।। গাজী হেলাল উদ্দিন ।।
হঠাৎ কোনো যুক্তিসঙ্গত কারণ ছাড়াই মরে যেতে হবে ভাবিনি। অকস্মাৎ মৃত্যু চলে এলো আমার দোর গোড়ায়। এমনটা কখনও ভাবিনি। মৃত্যু নিয়ে বরাবরই ছিলাম খুব আবেগী। জানতাম মৃত্যু আসবেই। তাই বলে এভাবে কাপুরুষের মতো?
কত সাধ করে ঘন বরষায় মৃত্যুকে বরণ করতে চেয়েছিলাম। স্বেচ্ছায় বরণ করে তাকে হারাতে চেয়েছি। কিন্তু মৃত্যু আমাকেই বরণ করে নিলো! এই তীব্র শীতের মাঝে এসে আমাকে নিয়ে রীতিমত উপহাসে মেতে উঠল। জন্ম মানুষের হাতে থাকে না কিন্তু চাইলেই মানুষ মৃত্যুটা ইনজয় করতে পারে। একবার ভাবুন তো মৃত্যু এমন একটা অ্যাডভেঞ্চার যার মধ্যে দিয়ে আপনি পৌঁছে যাবেন চেনা জগত থেকে অচেনা জগতে। এর চেয়ে বড় অ্যাডভেঞ্চার আর কী হতে পারে? তবে আমাকে সে হতাশ করল করুণভাবে।
তবে মৃত্যুপরবর্তী জগতটা কিন্তু অন্ধকার নয়। এই জগতটা সাদা। এখানে এসে নিজেকে খুব হালকা লাগছে। পৃথিবীতে জীবিত থাকার স্মৃতিগুলো ফিকে হয়ে যাচ্ছে। হয়তো একসময় সকল অতীত ভুলে যাব। আমি তারই অপেক্ষায়। অতীতকে মনে রাখা মানেই হলো মায়া বাড়ানো। মায়া ভীষণ ভয়ংকর জিনিস। মৃত্যুর পরের জীবনটাও চাইলে আমি এনজয় করতে পারি। তাই অতীতের জন্য বর্তমানকে নষ্ট করার কোনো মানে হয় না। আর আমার বর্তমান হলো এই মৃত্যুপরবর্তী জীবন। আমি কী এখনও পৃথিবীতেই আছি নাকি অন্য কোথাও আছি তা বুঝতে পারছি না। তবে এক ভয়াল শূন্যতার মধ্যে আছি। আমার আশেপাশে কাউকেই দেখতে পাচ্ছি না। হঠাৎ একটা অবয়ব ভেসে এলো আমার সামনে। তার কোনো শরীরী অস্তিত্ব নেই। শুধু ছায়া ছাড়া তার আর কোনো অস্তিত্ব নেই। মুখোমুখি হয়ে পুরুষ কণ্ঠে বলল- তুমি কি নতুন?
ও আচ্ছা এ কথাও বলতে পারে তাহলে, ভাবলাম। নতুন মানে?- জিজ্ঞাসা করলাম আমি।
– মানে, তুমি কি মাত্রই মারা গেছো?
– হ্যাঁ। কিন্তু তুমি জানলে কী করে?
– কারণ আমিও মৃত। মারা গেছি দুই হাজার বছর আগে।
– মৃতরা কথাও বলতে পারে?
– মৃতরা সবই পারে। আজকাল সন্তানও জন্ম দিচ্ছে। এখানে আরও একটা সুবিধা আছে?
– কী?
– এখানে সন্তান জন্ম দিতে বিয়ে করার দরকার পড়ে না। দুজন চাইলেই ইচ্ছেমতো গণ্ডায় গণ্ডায় জন্ম দিতে পারে। সময়ও কম লাগে। প্রতি একমাসে দুইটা করে বাচ্ছা দেয় নারীরা।
– বলেন কী মশাই! এটা তো ছাপার মেশিনের চেয়েও ফাস্ট।
– তাহলে আর বলছি কি?
