ভাষাচিত্র বুক ক্লাব আয়োজিত ‘শনিবারের গল্প’ শীর্ষক আয়োজন থেকে বাছাইকৃত গল্প নিয়ে প্রকাশিত হচ্ছে “দেশের বই ঈদ সাময়িকী”। আজ প্রকাশিত হলো সাধনা সাহার ছোটগল্প উন্মুক্ততার আভাস
কী অদ্ভুত এক ঘোরলাগা মায়াময় চাহনি! ভাসাভাসা চোখ দুটোতে সাগরের অতলতার তল খুঁজে পাওয়া ভার। দৃষ্টিতে ভালোবাসার এক অনন্য মায়াজাল আছন্ন করে আছে! কী দেখছে ওভাবে রাফি? একটুও পরিবর্তন হয়নি ওর। সেই মায়াময় চোখ, সেই মুখ, সেই ঠোঁট যার কোণায় কোণায় লেগে আছে চপল, দুষ্ট-মিষ্টি হাসি। কেমন যেন আনমনা হয়ে ওঠে অনন্যা চৌধুরী। রাফি? রাফি এখানে, এইসময়ে! কী করে এলো? ওর তো এখন বিদেশে থাকার কথা! বিস্ময়ের ঘোর কাটিয়ে জিজ্ঞেস করে,
‘তুমি এখানে? এইভাবে?’
‘তুমিই তো আমায় ডাকলে, তাই তো এলাম।’
অনন্যা চৌধুরী ভেবেই পান না, তিনি কখন ডেকেছেন ওকে। একদৃষ্টিতে রাফির চোখের দিকে তাকিয়ে রইলেন কিছুক্ষণ। চোখের ভাষা আর ঠোঁটের হাসি বুঝিয়ে দিচ্ছে রাফি ওনার সাথে দুষ্টুমি করছে। উনিও মেতে উঠলেন দুষ্টুমিতে। কপট রাগ দেখিয়ে বললেন,
‘সেই কখন ডেকেছি আর এখন এলে!’ একটু চড়া গলায় ধমকের সুরে বলে উঠলেন,
‘তোমাকে না আসতে বারণ করেছি।’
‘কী করবো বলো তো? তোমায় যে দেখতে ইচ্ছে করে! তোমায় একটু ছুঁতে মন চায়। দাও না তোমার হাতদুটো একটু ছুঁয়ে দেখি।’
‘না রাফি! তা হবার নয়।’
‘কেন নয়?’ বলে রাফি অনন্যা চৌধুরীর ঘাড়ে হাত দিয়ে একটা ঝাঁকুনি দিয়ে ওঠে।
‘রাফি…’ বলে চিৎকার দিয়ে ওঠেন অনন্যা। তারপর রাফির হাত ধরে টান দিয়ে নিজে হুড়মুড় করে নেমে পড়েন বিছানা থেকে।
চোখ খুলে থতমত খেয়ে যান তিনি। দেখেন তিনি ঝিলমির হাত ধরে দাঁড়িয়ে আছেন। তাহলে কি তিনি এতক্ষণ স্বপ্ন দেখছিলেন।
নিজেকে সংযত করে বলে ওঠেন,
‘তুই এখানে?’
ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে ঝিলমি ভয়ে ভয়ে বলে, ‘আপনিই তো পাঁচটার সময় ডাকতে বলেছিলেন, বইমেলায় যেতে চেয়েছিলেন।’
‘ও,তাই তো। আচ্ছা যা তুই।’ একটু ভেবে আবার বললেন, ‘পারলে এককাপ চা পাঠিয়ে দিস!’ ঝিলমি হাফ ছেড়ে বাঁচে। আর অনন্যা চৌধুরী ভাবনার জালে আটকে পরেন। হঠাৎ করে রাফিকে কেন স্বপ্নে দেখলেন। ভাবতে ভাবতে ভাবনাগুলো বায়োস্কোপের মতো স্মৃতির কালো পর্দা সরিয়ে রঙিন আলোয় ঝলমল করে ওঠে। হারিয়ে যান তিনি সেই অতীতের ক্রমাগত নিগুঢ় টানের স্রোতে।
মফস্বল শহরের কলেজে ভর্তি হয় দুজন। কেউ কাউকে চিনতো না। কলেজেই পরিচয় হয়। দুজনেই মোটামুটি মেধাবী ছিল। কলেজে ক্লাস, প্রাইভেট পড়া, প্র্যাকটিক্যাল ক্লাস সবকিছুই একসঙ্গে করতে করতে বন্ধুত্বের এক নিগুঢ় বন্ধনে বাঁধা পরে ওরা। শুধু ওরা নয়। ওদের একটা গ্রুপই ছিল আলাদা। সবারই সবার জন্য অন্তরের কোনো এক কোণ থেকে সুক্ষ্ম একটা টান অনুভব করতো।
