দেশের বই ঈদ সাময়িকী

সুমন কুমার-এর ছোটগল্প ‘চরণামৃত’

বৃহস্পতিবার, ১৩ মে ২০২১ | ১০:৫৭ অপরাহ্ণ | 860 বার

সুমন কুমার-এর ছোটগল্প ‘চরণামৃত’

।। সুমন কুমার ।।


 

মেয়েটা বিভাগের প্রথম বর্ষের ছাত্রী, নাম গৌরী। সুশ্রী, নম্র-ভদ্র, লেখাপড়ায় ভালো। প্রত্যন্ত উপজেলার এই সরকারি কলেজে স্নাতক পর্যায়ে ছাত্র ভর্তি শুরু হয়েছে তিন বছর হলো। বিভাগে আমরা শিক্ষক মাত্র পাঁচজন। একজন সহকারী অধ্যাপক বিভাগীয় প্রধান। প্রভাষক হিসাবে কর্মরত চারজনের মধ্যে আমিই কনিষ্ঠ-যে কারণে সব শিক্ষকের আদেশ মানতে হয়, বেশি বেশি ক্লাস নিতে হয়, দীর্ঘক্ষণ বিভাগে উপস্থিত থাকতে হয়, সেমিনার লাইব্রেরির দায়িত্বও পালন করি। আমার সাথে শিক্ষার্থীদের সম্পর্কও ঘনিষ্ঠ। ছাত্র-ছাত্রীরা মাঝেমধ্যে বিভিন্ন পরামর্শের জন্য আসে। আমি সাধ্যমতো সাহায্য করার চেষ্টা করি।
সেদিন দুপুরের পর বিভাগে আর কোনও শিক্ষক ছিলেন না। গৌরী দরজার সামনে এসে ঘোরাফেরা করছিল। তাকে ডেকে সামনে বসালাম, কোনাে কিছু জানতে চায় কি না প্রশ্ন করলাম। সে কিছুক্ষণ চুপচাপ বসে থাকলো। তারপর বলল, ‘স্যার একদিন আমাদের বাসায় আসতে হবে। কবে আসতে পারবেন?’
আমি কারণ জানতে চাইলাম। সে উত্তর দিলো, ‘স্যার আমি কারণ জানি না, বাবা-মা জানে। গেলে নিশ্চয়ই বলবে।’
কাজে ব্যস্ত ছিলাম তাই কথা সংক্ষেপ করে বললাম, ‘ঠিক আছে একদিন যাব।’
আরও কিছুদিন পর আবার তাকে ঘোরাঘুরি করতে দেখলাম। ততদিনে আগের ঘটনা ভুলেই গিয়েছিলাম। তাকে ডাকলাম. সে আগের দিনের মতোই বলল, ‘স্যার আমাদের বাসায় আসতে চেয়েছিলেন, কবে আসবেন?’
‘এই তো একদিন হঠাৎ তোমাদের বাড়ি উপস্থিত হবাে।’ আমি সেদিনের ঘটনা স্মরণ করে পুনরায় তাকে আশ্বস্ত করলাম।
‘স্যার হঠাৎ গেলে হবে না, অন্তত একদিন আগে জানাবেন।’ সে অনুনয় করে বলল।
‘কী এমন কারণ যার জন্য যেতেই হবে বা একদিন আগে জানিয়ে যেতে হবে?’
‘আমি জানি না, বাবা-মা জানে।’ পূর্বেকার দিনেই মতোই সে বলল।
তাকে বিদায় দিয়ে ভাবতে বসলাম। পূর্বে অতটা গুরুত্ব দেইনি, ছাত্র-ছাত্রীরা তো কত রকম আর্জি নিয়ে আসে, সব কী আর পূরণ করা যায়! তাছাড়া একজন ছাত্রীর বাড়িতে বিশেষ কোনাে উপলক্ষ ছাড়া গিয়ে উপস্থিত হওয়া কতটাই বা শোভনীয়!
আমরা ব্যাচেলর শিক্ষকরা মেস করে থাকতাম। সহকর্মীদের মধ্যে দেবাশীষ বন্ধুস্থানীয়। আমরা একই শিক্ষাবর্ষে একই বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পাস করেছি। আবার একই ব্যাচে শিক্ষকতায় যোগদান করেছি। যদিও পূর্ব পরিচয় ছিল না, সে ছিল বাংলা বিভাগে। অল্প-বিস্তর লেখালেখি করতো, কথা বলতো খুব রসিয়ে। সেদিন সন্ধ্যায় ঘটনাটা ওকে বললাম। সে স্বভাব মতো বলল, ‘দেখো মেয়েটা হয়তো তোমার প্রেমে পড়েছে। বাড়িতে গেলে তারা বলবে-বাবা আমার মেয়েটাকে উদ্ধার করো।’
‘ফাজলামি করো না তো।’ বললাম বটে কিন্তু নিজেও ভাবনাটি উড়িয়ে দিতে পারলাম না।
তারপর বিভাগে ওকে লক্ষ করা শুরু করলাম, পর্যবেক্ষণ করতে লাগলাম আচরণ। বুঝতে চেষ্টা করলাম সে কি সত্যিই আমার প্রতি দুর্বল? তার বাড়িতে গেলে এ রকম কিছু একটা ঘটে যেতে পারে কি না, ইত্যাদি। এ রকম যে ঘটে না তা তো নয়। শিক্ষক কত ছাত্রীর প্রেমে পড়ে, ছাত্রী দুর্বল হয় শিক্ষকের প্রতি। বিয়ে-সংসার সবই হয়। কয়েকদিন পর্যবেক্ষণ করেও কিছু বুঝতে পারলাম না। কিন্তু একটা বিষয় বুঝলাম ক্রমাগত এই ভাবনার ফলে আমার মধ্যেই দুর্বলতা তৈরি হয়েছে।
সপ্তাহখানিক পর সে আমার রুমে এলো। ইতোপূর্বে আরও দুইবার এসেছিল তখন কিছুই মনে হয়নি, এবার নিজের ভেতরে শঙ্কা-ভয়-উত্তেজনা নানারকম অনুভূতির সঞ্চালন অনুভব করলাম। মনে হতে লাগলো মেয়েটা আমার রুমে বসা, যারা দেখছে তারা কী ভাবছে! কিংবা হয়ত এখনি গৌরী স্থান-কাল-পাত্র জ্ঞান হারিয়ে বলে বসবে-স্যার, আমি আর পারছি না, বাঁচবো না আপনাকে ছাড়া, আমাকে বাঁচান, আমি আপনাকে ভালোবাসি। জড়িয়ে-টড়িয়েও ধরতে পারে। আবার মনে হতে লাগলো এও কী সম্ভব, একটি মেয়ে কি এভাবে বলতে পারে! গলা শুকিয়ে আসছিল, একগ্লাস জল খেয়ে বললাম, ‘গৌরী কিছু বলবা?’
‘স্যার, কবে যাবেন বললেন না তো?’
মাসাধিককাল ধরে ঘোরাচ্ছি, নিজের কাছেও খারাপ লাগছিল। ভেতরে ভীতি ও শঙ্কা থাকা সত্তেও বললাম, ‘কবে গেলে ভালো হয়?’
‘কাল আসেন স্যার। সন্ধ্যায়।’
‘শুক্রবারে গেলে হয় না?’
সে মিষ্টি করে হেসে বলল, ‘জি স্যার। তাহলে শুক্রবার সন্ধ্যায়।’ সে তার বাড়ি যাবার পথ বুঝিয়ে বলল। ওর বাড়ি কলেজ থেকে তিন কিলোমিটার দূর।

