর যাত্রা শুরু হবে ‘সমুদ্র বিলাস’-এর পথে। কালজয়ী লেখক হুমায়ুন আহমেদ এর স্বপ্নের বাড়ি ‘সমুদ্র বিলাস’। কত স্মৃতি, কত কথা ভেসে উঠবে লেখকের মানসপটে! আপনারাও এই স্মৃতি রোমন্থন করা থেকে বাদ যাবেন না। আস্তে আস্তে দ্বীপে নামবে আঁধার। লেখক আবার মাতোয়ারা হবেন আঁধারের সৌন্দর্যে। আপনাদের নিয়ে যাবে শরৎ বাবুর সান্নিধ্যে। অন্ধকারের অপার সৌন্দর্য, সমুদ্রের অপার জল রাশির শুভ্রতা আর মায়াবী জোছনার স্নিগ্ধতায় লেখেকের অবচেতন মন বলে উঠবে,
“আলো আলো, আলো…!
পায়ে পায়ে জ্বলছে আলো। অদ্ভুত মায়াবী আলো জড়িয়ে ধরেছে পা, শীতল শিখা ছড়িয়ে পড়ছে চারপাশে।”
পাঠক এই আলো আপনিও অনুভব করবেন লেখকের সাথে সাথে।
রিসোর্টের মাঠে বসবে আসর। সেই আসরে আপনিও একজন হয়ে উঠবেন। চলবে নাচ, গান, কৌতুক, কবিতার আসর। চলবে প্রেম-ভালোবাসা, বন্ধুত্বের কথকতা। কিন্তু এত আনন্দের মাঝেও আপনাকে ঘিরে ধরবে হতাশা। তবুও অসুস্থ স্ত্রীর নিডল লাগানো হাত ছুঁয়ে থাকা স্বামীর উৎকণ্ঠা দেখে আপনিও লেখকের মতো হারিয়ে যাবেন রবীতে,
“আমি তব সাথী,
হে শেফালী, শরৎ-নিশির স্বপ্ন, শিশির-সিঞ্চিত…
আর তখনই অনুভব করবেন আপনার মনের জানালায় ঝরে পড়ছে অজস্র শিউলি।
দেখা হবে ছেঁড়াদ্বীপের প্রথম বাসিন্দা হোসেন আলীর সাথে। না পাঠক উনি মানিক বন্দোপ্যাধ্যায়ের হোসেন মিয়া নন। হোসেন মিয়া গিয়েছিলেন ময়না দ্বীপে। উনি সামান্য চা-বিস্কিটের দোকানদার হোসেন আলী। খাবার যদিও জোগাড় করতে পারেন হোসেন আলী কিন্তু খাবার পানির বড়োই সংকট। লেখেকের সঙ্গে আপনিও আক্ষেপ করে বলে উঠবেন,
“হাতের কাছে ভরা কলস-তবু তৃষ্ণা মেটে না… হায় রে লালন।”
ছেঁড়াদ্বীপের মতো তার পিপাসার মুহূর্তগুলো কখনো ভাসে আবার কখনো জেগে থাকে, হয়তো এভাবেই থাকবে অনন্তকাল…!
সেই মাহেন্দ্রক্ষণ! যার জন্য এত আয়োজন, এত প্রয়োজন! জাতীয় পতাকা হাতে নিয়ে জাতীয় সঙ্গীতের মূর্চ্ছনায় আপনিও ভেসে যাবেন। তারপর আকাশে ঘুড়ির ঝাঁক। কত বিচিত্র আকার, আকৃতি আর রঙের মিশেল এই ঘুড়িগুলো যেন এক একটা জীবনের ইতিহাস। হয়তো লেখকের মতো আপনারও ক্ষণিকের ইচ্ছে জেগে উঠবে, ‘একদিন এই দ্বীপের নাম হবে ঘুড়ির দ্বীপ।’ রংয়ের খেলায় মেতে উঠবে দ্বীপবাসী। রংয়ে রংয়ে রঙিন হয়ে উঠবে সেন্টমার্টিন দ্বীপের বালুচর হয়তো বেভুল মনে পাঠক আপনিও গেয়ে উঠবেন,
“রাঙিয়ে দিয়ে যাও তুমি যাবার আগে
তোমার আপন রাগে, তোমার গোপন রাগে।”
এবার ফেরার পালা। তবে তার আগে বন্ধুরা মিলে যখন একটা কাঠ-গোলাপের চারা রোপন করবে তখন পাঠক আপনি হয়ে যাবেন শব্দাহত। অজানা এক কষ্ট বয়ে যাবে আপনার শিরায়, শিরায়। হারাই, হারাই কেমন যেন এক বেদনায় আছন্ন হয়ে থাকবে আপনার হৃদয়, মন আর এর উপলব্ধি হবে মননেও। হয়তো তখন আপনার মনে হবে “সব পাখি ঘরে ফেরে, সব মানুষ ঘরে ফেরে না…! নিজেকে হারিয়ে ফেলার স্বাধীনতা মানুষের রয়েছে।” হয়তো তাই…! মানুষের মন উড়াল দিয়ে চলে যেতে পারে সব সীমাবদ্ধতার সীমানা পেরিয়ে..!