রাফি সুন্দর লিখতে পারতো। অনন্যাও লিখতো। ওরা কলেজ ম্যাগাজিন, দেওয়াল পত্রিকা বের করতো। সেবার খুব বন্যা হলো। ওদের কলেজে বন্যার্তরা আশ্রয় নিল। ওরা ক্যাম্পিং করে বন্যার্তদের সাহায্য করলো। ম্যাগাজিন বিক্রির টাকা আর নিজেরা ব্যক্তিগতভাবে ডোনেট করে ওদের পাশে গিয়ে দাঁড়ালো। বাড়ি বাড়ি গিয়ে পুরনো কাপড়চোপড় যোগাড় করে আনতো। অনন্যা নিজের বেশ কিছু সালোয়ার-কামিজ আর মায়ের শাড়ি দিলো। বন্যার্তদের সাহায্য করা, দিনমজুর খেটে খাওয়া প্রান্তিক মানুষের পাশে দাঁড়ানো, ওদের সঙ্গে সমান তালে কাজ করা দেখে রাফি ওকে অন্যরকমভাবে ভাবতে শুরু করলো। আসলে রাফি একটা অন্যরকম টান অনুভব করতো। একদিন যদি ও কলেজে না আসতো রাফির যেন সেদিনটা শেষই হতে চাইতো না। একপলক দেখার জন্য ঘণ্টার পর ঘণ্টা অপেক্ষায় থাকতে পারতো। রাফি মাঝেমধ্যে ভাবতো এই টানটা কি শুধু বন্ধুত্বের, না অন্য কিছুর? অন্য কিছু হলে, কী সেই টান। মাঝেমধ্যেই রাফির মনে হতো অনন্যার চোখে কী এত আকর্ষণ, যা তাকে মুগ্ধতায় ভরিয়ে দেয়! ওর কথায় কী যাদু আছে যা ওকে বারবার শোনার জন্য আকর্ষণ করে?
শুধু কি রাফি? না, অনন্যাও অনুভব করতো! রাফির জন্য অপেক্ষার প্রহর গুণতো। এক একটি মুহুর্তের অপেক্ষা বিরহ-বিচ্ছেদের বিশাল পাহাড় তৈরি করে ফেলতো। অথচ দুজন দুজনের সামনে নির্বিকার, নিশ্চুপ। অনন্যা ভাবতো রাফি কি শুধু ওর বন্ধু না অন্য কিছু! ওকে না দেখার কষ্ট, কথা না বলার কষ্ট তবে কি এই কষ্টের নামই ভালোবাসা? ভালোবাসলেই কি এমন টান অনুভূত হয়? নাকি ওর প্রতি জন্মানো মোহ? দোদুল্যতার আবেশে নিজেকে ভাবিয়ে তুলতো আরও গভীর থেকে গভীরে।
মধ্যবিত্ত পরিবারের বড়ো মেয়ে অনন্যা। ওকে অনেক কিছুই মানিয়ে চলতে হতো। সাংসারিক ভালো-মন্দ, বাবা-মা, পরিজন সবার দিকেই নজর ছিল ওর। কিন্তু নজরের গুরুত্ব বাড়াতে পারেনি শুধু নিজের মনের। মধ্যবিত্ততার যূপকাষ্ঠে বলির পাঠায় পরিণত হয় এমনি হাজারও অনন্যা আর রাফির প্রেম, ভালোবাসা এমন কি বেঁচে থাকার আশাও। তবুও অনন্যা পারেনি সেদিন চুপ করে থাকতে। যেদিন ও শুনেছিল রাফি এক্সিডেন্ট করেছে, হাসপাতালে আছে। সেদিন ছুটে গিয়েছিল পাগলের মতো। ভেবেছিল ওর ভালোবাসার স্পর্শে মুছিয়ে দেবে রাফির সমস্ত জ্বালা-যন্ত্রণাকে। বিধাতা হেসেছিলেন। বড়ো কুচক্রী তিনি! আষ্টেপৃষ্টে জড়িয়ে ধরে রাফিকে বলতে চেয়েছিল,
‘তোমার কিচ্ছু হবে না, দেখো! আমি আছি তো তোমার পাশে!’
