ভাষাচিত্র বুক ক্লাব আয়োজিত ‘শনিবারের গল্প’ শীর্ষক আয়োজন থেকে বাছাইকৃত গল্প নিয়ে প্রকাশিত হচ্ছে “দেশের বই ঈদ সাময়িকী”। আজ প্রকাশিত হলো তাসলিমা খানম-এর ছোটগল্প বুনন
আজ সকাল থেকেই গুলশান আরা মনে মনে তৈরি হচ্ছেন কী পরে যাবেন। দুপুরের খাবারের পর একটু বিশ্রাম নিয়ে অপেক্ষায় আছেন কখন বের হবেন। একটু পর শিরিন তার শাশুড়িকে তাগাদা দিয়ে নিজেও ঝটপট তৈরি হয়ে নিলো।
গুলশান আরার চোখে মুখের আনন্দ দেখে শিরিনের এত ভালো লাগছে!
এ বছর আটষট্টিতে পা দিলেন গুলশান আরা। কতদিন কোথাও যাওয়া হয় না! ছেলেমেয়েরা সবাই নিজের কাজ, সংসার নিয়ে ব্যস্ত। ওরা মায়ের খেয়াল রাখে না, তা নয়। আলমারি ভর্তি এত শাড়ি, সব তো ওদেরই দেওয়া। গুলশান আরার যে শাড়ির চেয়েও তার সন্তানদের সঙ্গ বেশি প্রিয়, সেটা হয়তো তারা ব্যস্ততায় ভুলে যায়।
শিরিন একটা অভিজাত শাড়ির দোকানে শাশুড়িকে নিয়ে এসেছেন। দোকানের তাকগুলোতে কত রকমের শাড়ি যে সাজানো আছে! গুলশান আরা এগুলোর মধ্যে কোনগুলো বেছে নিবেন ভেবে হিমশিম খেয়ে যান।
শিরিন শাশুড়িকে তাড়া দেন, ‘মা আমরা কী তাহলে আরেকটা দোকানে যাব? এখানে পছন্দ না হলে চলুন এগোই।’
দোকানের সেলসম্যান কয়েকটি শাড়ি মেলে ধরে তখন। গুলশান আরার দিকে তাকিয়ে বলে, ‘আন্টি দেখুন এই শাড়িতে আপনাকে মানাবে দারুণ!’
বেশিরভাগই অফহোয়াইট, হালকা আকাশি, বেগুনি রঙের শাড়ি।
গুলশান আরার চোখ যায় উপরের তাকে একটি ময়ূরকণ্ঠী নীল কাতানের দিকে। ইশারায় ঐ শাড়িটি নামাতে বললে সেলসম্যান ছেলেটির মুখে একটু হাসির রেখা ফুটে ওঠে। শিরিনও কিছুটা বিব্রতবোধ করে। যদিও দুজনেই মুখে কিছু বলে না।
শাড়িটি নামালে গুলশান আরার মিহি বুননের কাজে হাত বুলিয়ে দেখেন। পুরো শাড়িতে কী সুন্দর কাজ! বিয়ের সময় উপহার পেয়েছিলেন এরকম একটা শাড়ি। যতবার শাড়িটি পরতেন, ততবার ছেলেদের বাবা মুগ্ধ চোখে তাকিয়ে থাকতেন। একবার বাড়িতে চুরি হওয়ায় শাড়িটিও চুরি হয়ে যায়। তারপর উনি কিনে দিবেন বলেছিলেন, কিন্তু সংসারের অন্য দশটা চাহিদা মেটাতে গিয়ে আর কুলিয়ে উঠতে পারেননি। পরে হয়তো ভুলে গিয়েছিলেন।
গুলশান আরা তার চোখের জল লুকোতে গিয়ে ঘাড় গুঁজে শাড়ির দিকে মনোযোগী হয়ে ওঠেন।
আজকাল অল্পতেই খুব আবেগপ্রবণ হয়ে পড়েন। মনে মনে লজ্জিত হোন, ‘ছিঃ বৌমা দেখলে কী ভাববে!’
একটা সময় সংসারের ব্যস্ততায় নিজের দিকে তাকানোর সুযোগ হয়নি। এতগুলো ছেলেমেয়ের দেখাশোনা, শ্বশুর, শাশুড়ির যত্ন, স্বামীর ব্যস্ততার সাথে তাল মিলাতে গিয়ে হিমশিম খেতে হতো। ভেবেছিলেন ছেলেমেয়েরা বড়ো হয়ে গেলে একটু ফুরসৎ মিলবে। যখন হাতে অফুরন্ত সময় এসেছে ততদিনে নিজের সঙ্গীকে হারিয়ে পুরোপুরি একা হয়ে গেছেন। সেই সাথে মরে গেছে ইচ্ছেশক্তি! এখন অলস সময়গুলো তাকে শুধু ভেংচি কেটে যায়!
গুলশান আরা ময়ুরকণ্ঠী নীল রঙের শাড়িটি দোকানিকে প্যাকেট করতে বলে আরও দুটো ভালো শাড়ি নেন মেয়েদের জন্য। আরও কিছু কেনাকাটা সেরে বের হয়ে আসেন শপিংমল থেকে। বৌমা তাকে বাইরে খাওয়ার আমন্ত্রণ জানালেও না করে দেন। আজ আর কোথাও খেতে ইচ্ছে করছে না তাঁর। স্মৃতির ভারে গলা বুঁজে আসছে তার।
গাড়িতে উঠে শিরিনের হাতে শাড়ির প্যাকেটটা দিয়ে বললেন, ‘বৌমা এটা তোমার জন্য। খুব মানাবে তোমায়। শাড়ি কিনতে আমি একটু বেশি আবেগপ্রবণ হয়ে গিয়েছিলাম। কিছু মনে করো না। এ সংসারের মানুষগুলোর সম্পর্কের সুতোগুলোকে নিপুণ হাতে বুনতে গিয়ে আমার আসলে শাড়ির বুনন দেখার সময় হয়নি!’
গুলশান আরা নিবিষ্ট মনে রাস্তার ধারের দোকান, হরেকরকম মানুষ দেখছেন। আবছা আলোয় গালের একপাশ দেখা যাচ্ছে। কেমন বিষাদ মাখা চোখ, থমথমে মুখ! শিরিনের খুব ইচ্ছে হচ্ছে ওর সঙ্গী হতে। শিরিন তার হাতটা বাড়িয়ে দিলে আরেকটি প্রৌঢ় হাত সেটা পরম মমতায় মুঠোতে ভরে নিলো।
কপিরাইট © ২০১৭ - ২০২০ ।। বইদেশ-এ প্রকাশিত কোনও সংবাদ, কলাম, তথ্য, ছবি, কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না
Design & Development by: TeamWork BD