পাঠ প্রতিক্রিয়া
লেখক গিয়াস আহমেদ এর ‘সীমানা পেরিয়ে’ শুধুই ভ্রমণ কাহিনি নয়। এর পরতে পরতে লুকিয়ে আছে প্রেম-ভালেবাসা, সৃষ্টির আনন্দ, হারানোর বেদনা, আছে তত্ত্ব ও তথ্যের অসীম ভাণ্ডার, তাই বইটিকে ‘ডকু ট্রাভেলগ’ বলাই বাঞ্ছনীয়।
বইটির প্রচ্ছদ অলংকরণ করেছেন বিপুল শাহ্। তিনি ছবির হাট এবং ঘুড়ি উৎসবের অন্যতম একজন। তাই তিনি তার মনের সমস্ত মাধুরী মিশিয়ে সৃষ্টি করেছেন এই চিত্রকর্মটি। বইটির কাহিনি, চরিত্র এবং বর্ণনার বিন্যাসে প্রচ্ছদটির সার্থকতাই খুঁজে পাওয়া যায়।
ঘটনার বিন্যাসে, চরিত্র চিত্রায়ন আর কাহিনির প্রাঞ্জলতায় নামকরণটিও যথার্থ মনে হয়েছে। খুব তাড়াহুড়ো করে বইটা শেষ করতে হয়েছিল লেখককে। তাই হয়তো কিছুটা বানান বিভ্রাট চোখে পড়ে। আশ্চর্য হয়েছি এত এত চরিত্রকে সামলানোর দক্ষতা দেখে! কী করে একহাতে কয়েকশত চরিত্র সামলে নিয়েছেন তিনি। ‘সীমানা পেরিয়ে’ বইটির কোনো চরিত্রকে যেমন তিনি সীমানা পেরোতে দেননি আবার কোনো চরিত্রকে তিনি অবহেলাও করেননি। সে হোক না একদল বুদ্ধিদীপ্ত শিশু বা পায়ে ব্যথা নিয়ে আসা আম্মা বাহিনী অথবা হোক সে ভাই, বোন, বন্ধু, বন্ধুপত্নী সন্তান অথবা স্ত্রী। সবার গুরুত্ব সমানভাবে দিয়েছেন। হয়তো এই দক্ষতার কারণেই তিনিই লেখক গিয়াস আহমেদ হতে পেরেছেন!
প্রিয় পাঠক, বইটা পড়তে গিয়ে আমি যেমন মুগ্ধতায় মুগ্ধ হয়েছি তেমনি আবার মৃদু লয়ের এক সুক্ষ্ম করুণ সুরের মূর্ছনায় নিজেকে আবৃত করে ফেলেছি। কেমন যেন খুশির মাঝেও মনের মধ্যে চিনচিনে এক ব্যথায় তার ছাপ রেখে যাচ্ছিল। শেষ পৃষ্ঠায় এসে চোখ আটকে গেল। মনের মাঝে গুনগুনিয়ে উঠলো,
“কতটা হারালে বলো বলা যায় হারিয়েছি সবটুকু…!”
আহা রে! হারিয়ে যাওয়ারও কি নিদারুণ সুখ! সত্যিই তো মানুষ এভাবে নিজেকে হারাতে চায় তার ভালোবাসার কাছে, বন্ধুত্বের কাছে, আপনজনের কাছে এমন কি নিসর্গের কাছে, প্রকৃতির কাছে।
একটা কথা না বললেই নয়, বইটা পড়ে আমি কেমন যেন শব্দবিলাসী হয়ে উঠেছি। হয়তো এই রিভিউটা তারই প্রতিফলন। তবুও পাঠক, মন যেখানে সীমানা পেরিয়েছে কথারা সেখানে পাখনা মেলে দেবেই! জানি আপনাদের ধৈর্য ধরে এতটা সময় ব্যয় করার মতো সময়ের বড্ড অভাব। তবুও আশা রাখি একরাব একটু চোখটা বুলিয়ে নেবেন। হাত বাড়িয়ে দেবেন ‘সীমানা পেরিয়ে’র সীমানায়।
বিশবছর পর হয়তো এখন আর ‘ছবির হাট’ বসে না, আসে না কোন ‘হাটুরে’। সেন্টমার্টিন দ্বীপের রূপালী বালিয়াড়িতে দাঁড়িয়ে সাগরের বুক চিড়ে শুভ্র আকাশে ওড়ে না কোনো বর্ণিল ঘুড়ি! ‘সীমানা পেরিয়ে’ রিসোর্টের আঙিনায় বসে না কোনো জমাটি আড্ডা তবুও লেখক আসায় বাসা বাঁধে, তার মনের কোণে স্বপ্ন উঁকি মারে! যদি কখনো কোনো নতুন প্রজন্ম তার ‘সীমানা পেরিয়ে’-এর সীমাবদ্ধতা অতিক্রম করে আবার নতুন করে নতুন ছন্দে বসাবে ‘ছবির হাট’ যাতে যুক্ত হবে নব নতুন ‘হাটুরে’
আবার জমজমাট হবে দ্বীপ, উড়বে ঘুড়ি হবে, ঘুড়ি উৎসব আর নতুন ঘুড়িয়াল আর উড়িয়ালরা ছুটে যাবে সেই কাঠগোলাপ গাছের তলায় যেখানে ছড়িয়ে থাকবে হাজার হাজার কাঠগোলাপ তাদের অভ্যর্থনা জানাতে। পাঠক বন্ধুরা, সেই অনাগত ভবিষ্যতের আশায় লেখক আপনাদের দিকে বাড়িয়ে দিয়েছেন বন্ধুত্বের হাত আর মনের গহীন থেকে সুরলহরী ঝরে পড়ছে,
“বন্ধু এসো স্বপ্ন আঁকি চারটা দেয়াল জুড়ে
বন্ধু এসো আকাশ দেখি পুরোটা চোখ খুলে
বন্ধু এসো জলে ভাসি, দুখ ভাসানো সুখ
বন্ধু তোমার বন্ধু আমি, বন্ধু মোরা কজন।”
কপিরাইট © ২০১৭ - ২০২০ ।। বইদেশ-এ প্রকাশিত কোনও সংবাদ, কলাম, তথ্য, ছবি, কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না
Design & Development by: TeamWork BD