ভাষাচিত্র ঈদ সাময়িকী

তাসলিমা খানম-এর ছোটগল্প ‘অপরাজিতা’

শুক্রবার, ১৪ মে ২০২১ | ১০:০৪ অপরাহ্ণ | 529 বার

তাসলিমা খানম-এর ছোটগল্প ‘অপরাজিতা’

।। তাসলিমা খানম ।।


 

মফস্বল ছেড়ে এই এত বড়ো শহরে ইউনিভার্সিটিতে ভর্তি হয়ে হঠাৎ বড্ড একা হয়ে গেলাম। সারাদিন মন কেমন খাঁ খাঁ করে। যখনই ভাবি এ অচেনা শহরে আমার পরিচিত কেউ নেই, তখনই একাকীত্ব পেয়ে বসে।
ক্লাস শুরু হওয়ার পর তবুও কিছুটা রক্ষা হলো। সারাদিন ক্লাসের ব্যস্ততা, লাইব্রেরিতে সময় কেটে যায় অনেকখানি। কিছু বন্ধুবান্ধবও জুটে গেল। কিন্তু চিরকালের খাপছাড়া স্বভাবের দরুণ কারও সাথে গলায় গলায় খাতির হলো না। যেখানে মেয়েদের আড্ডায় হাল আমলের পোশাক থেকে কার বয়ফ্রেন্ড কেমন- এসব আলাপ চলে, সেখানে আমার উপস্থিতি বড্ড বেমানান। সারা সপ্তাহে তিনটে থ্রিপিসেই চলে যায় আমার। ক্লাস শেষে রুমে এসে বইয়ে মুখ গুঁজে পড়ে থাকা- আমার রুটিন। ভাবছি এবার বাড়ি গেলে প্রিয় সাইকেলটা নিয়ে আসব। যদিও ওটা পুরনো হয়ে গেছে। তবুও কাজ চলে যাবে। বিকেলগুলো তাহলে আর বোরিং কাটবে না।

এখানে ছুটির দিনগুলো এত লম্বা কেন! অনেকটা চুইংগামের মতো। কিছুতেই শেষ হতে চায় না! আমার শুধু বাড়ির কথা মনে পড়ে। অফিস থেকে ফেরার পর বাবার হাতের ব্যাগটা নিয়ে আমাদের তিন বোনের কী টানাটানি! বৃষ্টির দিনে মায়ের হাতের খিচুড়ি! আহ্, জিভে জল চলে এলো। দুষ্টু, মিষ্টি বোনগুলো, নীল গেটের ওপরে হেলেপড়া মাধবীলতার গাছটা! পাশের বাড়ির রুপু, কলেজ মাঠে লাল ফুলে ছেয়ে থাকা সারি সারি কৃষ্ণচূড়া! ফেলে আসা সবকিছুর জন্যই খুব কান্না পায়! কবে লম্বা ছুটি আসবে। ফোনে সবার সাথে রোজ কথা বললেও, ছুঁয়ে দেখার তৃষ্ণা যায় না আমার।
অবশেষে একজন বন্ধু জুটে গেল- ইরা। ওকে প্রথমে একটু নাক উচু, বড়লোক বাপের পুতুপুতু টাইপের মেয়ে মনে হয়েছিল। লাইব্রেরিতে দু’জন পাশাপাশি সিটে বসায় প্রায়ই খেয়াল করতাম বইয়ের মধ্যে ডুবে আছে। এরইমধ্যে একদিন আমার টেবিলে এসে একটি বইয়ের ব্যাপারে জিজ্ঞেস করল, বইটি আমি পড়েছি কি না। যেই বললাম পড়েছি, শুরু হলো ওর গল্প। বইটি কেমন, কোন জায়গাটা বেশি ভালো লেগেছে, আরও কত কী। একে একে দুজনে বই বিনিময়, একই সাবজেক্টে পড়ায় একসাথে গ্রুপ স্টাডি করতে করতে কখন যে বন্ধু হয়ে গেলাম, নিজেরাও টের পাইনি। ইরাকে আমি যেমন ভেবেছিলাম, স্বভাবে পুরো উলটো। সারাক্ষণ হাসি, আড্ডা, দুষ্টুমিতে মাতিয়ে রাখতে পারে মেয়েটা।