মাঝখানে কয়েকটা দিন নানা রকম চিন্তা হলো। দেবাশীষকে বললাম আমার সাথে যেতে হবে। সে সানন্দে রাজি।
শুক্রবার সন্ধ্যায় যথাসময়ে তাদের বাড়িতে উপস্থিত হলাম আমরা। বাড়ির সামনে অভিবাদন জানালেন গৌরীর বাবা, ধুতি পরিহিত, গায়ে একটি কোড়াগেঞ্জি, মাথায় চুল হালকা, গলায় তুলসির মালা। বাড়ির ছোটো উঠোনে কীর্তনের আসর বসেছে। তিনি সসম্মানে বসার আসন করে দিলেন।
গৌরী খয়েরি রঙের একটি শাড়ি পরেছে আটপৌরে প্যাঁচে, কোমর পর্যন্ত ছেড়ে দেওয়া চুল, কপালে চন্দনের ফোঁটায় তাকে অপূর্ব লাগছে। সে এসে আমাদের পা ছুঁয়ে গড় হয়ে প্রণাম করলো।
মেয়েটির মা একটি বালতিতে জল নিয়ে এলো, তার গলায় শাড়ির আঁচল প্যাঁচানো, হিন্দুরীতিতে একে বলে গলায় বস্ত্র নেয়া। এটা পরম বিনয়ের চিহ্ন। গৌরীর বাবার গলা থেকেও এক টুকরো সাদা বস্ত্র উত্তরীয়ের মতো বুক বেয়ে নেমে এসেছে।
হিন্দু বাড়িতে প্রবেশের সাথে সাথে হাত পা ধোয়ার জল দেবার রীতি রয়েছে। কারণ শাস্ত্রে অতিথি হচ্ছেন স্বয়ং নারায়ণ। গৌরীর বাবা-মা সহসা আমার পা থেকে জুতা খুলে নিলেন, তারপর অন্য একটি পাত্রের মধ্যে নিয়ে ধুয়ে দিতে শুরু করলেন। বাধা দেবার সুযোগই পেলাম না। আমার পা ধোয়ানো শেষ হলে জলটুকু একটি ঘটিতে সংরক্ষণ করতে দেখলাম। একইভাবে দেবাশীষের পাও ধুয়ে দিলেন। শেষে নতুন গামছায় মুছে দিয়ে উভয়ে গড় হয়ে প্রণাম করলেন। আমরা খুবই বিব্রত হলাম। সদ্য লেখাপড়া শেষ করে চাকরিতে যোগদান করেছি। গৌরী হয়তো বয়সে আমাদের সাত-আট বছরের ছোটো হতে পারে। তার পিতা-মাতা গড় হয়ে প্রণাম করছে এ তো বিব্রত হবারই বিষয়।
এরপর দেখলাম গৌরীর বাবা-মা আমার পা ধোয়া সংরক্ষিত জল উভয়ে ভাগ করে পান করা শুরু করলেন। আমি হা হা করে উঠলাম, ‘কী করছেন আপনারা? নিজ হাতে পা ধুইয়ে দিলেন কিছু বলিনি, গড় হয়ে প্রণাম করলেন তাও মেনে নিলাম, কিন্তু এসব কী? আমার পা ধোয়া জল পান করছেন কেন?’

