কান্না লুকাবেন না, মন খুলে কাঁদুন
।। বনানী রায় ।।
স্কুলে পড়ার সময় বাংলা দ্বিতীয় পত্রে একটি কারক বিভক্তি করতে দিতেন আমাদের শ্রদ্ধেয় শিক্ষক- ‘কান্নায় শোক কমে’। প্রশ্ন থাকত : এখানে ‘কান্নায়’ কোন কারকে কোন বিভক্তি? উত্তর লিখে দিতাম, অধিকরণ কারকে সপ্তমী বিভক্তি। আমাদের শ্রদ্ধেয় এবং সবার প্রিয় অরুণ স্যার শেখাতেন কোনো ক্রিয়াবাচক বিশেষ্য যদি অন্য কোনো ক্রিয়ার কোনোরূপ ভাবের অভিব্যক্তি প্রকাশ করে তবে তাকে ভাবাধিকরণ কারক বলে। ভাবাধিকরণ কারকে সবসময় সপ্তমী বিভক্তির (এ, য়, তে) প্রয়োগ হয় বলে একে ভাবে সপ্তমী বলা হয়। যেমন : কান্নায় শোক মন্দীভূত হয়। মন্দীভূত হওয়া অর্থ ক্ষীণ হওয়া বা কমে আসা। তখন উপরের বাক্যটির গূঢ় অর্থ বুঝিনি বা ভাবতে যাইওনি কখনো।
একটা স্মৃতি ছোটবেলায় মনে দাগ কেটেছিল প্রচণ্ডভাবে। গ্রাম সম্পর্কীয় এক দিদি তার মেয়েকে বেদম মারতে মারতে রাগে ফুঁসছেন আর মেয়েকে বলছেন, এখনই কান্না বন্ধ কর, কোনো শব্দ করবি না। এমনকি রাগে মুখও চেপে ধরেছিলেন আমার স্পষ্ট মনে আছে। পাঁচ কি ছয় বছরের শিশুটির এক পর্যায়ে হেচকি উঠে যায়। কোনো দুর্ঘটনা ঘটার আগে অন্যরা এসে মাকে থামায়। জানি না দিদির সেই উন্মত্ত রাগের কারণ কী ছিল। তবে আমার শিশুমনে ভীষণভাবে দাগ কেটে গেল দৃশ্যটা। আমি তখন ভয়ে ঠক ঠক করে কাঁপছিলাম। পরে মাকে বলেছিলাম ঘটনাটা। মা কী বলেছিলেন ঠিক মনে নেই, তবে দিদির উপর বিরক্ত হয়েছিলেন এবং পরবর্তীতে আমি দেখেছিলাম আমার মা ঐ দিদির সাথে এ ব্যাপারে কথা বলেছিলেন। এই ঘটনার পর থেকে দিদিকে আমার পাষণ্ড মনে হতো। তবে তাকে আমার পাষণ্ড মনে করার পেছনে সন্তানকে শাসন করা বা মারার কারণ ছিল যতটা, তার চেয়ে তাকে কাঁদতে না দেওয়ার কারণ ছিল ঢের বেশি।
যত বড় হয়েছি, সবার কাছ থেকে শুনেছি কান্না লুকিয়ে রাখতে হয়। মানুষের সামনে চোখের জল ফেলতে হয় না। নিজের চোখের জল শুধু নিজে দেখবে, অন্যরা দেখবে না। দুর্বল মানুষ কাঁদে বেশি। এই জাতীয় বাক্যগুলি শুনে শুনে এটিই মনে গেঁথে গেল, কারো সামনে কাঁদলে দুর্বলতা প্রকাশ পায়। কাঁদতে হয় চুপি চুপি, নীরবে, একা। কী নির্মম নিয়ম! এই অলিখিত নিয়ম আরও নির্মম পুরুষদের ক্ষেত্রে। মেয়েদের মতো কাঁদতে হয় না। পুরুষ মানুষের কাঁদতে নেই বা কেমন পুরুষ, মেয়েদের মতো ফ্যাচ ফ্যাচ করে কাঁদে – এ জাতীয় কথা পুরুষদের ছোটবেলা থেকে কান্না লুকোতে অনেকটা বাধ্য করে।
যখন কলেজে পড়ি আমার প্রিয় বিষয় ছিল মনোবিজ্ঞান। তখন আমি জানলাম, আমরা যখন খুব বেশি পরিমাণে আবেগঘন হয়ে পড়ি তখন আমাদের দেহের ভেতর বেশ কিছু প্রতিক্রিয়া দেখা যায়। এই অতি আবেগের ফলস্বরূপ কিছু রাসায়নিক পদার্থ ও হরমোন নিঃসরণ হয় দেহের বিশেষ অংশ থেকে। যা আমাদের দেহের স্বাভাবিক অবস্থার চেয়ে বেশি। এই অতিরিক্ত রাসায়নিক পদার্থ ও হরমোন আমাদের দেহে এক ধরনের অস্বস্তি তৈরি করে। তারই ফলস্বরূপ চোখের ল্যাক্রিমাল গ্রন্থি থেকে পানি/জল বের হয়ে আসে। তখন আমার মনে হল কান্না তো দুর্বলতা নয়। এটি একটি স্বাভাবিক শারীরিক প্রক্রিয়া।
নারীদের তুলনায় পুরুষরা কম আবেগপ্রবণ। তাই পুরুষরা কম কাঁদেন। তবে এর কিছু বৈজ্ঞানিক ভিত্তি আছে। পুরুষের মধ্যে বিশেষ টেস্টোস্টেরন রয়েছে, যা চোখের জল আটকাতে সক্ষম। অন্যদিকে নারীদের ক্ষেত্রে রয়েছে অনেক বেশি প্রোল্যাক্টিন যা অশ্রু বা চোখের জল তৈরি করতে সাহায্য করে। এটি আমি মেনে নিলাম। নারীদের তুলনায় পুরুষের আবেগ কম তাও মেনে নিলাম। কিন্তু যতটুকু আবেগ পুরুষ ধারণ করে, তার বহিঃপ্রকাশ ঘটাতে গেলে হেয় হতে হবে- এটি মানবো না। পুরুষ বলে তার কি আবেগ থাকতে নেই? সে কি স্বাভাবিক মানুষ নয়? কেন সে প্রকাশ্যে কেঁদে তার শোক লাঘব করতে পারবে না?