ইরা বাসা থেকে রোজ একটা সাদা টয়োটায় ক্লাসে আসে। আর আমি থাকি হলে। ছুটির দিনগুলো তাই খুব একলা কাটে। মাঝেমধ্যে ইরা ওর বাড়িতে সবাইকে নিয়ে পার্টি দেয়। আমি এইসব পার্টিতে ঠিক মানিয়ে নিতে পারি না। নিজেকে বড্ড বেমানান লাগে। তাই আর যাওয়া হয় না। ইরা এজন্য প্রায়ই আমার ওপর রাগ করে। একদিন ক্লাস শেষে ইরা বলল, ‘নীলা টিউশনি করবি? আমার ফুপির মেয়ে জারা। ওর জন্য ফুপি একজন হাউজ টিউটর খুঁজছে। তুই পড়াতে পারিস, সময় ভালো কাটবে। ইউনিভার্সিটি থেকে বেশি দূরে নয় ওদের বাড়িটা।’
আমি দোটানায় পড়ে গেলাম। বাসা থেকে রাজি হবে কি না! আবার এমনও নয় টিউশনিটা আমার খুব দরকার। বাসায় বলার পর আম্মু একটু দোনোমোনো করলেও, আব্বু রাজি হয়ে গেলেন। মাকে বোঝালেন, ‘আমাদের মেয়েকে যথেষ্ট আত্মবিশ্বাসী এবং সাহসী করে বড়ো করেছি। সে যে কোনো পরিস্থিতির মোকাবিলা করতে পারবে।’
বাড়ির গেটে এসে আমি বিস্ময়ে বিমূঢ় হয়ে গেলাম। এত বিশাল বাড়ি! লোহার গেট পেরোলে দেখি দু’পাশে দেবদারু সারি সারি মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে। বাগানটায় এত ফুল ফুটে আছে, দেখেই মন ভালো হয়ে গেল। লাল ইটের রাস্তা পেরিয়ে যখন বারান্দায় উঠব তখন ওপরে ঝুলবারান্দায় তাকাতেই আমার অস্বস্তি শুরু হলো। কেতাদুরস্ত কেউ এমন দৃষ্টিতে কারো দিকে তাকাতে পারে, ভাবতে পারছিলাম না। নাকি আমারই বোঝার ভুল। এসব চিন্তা মাথা থেকে ঝেড়ে ফেলে সামনে তাকিয়ে দেখি পুতুলের মতো একটা বাচ্চা মেয়ের হাত ধরে দাঁড়িয়ে আছে রূপবতী এক নারী। মানুষ এত সুন্দর হয়! বয়স কত হবে! সম্ভবত আটাশ-ত্রিশ বছর। তিনি এগিয়ে এসে নিজের পরিচয় দিলে আমার চমক ভাঙ্গলো, ‘আমি সারা, জারার আম্মু। আমাকে সারা বলে ডাকতে পারো। তোমাকে তুমি করে বললাম।’
জারাকে পড়াতে ভালোই লাগছে। এইটুকুন মেয়ের পড়া আর কতটুকু! অধিকাংশ সময় ওর সাথে গল্প করে, ছবি এঁকেই কাটে। বাড়িটা এত নিশঃব্দ! সবগুলো লোক কেমন বেড়ালের মতো হাঁটে। মাঝেমধ্যে জারার আম্মু আসে। টুকটাক গল্প করে। তার মুখটা এমন বিষাদমাখা। প্রথম প্রথম খুব কথা বলতেন। ইদানীং প্রায়ই আমার সাথে এটা-সেটা নিয়ে গল্প করেন। যেই উনার হাসবেন্ড বাড়িতে ফেরেন, সাথে সাথে চোখ মুখ শক্ত করে উঠে চলে যান। প্রথমদিন যে ভদ্রলোককে ঝুলবারান্দায় দাঁড়িয়ে থাকতে দেখেছিলাম, তিনিই জারার বাবা। এখনও আসতে যেতে দেখা হলেই এমন বিশ্রীভাবে তাকান- আমার গা শিরশির করে। মাঝেমধ্যে ইচ্ছে হয় টিউশনিটা ছেড়ে দিই। কিন্তু জারার জন্য পারছি না। মেয়েটা এত ন্যাওটা হয়েছে আমার! প্রায়ই ওর জন্য এটা-সেটা নিয়ে যাই। ইদানীং সে নিজেই বায়না করে।