দুজন হাটু মুড়ে আমাদের সামনে বসলেন। দুহাতের জোড়ে গলার বস্ত্র ধরে গৌরীর বাবা যথাসম্ভব কৃষ্ণনগরী বাংলায় বিনীত ভঙ্গিতে বললেন, ‘কিছুদিন আগে ওর মা স্বপ্নে দেখেছে বাড়িতে গুরুভোজ না করালে মেয়ের অমঙ্গল হবে। তাই এই সাধুগোষ্ঠের আয়োজন। আমরা বৈষ্ণব, অতিথি আমাদের নারায়ণ। আর নারায়ণের চরণ ধোয়া জলই তো চরণামৃত। মনঃক্ষুণ্ন হবেন না।’
গৌরীর মা বললেন, ‘এই স্বপ্ন পরপর কয়েক রাত দেখেছি। গৌরীকে বললাম তোমার একজন গুরুকে বাড়িতে নিমন্ত্রণ করো। সে আপনাকে এনেছে। মেয়ের গুরু সে আমাদেরও পূজনীয়। গরিবের কুটিরে একটু প্রসাদ পেয়ে গেলে আমাদের মনোবাঞ্ছা পূরণ হয়।’
গৌরী পাশেই দাঁড়িয়ে ছিল।
সাধুগোষ্ঠ অর্থাৎ কীর্তন শেষ হলে কলার পাতায় প্রসাদ দেওয়া হলো। স্বাদে-গন্ধে অপূর্ব। আমরা তৃপ্তি করে খেলাম। খাবার পর পাতের অবশিষ্ট তারা নিয়ে গেলেন। আমরা বুঝলাম এই এঁটো খাবারও নারায়ণপ্রসাদ জ্ঞানে খাবেন। ফেরার সময় আবারও তারা প্রণাম করলেন। গৌরীর জন্য আশির্বাদ চাইলেন। আমরা ছোট মানুষ। তবুও আমি মুখে যথাসম্ভব গাম্ভীর্য এনে গৌরীর মাথায় হাত রাখলাম।
ফেরার পথে কেউ কথা বলতে পারলাম না। উভয়ের মনে এই ঘটনাটি স্থায়ী স্মৃতি হিসেবে দাগ কেটে রাখলো।

Facebook Comments Box

কপিরাইট © ২০১৭ - ২০২০ ।। বইদেশ-এ প্রকাশিত কোনও সংবাদ, কলাম, তথ্য, ছবি, কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না

Design & Development by: TeamWork BD