কাদামাটির আরেক নাম বুলবুল চৌধুরী
।। মাহবুব রেজা ।।
এক
সবকিছুতে তার একটা নিজস্বয়ানা আছে। কথাবার্তা কি চলন-বলন, কি হাঁটাচলা- সবকিছুতেই।
তাঁর সঙ্গে ত্রিশ বছরের চিন-পরিচয়, জানাশোনা।
তাঁকে ঘিরে বিচিত্র অভিজ্ঞতা, বিচিত্র থেকে বিচিত্রতর আড্ডা।
এক অদ্ভুত কিসিমের মানুষ তিনি।
একটা মানুষ গোটা জীবন কোনো একটা কাজে থির না থেকে জীবনটা দিলেন কাটিয়ে।
কীভাবে কাটালেন?
সেও এক জাদু।
সেও এক সাহসিকতা।
সেও এক হ্যাডম- এসব জাদু, সাহসিকতা কিংবা হ্যাডম অনেকের নেই। এটা তাঁর মধ্যে আছে। একশ ভাগ আছে।
সারাক্ষণ এক ঘোরের মধ্যে থাকেন।
এরকম অনেকবার হয়েছে। মাঝেমধ্যে সামান্য বিষয়-আশয় নিয়ে নিজের বানানো রাগ-অভিমান করে তাঁর সঙ্গে একটু দূরত্ব বজায় রেখে চলেছি। দু’একদিন যেতে না যেতেই কীসের রাগ কীসের অভিমান? সব ভুলে তাঁর নম্বরে ফোন দিয়ে বসি। ফোনটা দু’একবার বাজবে, তারপর অন্য প্রান্ত থেকে কবেকার, কার জন্য রেখে দেয়া একাকী মায়ায় ভরা এক আর্দ্র গলার স্বর,
‘কী মিয়া কী মনে কইরা তালাশ করলেন আমারে?’
ফোনটা ধরে তিনি আর দশজন সাধারণত যা বলেন তিনিও তা বলতে পারতেন,
‘বলেন কী বলবেন।’
কিন্তু তিনি কখনোই তা করেননি আমার সাথে। তার ঐরকম কথা শুনে সব ভুলে যাই।
দুই
জীবনধারণে কোনোধরনের লুকোছাপা নেই, নেই ভানভণিতাও। তিনি যা তা-ই বলেন তা-ই প্রকাশ করেন। হয়তো রিকশা করে কোথাও যাচ্ছি। পাশের রিকশায় সুন্দরী নারী দেখলে নিষ্পাপ শিশুর মুগ্ধতা নিয়ে তিনি তা পর্যবেক্ষণ করেন। জিজ্ঞেস করলে উত্তর দেন,
‘কাদামাটি কাদামাটি।’
সুন্দরী নারীর সৌন্দর্যকে, রূপবিভাকে স্রেফ কাদামাটির সঙ্গে তুলনা করা আমি জীবনে সেই প্রথম শুনলাম। শুনে প্রায় স্তব্ধ হয়ে গেলাম। আরে, বলে কি! হ্যাঁ, এটা একমাত্র টুকা কাহিনি’র বুলবুল চৌধুরীর পক্ষেই সম্ভব।
তিন
একবার তাঁর সঙ্গে বাংলাবাজার থেকে পুরানা পল্টনের দিকে যাচ্ছি। গন্তব্য ধ্রুব এষের বাড়ি। জিপিওর সামনে আসতেই পুলিশের এক কম বয়সী সার্জেন্ট বেশ চৌকস ভঙ্গিতে আমাদের রিকশাকে থামিয়ে দিল।
বুলবুল ভাইয়ের দিকেই এগিয়ে এলেন ভদ্রলোক।
‘আপনার হাতে এসব কী?’
আমি দেখি বুলবুল ভাইয়ের হাতের মুঠোয় মাল মশলা।
সর্বনাশ! বুলবুল চৌধুরী তাঁর স্বভাবসুলভ ঢঙে ও নির্বিকার ভঙ্গিতে চলন্ত রিকশায় হাতের মুঠোয় গাঁজার গুঁড়ো সাইজ করে খালি সিগারেটে ভরছেন।
আমি ভড়কে গেলাম।
বুলবুল চৌধুরী খুব স্বাভাবিক কণ্ঠে পুলিশের সেই সার্জেন্টকে বললেন,
‘মিয়া এইটা হইল গাঞ্জা, শইলের বাত বেদনার লাইগা ভারি উপকারী।’
প্রকাশ্য দিবালোকে আইন প্রয়োগকারী সংস্থার একজন মানুষকে গাঁজা যে শরীরের জন্য ভীষণ উপকারী একটা উপাদান তার বয়ান করছেন তিনি।
বেচারা পুলিশ সার্জেন্ট একবার আমাদের দিকে তাকালেন। সম্ভবত সন্দেহজনক কিছু না পেয়ে সরে গিয়ে রিকশা ছেড়ে দিয়ে বললেন, একটু এদিক-সেদিক করেও এসব বানিয়ে খেতে পারেন।
বুলবুল চৌধুরী আর দশজন যেরকম নিত্যদিন বেঁচে থাকার জন্য ‘এদিক-সেদিক’ করেন তিনি তাও করতে পারেন না।
তিনি আশ্চর্যরকমের প্রকাশ্য।
চার
বুলু ভাই মানে আমাদের প্রিয় বুলবুল চৌধুরী।
আমাদের বুলবুল ভাই।
তাঁকে গত ত্রিশ বছর ধরে একইরকম দেখছি। তাঁর মধ্যে কোনোরকম পরিবর্তন দেখলাম না। হয়তো চাকরি ছেড়ে দিয়েছেন। আয়-রোজগার নেই তারপরও তাঁকে কখনো চিন্তিত দেখলাম না। হয়ত জিজ্ঞেস করলাম,
‘বুলবুল ভাই, কেমন আছেন।’
‘আছিরে ভাই এক পদ।’ কমন উত্তর তার।
জীবনধারণের প্যাঁচ-গোচে আমরা দুই পদ, তিন পদ চাই কি আরও বেশি পদে থাকলেও বুলবুল ভাই কিন্তু সবসময় এক পদেই জড়িয়ে আছেন।
বুলবুল ভাইয়ের এরকম অনেক মায়ায় বাঁধানো শব্দের ভাণ্ডার আছে। তাঁর কথা বলার ধরন-ধারণও আর দশজনের চেয়ে ভিন্ন। একটু আলাদা।
কতজন তাঁকে নিয়ে কত পদের কথা বলে। এসবে তাঁর কোনো কৈফিয়ত নাই। নির্বিকারই থাকেন। নিজের লেখা নিয়ে সার্বক্ষণিক তোলপাড়ে থাকেন। আর বুলবুল ভাই যে লেখেন তার ঢঙও একেবারে অন্যরকম। পুরনো প্রুফ কাটা কাগজের উলটো দিকে লেখেন। আর লেখেন সবসময় মেঝেতে বসে। বসার স্টাইলও দারুণ।
কীভাবে লেখেন তিনি?
