ভাষাচিত্র ঈদ সাময়িকী

জান্নাতুল ফেরদৌস-এর ছোটগল্প ‘নীল জামদানি’

শুক্রবার, ১৪ মে ২০২১ | ৯:১৭ অপরাহ্ণ | 507 বার

জান্নাতুল ফেরদৌস-এর ছোটগল্প ‘নীল জামদানি’

।। জান্নাতুল ফেরদৌস ।।


 

একটা কোচিং সেন্টারে পড়াতো তানভি। রোজ কোচিং-এ যাওয়ার সময় কাপড়ের মার্কেটের কাছ দিয়েই যেত। একদিন সুন্দর একটা ড্রেস দেখে চোখ আটকে যায়। কিন্তু মাসের শেষ। হাত ফাঁকা। পরের মাসেই সেমিস্টারের টাকা দিতে হবে। এসব ভাবতে ভাবতেই কোচিং-এ ক্লাস নিলো।
এমন কয়েকদিন ড্রেসটা দেখলো। একদিন সাহস করে দাম জানতে চাইলো। দোকানদার জানালেন দুই হাজার টাকা। চুপচাপ চলে এলো তানভি। তাকে কোচিং থেকে বেতন দেয় মাত্র তিন হাজার টাকা। পাশাপাশি আরও দুটো টিউশন ছিল। মাসের শেষে টাকা দিয়ে একটা টিউশন থেকে না করে দিলো। আগামী মাসে আর পড়বে না। টিউশনের টাকা নিয়ে সাথে সাথে সেই কাপড়ের দোকানে গেল।
তার এতদিনের কাঙ্ক্ষিত জামা কিনতে। অনেকটা দুঃসাহস করেই গেল।
কিন্তু জামাটা টানানো নেই। তানভি দোকানদারের কাছে জানতে চাইলো, ‘জামাটা কোথায়?’
‘বিক্রি হয়ে গেছে। একই ডিজাইনের আর নেই।’ দোকানদার জানালো।
প্রচণ্ড মন খারাপ করে বাসায় এলো তানভি। এমনিতে একটা টিউশন নেই। স্টুডেন্ট অসুস্থ ছিল তাই আর একটা টিউশনিতে প্রায় দশদিন যাওয়া হয়নি। কয়েকদিন পরে বেতন দিতে গিয়ে স্টুডেন্ট এর মা বললো, ‘এই মাসে টাকা একটু কম দিচ্ছি। টাকা-পয়সার সমস্যা তো।’
ব্যাপার বুঝতে বাকি রইলো না তানভির। ওই বন্ধের জন্যই টাকা কেটে নিলো। অথচ বন্ধের কারণ তানভির গাফিলতি নয়। স্টুডেন্টের অসুস্থতা। আবারও মন খারাপ করে বাসায় ফিরলো সে। মনে মনে ভাবলো এটাই মধ্যবিত্ত জীবন।