আরেকদিন শুনি ভেতর থেকে চিৎকার-চেঁচামেচি আসছে। ভেতরের শব্দ শুনে জারা ভয় পেয়ে আমার গায়ের সাথে লেপটে রইলো। অথচ বের হওয়ার সময় দেখে বাগানে জারার দাদী নির্লিপ্ত মুখে মালিকে বকাঝকা করছেন, বাগানে যত্ন হচ্ছে না বলে। ভদ্রমহিলা এখন অব্দি একটি কথাও বলেননি আমার সাথে। আমিও পাত্তা দেই না।
এক বিকেলে জারাকে পড়িয়ে বের হবো, এমন সময় শুনি বাড়ির ভেতর থেকে চাপা কান্না আর গোঙানোর শব্দ। ওপাশ থেকে কেউ একজন হিসহিসিয়ে বলছে, ‘চুপ, চুপ, একদম মেরে ফেলব।’
তাকিয়ে দেখি জারা ভয়ে কাঁপছে। আমার কী হলো জানি না! দুপদাপ হেঁটে সোজা বাড়ির ভেতর ঢুকে গেলাম। যে ঘর থেকে শব্দটা বের হচ্ছিল, সেই রুমের দরজা ধাক্কা দিয়ে ভেতরে ঢুকে দেখি জানোয়ারটা সারার গলা চেপে ধরেছে। পেছন থেকে একটা লাথি দিতেই হুমড়ি খেয়ে পড়ে গেল। প্রথমে ভ্যাবাচেকা খেয়ে গেলেও পরে আমার দিকে বিশ্রী একটা গাল দিয়ে তেড়ে আসতেই আবার দিলাম কষে এক লাথি। মনে মনে বাবাকে ধন্যবাদ দিলাম। ভাগ্যিস কারাতেটা শিখিয়েছিলেন। পুতুল করে গড়ে তুলেননি। সারা আমার দিকে লজ্জায় তাকাতে পারছেন না। ফেরার সময় বললাম, ‘লজ্জা করে না এ রকম জীবন কাটাতে? এর চেয়ে রাস্তায় যারা থাকে, তাদেরও একটা জীবন আছে।’

 

পাঁচ বছর পরে…
চাকরি এবং সংসার দুটোই শুরু হলো এই ঢাকাতেই। এক সকালে অফিসের বাস মিস করায় দ্রুত একটা সিএনজি ডাকতে যাব, এমন সময় এক নারী দশ এগারো বছরের মেয়ের হাত ধরে একই সিএনজিতে পড়িমরি করে উঠে পড়লেন। আমি একটু বিরক্ত হলাম। সিএনজিটা আমিই ডেকে থামিয়েছি। ড্রাইভার সেটা উনাকে বলতেই আমার দিকে তাকিয়ে সরি বলতে গিয়ে থেমে গেলেন। আমি বিস্ময়ে তাকিয়ে দেখি জারা আর ওর মা। বিস্ময় কাটিয়ে উঠতেই তিনজনই তড়িঘড়ি করে একই সিএনজিতে উঠলাম। আমার অফিসের পথেই পড়বে জারার স্কুল। তাছাড়া এই সময় সহজে আর গাড়ি পাওয়াও যাবে না। আমার অবাক হওয়ার আরও বাকি ছিল। পথে যেতে যেতে শুনলাম, সেদিনই মেয়েকে নিয়ে সারা ও বাড়ি থেকে বের হয়ে এসেছিলেন। কোনো বাধাই ওর পথ রোধ করতে পারেনি। তারপর অনেক কাঠখড় পুড়িয়ে একটা স্কুলে চাকরি নেন। মেয়েকেও আগের স্কুল ছাড়িয়ে নিজের স্কুলে ভর্তি করেছেন। সারার বাবা নেই। ভাইদের সংসারে গলগ্রহ হয়ে থাকতে চাননি। মা আর মেয়েকে নিয়ে আলাদা বাসা ভাড়া করে থাকেন।
আমার নতুন সংসারের গল্প, চাকরির জায়গা সম্বন্ধে খুব আগ্রহ করে জানতে চাইলেন। আর আমি মন্ত্রমুগ্ধের ন্যায় তাকিয়ে আছি আত্মবিশ্বাসী, অতুলনীয় ব্যক্তিত্বের অধিকারী সারার দিকে। ওর চোখের দিকে তাকিয়ে বুঝতে পারছি ভেতর বাহিরে কতটা বদলেছে নিজেকে। আজকের সারা মানুষ হিসেবে স্বয়ংসম্পূর্ণ। আমি মনে মনে তাকে একটা স্যালুট দিলাম। তিনি কী সেটা বুঝতে পারছেন! মনে হয়, কারণ আমার দিকে তাকিয়ে স্মিত হেসে আমার হাতটা শক্ত করে মুঠোয় ভরে নিল। একইসময় জারা আমাদের দুজনকে দুহাতে জড়িয়ে ধরলো। তিনজন আত্মবিশ্বাসী নারীকে নিয়ে সিএনজি এগিয়ে চলছে গন্তব্যের দিকে।

Facebook Comments Box

কপিরাইট © ২০১৭ - ২০২০ ।। বইদেশ-এ প্রকাশিত কোনও সংবাদ, কলাম, তথ্য, ছবি, কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না

Design & Development by: TeamWork BD