দু’হাঁটুর মাঝখানে অদ্ভুত এক কৌশলে মনগড়া টেবিল বানান। তারপর সেই টেবিলের ওপর ঝুঁকে পড়ে ভারী পাওয়ারের চশমার ভেতর দিয়ে চোখ দুটোকে প্রায় চোখের বাইরে নিয়ে এসে লেখেন। বুলবুল ভাইয়ের হাতের লেখা প্রাচীন হিব্রু ভাষার ফর্মকেও বুঝি হার মানাবে। সব কম্পোজিটর তার হাতের লেখা বুঝতে পারেন না, ধরা তো পরের ব্যাপার।
বুলবুল ভাইয়ের যাবতীয় বিষয়ে আমার সীমাহীন কৌতূহল। কী খবর, কী করছেন, কী লিখছেন, আজ কী বাজার করলেন, দুপুরে কী দিয়ে ভাত খেলেন- ইত্যাকার নানান প্রশ্ন কখনো কখনো তাঁকে করি। একটা ব্যাপার আমি লক্ষ্য করেছি সব বিষয়ে বুলবুল ভাই আমাকে একটু বেশিই আশকারা দেন। এই আশকারার বিষয়টি নিয়ে শিল্পী ধ্রুব এষ বুলবুল ভাইকে মাঝেমধ্যে অনুযোগ করে, আপনেই তো অরে লাই দিয়া দিয়া মাথায় তুলছেন।
ধ্রুব’র কথায় তিনি হাসেন, আমি কি লাই দিমু মিয়া, অয় এমনেই আউরা…
বুলবুল ভাইয়ের ভাষায় আউরা মানে পাগলা। আউরা মানে দিলখোলা।
আমি মজা পাই।
হঠাৎ তাঁকে ফোন দিয়ে জিজ্ঞেস করি কেমন আছেন? ওপার থেকে তার আদি ও অকৃত্রিম উত্তর,
‘একে গুনগুণ দুইয়ে পাঠ…’
প্রশ্ন করলাম কী আর উত্তর পেলাম কী!
এই-ই হলেন বুলবুল চৌধুরী। তাঁর কথাবার্তার ঢগ এরকমই।
তাঁর এক কথার অনেক বুঝ।
এক কথার অনেক পাঠ।
এক কথার অনেক বেত্তান্ত…
বুলবুল চৌধুরী এরকমই। মানে সেম কালার সেম ডিজাইন।
সবার পক্ষে বুলবুল চৌধুরীর মতো এরকম সেম কালার সেম ডিজাইন হওয়া সম্ভব না। তাই-বা বলি কী করে! হওয়া যাবে কিন্তু সমস্যা ঐ একটাই। হয়তো কালারটা ঠিক থাকবে ডিজাইনটা ঠিক থাকবে না আবার ডিজাইনটা ঠিক থাকলে কালারের হদিশ পাওয়া যাবে না- এই তো। মানে বেঁচে থাকতে হলে সবকিছুর সঙ্গে মিলঝিল দিয়ে থাকতে হবে। জোড়াতালি দিয়ে থাকতে হবে। যেভাবে আমরা সবাই দিব্যি বেঁচে-বর্তে আছি।
কিন্তু বুলবুল চৌধুরী কখনোই এসব ঘেরাটোপ কিংবা ‘আপ-ঝাঁপে’র মধ্যে ছিলেন না। তিনি ছিলেন কাদামাটির মতো সুন্দর। তিনি এরকমই থাকবেন- এখানেই তাঁর সৌন্দর্য।
প্রথম দেখার দিন থেকে আমার কাছে বুলবুল চৌধুরী ছিলেন ঘোর লাগানিয়া বিস্ময় জাগানো এক চরিত্র। এতবছর হয়ে গেল, এখনও তিনি সেরকমই আছেন। এক বিন্দু কমতি নেই তার…
কপিরাইট © ২০১৭ - ২০২০ ।। বইদেশ-এ প্রকাশিত কোনও সংবাদ, কলাম, তথ্য, ছবি, কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না
Design & Development by: TeamWork BD