একদিন রকমারি থেকে কল এলো। ওরা বিশেষ ছাড়ে বই দিচ্ছে, অর্ডার করতে চাইলে করা যেতেই পারে। ফ্রি ডেলিভারিতে, প্রি-অর্ডার করতে হবে। পরের মাসে বই নেয়ার সময় টাকা দিলেই হবে। তানভি হাজারখানেক টাকার বই অর্ডার করে ফেললো। খুশিতে মন ভরে গেল তার। রাতে ঘুমানোর সময় ভাবলো আগের সেমিস্টারের কিছু টাকা বাকি, এইবার পুরোটা পরিশোধ না করলে পরীক্ষা দিতে দিবে না। পরদিন আবার ফোন করে অর্ডারটা বাতিল করে দিলো। মনে মনে ভাবলো, এটাই মধ্যবিত্তদের জীবন। সাধ আছে সাধ্য নাই।
সেমিস্টারে বকেয়া পরিশোধ করেও চলতি সেমিস্টারে আবার কিছু টাকা বাকি থেকে গেল। তার ওপরে এই মাসে লকডাউন দিয়ে দিলো। কোচিংও অফ করে দিলো। একটা টিউশন চলছে। রোজা রেখে প্রতিদিন পড়াতে যেতে ভালো লাগতো না তানভির। তবুও নিজের ইচ্ছের বিরুদ্ধে যেত। মাস পেরিয়ে নতুন মাসেরও ১০ তারিখ। তারা বেতন দিচ্ছে না। একদিন ছাত্রী বলল, ‘ম্যাম, আমি আজকে ঈদের শপিং করেছি। আপনাকে দেখাবো?’
তানভি চুপ করে রইলো? স্টুডেন্ট দুটো ড্রেস এনে খুলে দেখালো। তানভী শুধু জিজ্ঞাসা করলো, ‘কত নিছে?’
‘ম্যাম, আট হাজার পাঁচশ টাকা।’
তানভি আর কিছুই বলল না। ওর মা এসে দেখলো মেয়ে ড্রেস দেখাচ্ছে। মেয়েকে খুব ধমকালো। তানভী বুঝলো না এতে রাগের কী আছে? সেদিন আর পড়ানো হলো না। তানভি ভাবে, আহারে জীবন! শুধু টিচারের টাকা দেওয়ার সময়ই মানুষের টাকা থাকে না। অথচ তারও স্বপ্ন ছিল ছোটো ভাইবোনদের ইদে জামা কিনে দেবে।
পনেরো তারিখ পেরিয়ে গেল। বেতন দিলো না। সাহস করে তানভি ছাত্রীর মাকে বলল বেতনের কথা। সে বলল, ‘ঠিক আছে তোমার ভাইয়া আসলে জানাবো।’
দুটো টিউশন আর কোচিং মিলে দশ হাজার টাকার মতো আসতো। কিন্তু কেমনে কেমনে সব শেষ।
পরদিন ছাত্রীর মা জানালো, তারা এই মাসে অনেক খরচ করে ফেলেছে, বেতনটা দিতে পারবে না। আগামী মাসে একসাথে দেবে। তানভির চোখ ছলছল করছে। কী নিষ্ঠুর পৃথিবী! তার মনে হলো আর পড়াতে যাবে না। কিন্তু ঈদের পরই সেমিস্টার ফাইনাল। তখন পরীক্ষার টাকা লাগবে।
এভাবেই একটার পর একটা চাহিদা সামনে এসে হাজির হয়। অনেকদিনের স্বপ্ন একটা নীল জামদানি শাড়ির। ভেবেছিল এইবার কিনবেই। কিন্তু আফসোস, মধ্যবিত্তদের স্বপ্ন দেখতে নেই। হাতে টাকা হলেই বই কিনতো তানভি। এই মাসে টিউশন নেই, কোচিং নেই। ইউনিভার্সিটির বেতন দিতে পারছিল না। কী করবে? বাবার একার রোজগার, ছোটো ভাইবোনের লেখাপড়ার খরচ। এত কিছু ভেবে আর বাবার কাছে চাওয়ার সাহস হলো না, ফেসবুকে রিসাইকেল বিনে তার স্বপ্নের লাইব্রেরি করার জন্য কেনা বইগুলো বিক্রির জন্য পোস্ট করলো। মুহূর্তের মধ্যে সেল হয়ে গেল। কুরিয়ারে পাঠানোর সময় নিজের অজান্তে চোখ বেয়ে জল নেমে এলো। শখের বই। মধ্যবিত্তদের শখ থাকতে নেই।
কেনা হলো না শখের জামদানি। কেনা হলো না প্রিয় লেখকের বই। তবুও মনে হলো একদিন সব হবে। এই আশা নিয়েই আবার পথচলা শুরু।

Facebook Comments Box

কপিরাইট © ২০১৭ - ২০২০ ।। বইদেশ-এ প্রকাশিত কোনও সংবাদ, কলাম, তথ্য, ছবি, কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না

Design & Development by: TeamWork BD