পাঠকের কাছে প্রকাশনা শিল্পের দায়ভার
মোস্তফা সেলিম
পাঠক তিনিই, যিনি পড়েন। বই না পড়েও অনেকে বই কেনেন। ঠেকায় পড়ে, নয়তো নিজেকে সংস্কৃতিবান হিসেবে জাহির করার মতলবে। অফিসে, বাসায় একটি বইয়ের সংগ্রহশালা না থাকলে বাণিজ্যবুদ্ধির মানুষের চলে! চলে না। বই তাদের কাছে শোপিসের মতো। সাজিয়ে রাখার বস্তু। অন্যকে দেখানোর উপকরণ। মূর্খতাকে ঢেকে রাখার ফন্দিমাত্র। এদের কথা বাদ দিলেও সমাজের ক্ষতিবৃদ্ধি হয় না। তবে আনন্দের কথা যারা বই কেনেন, তাদের বড় অংশই বই পড়েন। পড়েন বলে এখনও সমাজে মানুষের মধ্যে সুকুমারবৃত্তি এবং মননচর্চার জায়গাটা একবারেই অন্ধকারময় হয়ে যায়নি।
অমর একুশে গ্রন্থমেলায় তাই পাঠকের উপচেপড়া ভিড় হয়। প্রকাশকের স্টলে স্টলে পছন্দের নতুন বইয়ের খোঁজে ঘুরে বেড়ান তারা। হরেকরকমের রুচির পাঠকের বিচিত্র আগ্রহের বিষয়ে লেখকেরা নানারকম পাণ্ডুলিপি তৈরি করেন। প্রকাশকের হাতে গ্রন্থ নির্মিত হয়ে এগুলো আসে পাঠকের সামনে। প্রকাশক এই আয়োজনের মাধ্যমে পাঠকের প্রতি কতটাই দায়শোধ করতে সক্ষম হন, নাকি কেবল মুনাফাই তার লক্ষ্য। তার প্রকাশিত বইগুলি কি পাঠকের রুচি তৈরি করে। নাকি পাঠকের রুচির কাছে লেখক প্রকাশক অসহায়ভাবে আত্মসমর্পণ করেন, এটাই বিবেচ্য হয়ে উঠেছে এ-শিল্পের জন্য। পাঠক প্রকাশক-লেখককে প্রভাবিত করেন, নাকি প্রকাশক পাঠককে প্রভাবিত করেন, এই বিতর্কটি ডিম আগে না মুরগি আগের মতো সমান্তরালে চলে আসে। সংস্কৃতি সংগঠন ‘ঘাসফুলে’র এরকম একটি অনুষ্ঠানে মডারেটর হিসেবে কাজ করতে গিয়ে এই বিষয়ে তুমুল বিতর্ক দেখেছি। পাঠক, লেখক এবং প্রকাশকের অবস্থানে দেখেছি পরস্পর বিরোধী মতামত। পাঠক অবশ্যই ভালো মানের, নির্ভুল, সুসম্পাদিত এবং অবশ্যই সস্তায় পেতে চান তার পছন্দের বইটি। মোদ্দাকথা, এটাই পাঠকের প্রতি প্রকাশকের দায়বদ্ধতা। প্রশ্ন হচ্ছে সব পাঠকের রুচি তাহলে এরকম হয়? হয় না, এটা বুঝতে বিশারদ হওয়ার দরকারও পড়ে না। এত এত নিম্নমানের বই, বই হিসেবে চালিয়ে দেওয়া কাগজের বর্জ্যের গ্রাহক কারা? এরাও একশ্রেণির পাঠক। এরা সবকালেই ছিলেন, এখনও বহাল তবিয়তে আছেন। রুচিবান প্রকাশক যেমন আছেন তেমনই বোদ্ধা এবং রুচিসম্পন্ন পাঠকও ছিলেন এবং এ কালেও আছেন। বইয়ের মতো একটি সংস্কৃতিপণ্য মানুষের মধ্যে রুচির বিকাশ ঘটায়, জ্ঞানী করে তোলে এবং আলোকিত পথযাত্রায় বাতিঘর হিসেবে কাজ করে। এরকম একটি সংবেদনশীল বিষয়ে অপার উদাসীনতা আমাদেরকে ক্রমেই পেছনের দিকে টানছে। কোনোভাবেই এটা গ্রহণের সুযোগ নেই। রুচি এবং মননে পশ্চাৎপদতা একটি জাতির জন্য কম বড় ঘাতক নয়।