হঠাৎ লক্ষ করলাম অবয়বের ছায়া থেকে শরীর বেরিয়ে আসছে। সে পুরোপুরি নগ্ন। বললাম- আরে আপনার শরীরে তো কোনো পোশাক নেই।
– আরে মশাই মৃত্যুর পর মানুষের লজ্জাবোধ থাকে না। যেমনটা থাকে না জন্মের সময়, শিশুকালে।
হঠাৎ লক্ষ্য করলাম আমি নিজেও নগ্ন।
সে বলল- তা মশাই আপনার নাম কী?
– জিহাদ। আপনার?
– আমার কোনো নাম নেই।
– কেন?
– কারণ আমি কোনো মানুষ নই।
– তাহলে আপনি কি?
– আমি দেবতা অংশুদেব।
– আপনি কোন ধর্মের দেবতা?
– মানু ধর্মের।
– কিন্তু আমি তো ভানু ধর্মের অনুসারী।
– বাছা মৃত্যুর পর আগে যে দেবতা দেখে আত্মা ওই দেবতার হয়ে যায়।
– এটা অন্যায়।
– দেবতারা কখনও অন্যায় করে না। তারা শুধু অন্যায়ের বিচার করে। এখন কোনো কথা না বলে চলো আমার সাথে।
– না, যাব না আপনার সাথে। আমি আমার দেবতা রুধিষ্টির জন্য অপেক্ষা করব। তিনি নিশ্চয়ই এই পাপীকে দর্শন দেবেন।
– তুমি ভুল করছো বৎস। তিনি কখনও আসবেন না। কারণ তোমার ওপর তার আর কোনো অধিকার নেই। তুমি এখন আমার। আর এখন যদি তুমি আমার সাথে না যাও তাহলে চিরতরে এই শূন্যতার বাসিন্দা হয়ে যাবে। তোমার আগেও এমন বোকামি একজন করেছে। সে অবশ্য আমার অনুসারী ছিল। কিন্তু তাকে প্রথমে দেখেছিল রুধিষ্টির। তাই আইনিভাবে সে তার হয়ে যায়। কিন্তু সেও তোমার মতো তার সাথে না গিয়ে এই শূন্যে আটকে যায়। তার নাম ছিল রনিতা।
– কী নাম বললেন?
– রনিতা। চেনো নাকি?
– হ্যাঁ। আমার স্ত্রী। একবছর আগে ও মারা গিয়েছিল।
– তাইতো ভাবি তোমাদের মধ্যে এত মিল কী করে! তা তোমরা স্বামী-স্ত্রী অথচ দুজনের ধর্ম আলাদা কেন?
– আমরা দুজনে ভিন্ন ধর্মে বিশ্বাসী ছিলাম। রনিতাও কি এই শূন্যে আটকে আছে?
– হ্যাঁ।
– আমি কী তার সাথে দেখা করতে পারি?
– পারো তবে সে জন্য আরও বারো বছর অপেক্ষা করতে হবে। এই বারো বছর যদি রনিতা ও তোমার মাঝে এই শূন্যতায় অন্য কেউ আটকে না যায় তাহলে তোমাদের দেখা হবে। তোমরা আবার আগের মতো একসাথে থাকতে পারবে। তবে এই শূন্যতার বাইরে যেতে পারবে না।
– ওকে আমি রাজি। রনিতার জন্য অনন্তকালও অপেক্ষা করতে পারি।
– আচ্ছা। তোমার জন্য শুভকামনা। এই বলে দেবতা অংশুদেব প্রস্থান করল।
শূন্যতায় সময়ের হিসেবটা বোকামি। তাই দেবতা অংশুদেবের দেওয়া বারো বছর আসলে একটা ভ্রান্তির হিসেব। এই সময়ের আসলে কোনো শুরু কিংবা শেষ নেই। এটা দেবতাদের ছলনা ছাড়া কিছুই নয়। জিহাদ রনিতার জন্য অসীমকাল অপেক্ষায় কাটাতে লাগল।
কপিরাইট © ২০১৭ - ২০২০ ।। বইদেশ-এ প্রকাশিত কোনও সংবাদ, কলাম, তথ্য, ছবি, কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না
Design & Development by: TeamWork BD