না পারেনি। রাফির পরিবারের উপস্থিতি সেদিন ওকে স্তব্ধ করে দিয়েছিল। চোখের দেখা দেখেই চলে আসতে হয়েছিল সেদিন।
হয়তো রাফিও বারবার ছুটে গেছে ওর কাছে। কিন্তু অনন্যার নির্লিপ্ততায় ফিরে ফিরে এসেছে। দুজন দুজনকে প্রচণ্ড ভালোবাসতো, অথচ কেউ কাউকে বলতে পারতো না। মধ্যবিত্তের এক ঘোরের নেশায় বুঁদ হয়ে যেতো দুজনে। কেউ কাউকে ইগনোর করলে বাঁচতে পারবে না এমন একটা ভীতিও কাজ করতো মনের গহীনে। যেদিন রাফি গিয়েছিল অনন্যার কাছে ভালোবাসার কথা বলতে, নিজের দায়িত্ব দিতে, সেদিনও পারেনি রাফি। ফিরে আসতে হয়েছিল।
তবে হ্যাঁ, সেদিন দিয়েছিল দায়িত্ব কিন্তু নিজের নয়, ‘সৃজনীর’। ওদের সাহিত্য ম্যাগাজিনের।
অনন্যা রাফির কাছে এসেছিল আরও একদিন। তখন কলেজ পেরিয়ে একই ইউনিভার্সিটিতে দুজনে। অনন্যা গিয়েছিল ওর কাছে। তখন রাফির নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করার মনোবল এত তীব্র ছিল যে অনন্যা নিজেকে গুটিয়ে নিয়ে ফিরে এসেছিল। তারপর বিয়ে, সংসার আর চাকরি মিলেমিশে চলছিল ভালোই। হঠাৎ একটা এলোমেলো বাতাসে অনন্যার বালিয়াড়ি ঘর সাগরের উত্তাল উত্তরণের বিশালতায় ধুয়ে-মুছে একাকার হয়ে গেল।
নিঃস্ব, রিক্ত অনন্যা হাতে তুলে নিলো কলম। জীবনের আর এক সঙ্গী পেলো সে। জীবনকে নতুনভাবে সাজাতে শুরু করলো। তার লেখা বেশ কয়েকটা বই আগেই প্রকাশিত হয়েছে। এবারের বইমেলাতেও ওর লেখা একটি কবিতার বই প্রকাশিত হয়েছে। আজ মেলায় যাবে ও। ওর বান্ধবী সুমিতা বলেছিল আজ ওর সঙ্গে একজন বড়ো মাপের লেখকের পরিচয় করিয়ে দেবে। সে নাকি খুব ভালো লেখে।
ঘড়িতে পাঁচটার এলার্ম বাজতেই স্মৃতির দরজা থেকে ফিরে আসে অনন্যা। নিজেকে তৈরি করে মেলায় যায় সে। পৌঁছেও যায়। বান্ধবী সুমিতা গেটে অপেক্ষা করছিল ওর জন্য। ওরা আস্তে আস্তে এগোতে থাকে। ভাষাচিত্রের বিশাল প্যাভিলিয়নের সামনে এসে থমকে যায় অনন্যা। ও কাকে দেখছে ওখানে?
রাফি! রাশেদুল ইসলাম রাফি! তাও আবার হাতে ওর কবিতার বই ‘উন্মুক্ততার আভাস’! সারাজীবন যে নিজেকে গুটিয়ে রেখেছে তার হাতে উন্মুক্ততার আভাস। বেশ হাসি পায় অনন্যার। প্রচণ্ড অভিমানে ওখান থেকে একপা, দুপা করে সরে যেতে চাইলে সুমিতা বাঁধা দেয়। ওর হাত ধরে টেনে নিয়ে এসে রাফির সামনে দাঁড় করায়। তারপর বলে,
‘রাশেদ ভাই আপনাকে আমার বান্ধবীর কথা বলেছিলাম না, এই যে সেই অনন্যা চৌধুরী। ওর ও বেশ কয়েকটা বই প্রকাশিত হয়েছে।’
রাফির চোখ আটকে যায় অনন্যার চোখে। নিজেকে সামলে নিয়ে বিস্ময় আর আনন্দের উচ্ছ্বলিত ধারায় উদ্বেলিত হয়ে হাত বাড়িয়ে দেয় অনন্যার দিকে।
বেশ কিছুটা সময় লাগে নিজেদের সামলে নিতে। আজই যেন প্রথম পরিচয় এভাবেই শুরু হয় কথাবার্তা। পাঠক সামলে কিছুটা সময় দেয় দুজন দুজনকে। রাফি তার তৃতীয় বই ‘অনুরাগী মন’ ওর হাতে তুলে দেয়। অনন্যা মোহগ্রস্তের মতো নেশায় বুদ হয়ে বইটি খোলে।