প্রকাশনাশিল্পের সাথে লেখকযুক্ততা প্রত্যক্ষ। তিনি পাঠকের জন্য লেখেন। কখনো স্বপ্রণোদিত হয়ে, কখনো বা প্রকাশকের তাগিদে। কখনো অপার আনন্দে। কখনো দায়ে পড়ে জীবিকার প্রয়োজনে, উপার্জনের জন্য। পাঠকের প্রতি দায়বদ্ধতা তাকেই প্রথম শোধ করতে হয়। চিন্তায় সৃজনে সুস্থতা তৈরিতে তাকেই প্রথমে দায়িত্ব নিতে হয়। কিন্তু এখানে সবাই সৎ ভূমিকায় নেই। মানহীন পাণ্ডুলিপি তো হরদমই প্রকাশিত হচ্ছে। মানহীন ঔষধ যেমন রোগীর শারীরিক সর্বনাশ ডেকে আনে, তেমনি মানহীন গ্রন্থ পাঠকের মনোবৈকল্য ঘটায়। তাকে চিন্তায় প্রতিবন্ধী বানিয়ে ফেলে। বলার অপেক্ষা রাখে না প্রকাশকেরাও এ দায়িত্ব পালনে ব্যর্থ। প্রকাশনাশিল্পে প্রকাশকের চেয়ে অপ্রকাশকও কম নয়। নূন্যতম প্রস্তুতি ছাড়া অনেকেই এ শিল্পের সাথে যুক্ত হয়েছেন। অনেকের প্রয়োজনীয় শিক্ষাদীক্ষাও নেই। মানহীন বই প্রকাশে অনেকের ভূমিকা থাকলেও এরা রয়েছেন এগিয়ে। প্রতিদিনই যাদের বই প্রকাশিত হচ্ছে তাদের একটা অংশই অলেখক, এ নিয়ে কারো কোনো সন্দেহ নেই। এদের বই প্রকাশ করে পাঠকের কাছে তুলে দিয়ে একপ্রকার অন্যায্য আচরণ করেন একশ্রেণির প্রকাশকেরা। যথাযথ মানে বই প্রকাশিত হলে একুশে বইমেলায় যত বই প্রকাশিত হয়, তার চারভাগের একভাগ বইও প্রকাশিত হত কি না সন্দেহ।
বইয়ের মানের প্রকৃত বিচারক পাঠকই। পাঠক লেখককে গ্রহণবর্জনের অধিকার রাখেন। তারপরও প্রকাশকের দায়িত্ব সবার আগে। বিপুল পরিমাণ মানহীন বইয়ের স্তূপে প্রকৃত বইটি বেছে নিতে পাঠকবিভ্রমে পড়তে দেখা যায় প্রায়শ। শুধুই যদি মানসম্পন্ন বই প্রকাশিত হতো, আমাদের প্রকাশনাশিল্পের প্রতি সমীহ বাড়তো পাঠকসমাজের।
মানহীন বই প্রকাশের এই মহাসমারোহের সময়ে প্রকাশকের দায়িত্বশীল ভূমিকা আশা করেন পাঠক। আখেরে পাঠকের প্রতিই তো প্রকাশনাশিল্পের দায়বদ্ধতা। এ শিল্পের তুলনা অন্য কোনো শিল্পের সাথে চলে না। প্রকাশনা একটি শিল্প যেখানে তার নেপথ্যের ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠানকে যুগপৎভাবে শিল্পকলা এবং উৎপাদনকে সমন্বয় করার দক্ষতা দেখাতে হয়। ওখানে প্রকাশককে জাতীয় আশা আকাঙ্ক্ষা, চেতনা, সুস্থতা, সৃজনশীলতা বিকাশে সক্রিয় ভূমিকা রাখতে হয়।
পাঠকের প্রতি দায়বদ্ধতা পালনে প্রকাশককে নিষ্ঠাবান এবং প্রতিশ্রতিশীল হতে হয়। একজন প্রকাশক যদি সমাজে মূল্যবোধ, মানবিকতা, মননচর্চা এবং সৃষ্ঠিশীল মানুষ তৈরিতে কোনো ভূমিকা রাখতে না পারেন, তবে তার ওখানে আসার উদ্দেশ্যই বৃথা।
মোস্তফা সেলিম : গবেষক ও প্রাবন্ধিক
কপিরাইট © ২০১৭ - ২০২০ ।। বইদেশ-এ প্রকাশিত কোনও সংবাদ, কলাম, তথ্য, ছবি, কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না
Design & Development by: TeamWork BD