এক পৃষ্ঠা, দুই পৃষ্ঠা উল্টানোর পর দেখে খুব সুন্দর একটা লেখা। যাকে বলে অটোগ্রাফ।
অনু,
‘তোমার মনের পৃষ্ঠাগুলো হলো না তো পড়া
তোমার স্পর্শ পেলাম না তো হলেম ছন্নছাড়া।
অনুরাগী মন আমার তোমায় খোঁজে বারবার
অন্য কিছু নাই বা হলে বন্ধু হলে আমার।’
রাফি
২০/০২/২২
আর অনন্যা! অনন্যাও সুযোগ পেয়েছে না বলা কথাগুলো বলার। ও তো এই অটোগ্রাফের মাধ্যমেই জানিয়ে দিতে পারে ওর জীবনের হারিয়ে যাওয়া অনুভূতি, আবেগগুলো। যে কথাগুলো বলবার জন্য এতগুলো বছর অপেক্ষার প্রহর গুণে গুণে আজ ক্লান্ত, অবসন্ন। বইটির পাতা উল্টে উল্টে একটা ফাঁকা পাতা বের করে শুরু করলো লেখা,
প্রিয় রাফি,
“তোমার জন্য উন্মুক্ত ছিল, মনের আকাশ
সেই আকাশে বিচরণ করলে না তো তুমি
হৃদয় মাঝে খালি ছিল বিশাল ক্যানভ্যাস,
কোনো রঙিন ছবি আঁকলে না তো তুমি
রঙের পাহাড় জমিয়েছিলাম
শুধু সাদা কালোয় করলে তুমি ফ্লাশ।
উন্মুক্ত হাত দুখানি ছিল, তোমার জন্য
ধরলে না তো, বললে না তো
‘আমি ভালবাসি তোমায়’!
একটা গোলাপ নিয়ে সাধলে না তো
আলতো করে ঠোঁট ছুঁইয়ে
অবাক তুমি করলে না তো আমায়!
উন্মুক্ত হৃদয়খানি, ছিল তোমার জন্য
হাজার ফুলের রংমিশালী পাপড়ি দিয়ে
তোমার জন্য ভালোবাসার আল্পনাতে আঁকা,
খোঁজ নিলে না একটিবারও,মাড়িয়ে গেলে
ব্যথায় ভরা মনটা আমার ঝরাপাতার
গুঞ্জরণে, মর্মরিত শিহরণে, একেবারেই ফাঁকা।
আলতা পরা পা দুখানি, ছিল তোমার জন্য
তোমার সাথে তাল মিলিয়ে একই ধারার
ছন্দ তালে চলবে সে যে আপন লয়ে,
কিন্তু তুমি বিরহেরই নূপুর দিয়ে বাঁধলে
তাদের এমন করে কঠিনভাবে,
একফোঁটাও নড়লো না তো বিষণ্নতার ভয়ে।
সবকিছুতেই ছিল যে আজ উন্মুক্ততার আভাস
তোমার জন্য মুক্তমনের পত্র লেখা
ভালোবাসার সম্মোধনে ছিল নীল খাম।
কিন্তু তুমি বুঝলে না তো, দেখলে না তো
অভিমানী মনটা আমার কাজল কালো
চোখের জলে ভিজায় তোমার নাম।”
খুঁজতে যেও না কখনো। ভালো থেকো।
মনে পড়লে আমার বইটি রইলো তোমার পাশে।
ইতি
অভিমানী অনু
২০/০২/২২
বইটা রাফির হাতে দিয়ে এগিয়ে চলে মেলার গেটের দিকে। নিজেকে আজ অন্যরকম লাগছে অনন্যার। মনের মাঝে উচ্ছ্বলে উঠছে ভালো লাগা আর ভালোবাসা। আনন্দের সাগরে মনের পূর্ণতায় ধেয়ে আসে পরিতৃপ্তির জোয়ার। কিন্তু সেই জোয়ারের নোনাজলে ভেসে যাচ্ছে ওর হৃদয়, মন। কোনোভাবেই যেন বাঁধ মানতে চায় না সেই স্রোতস্বিনী। আসলে জীবনও এমনই। তাকে চলতে হয়, চালাতেই হয়!
আকাশের দিকে মুখ তুলে তাকায় অনন্যা। দেখে বিশাল এক চাঁদ জ্বলজ্বল করছে আকাশের গায়ে। জোছনায় ধুয়ে যাচ্ছে জগতের সব পঙ্কিলতা। অনন্যার মনের বিষণ্নতাও ধুয়ে-মুছে একাকার হয়ে গেল। খুঁজে পেল মুক্তির স্বাদ। ধবল জোছনায় অনুভব করলো ‘উন্মুক্ততার আভাস’।
কপিরাইট © ২০১৭ - ২০২০ ।। বইদেশ-এ প্রকাশিত কোনও সংবাদ, কলাম, তথ্য, ছবি, কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না
Design & Development by: TeamWork BD