মানুষ যখন কাঁদে তখন চোখের জলের সাথে তার মস্তিষ্ক থেকে স্ট্রেস, হতাশা, উদ্বিগ্নতা ও অনুশোচনা বের হয়ে আসে। কান্না আত্মাকে পরিষ্কার করে, মনকে সমৃদ্ধ করে এবং স্ট্রেসের ফলে সৃষ্ট নেতিবাচক আবেগকে দূর করতে সাহায্য করে। কান্নার মাধ্যমে বিষাক্ত পদার্থ দূর হয়ে যায়। দৃষ্টিশক্তির উন্নতিতে সাহায্য করে। এত উপকারিতা থাকা সত্বেও কান্না পেলে কাঁদব না কেন, বলুন তো?
আমরা সবসময় শুনে এসেছি, কান্না হলো দুর্বলতা। তাই দুর্বলতা লুকিয়ে রাখতে আমরা কান্না লুকিয়ে রাখার চেষ্টা করি। নিজেকে সবল ভেবে তৃপ্ত হই। কিন্তু কান্না কোনো দুর্বলতা নয়। বরং কান্না একজন মানুষের অনুভূতির প্রকাশ। আমরা মানুষ, আমাদের অনুভূতি আছে, আমরা অনুভূতিশূন্য কোনো জড় পদার্থ নই। কান্নাকে লুকিয়ে বা চেপে রেখে হাসিমুখে থাকলে সবাই বাহবা দেয়। কিন্তু কান্না লুকিয়ে রাখা তার ওপর কতটা নেতিবাচক প্রভাব ফেলতে পারে সেটি আমরা জানি কি? মানুষের চূড়ান্ত আবেগকে লুকিয়ে রাখাটা তার শারীরিক মানসিক দুইয়ের জন্যই মারাত্মক ক্ষতিকর। চিকিৎসকেরা বলছেন, দীর্ঘদিন না কাঁদার ফলে ড্ৰাই আই বা শুষ্ক চোখের সমস্যা দেখা দিতে পারে। জানা গেছে, চোখের সবচেয়ে ক্ষতিকর রোগগুলির মধ্যে একটি হলো এই ড্ৰাই আই ডিজিজ এবং মহিলাদের তুলনায় পুরুষদেরই এই রোগে আক্রান্ত হওয়ার আশংকা বেশি।
চিকিৎসকের জানাচ্ছেন, বিশ্বের প্রতি ২০% মানুষের চোখে তৈরি হওয়া জলের পরিমান স্বাভাবিকের থেকে অত্যন্ত কম। তবে কোন কারণের জন্য তারা কাঁদতে পারেন না তা জানার জন্য চলছে গবেষণা। সময়মতো এই রোগের চিকিৎসা না করলে চোখের ক্ষতি তো হবেই এমনকি অন্ধত্ব পর্যন্ত আসতে পারে। দিনের পর দিন এই ড্ৰাই আইয়ের সমস্যা বেড়ে চলেছে বলে জানাচ্ছেন চিকিৎসকগণ। তাই আজকাল চিকিৎসকেরা নিজেরাও রোগীদের পরামর্শ দিচ্ছেন প্রাণ খুলে কাঁদার জন্য। আমরা হাসির সময় যেমন মনপ্রাণ খুলে হাসি, হাসিকে যেমন চাপা দেওয়ার চেষ্টা করি না সেরকমই সবার উচিত কান্না পেলে মনপ্রাণ খুলে কাঁদা।
চোখের জল চোখ থেকে ধুলোবালি এবং ধোঁয়া বের করতে সাহায্য করে অর্থাৎ চোখকে পরিষ্কার রাখতে সাহায্য করে। চোখকে ভেজা রাখে এবং ইনফেকশনের হাত থেকে চোখকে রক্ষা করে।
কান্নার মধ্য দিয়ে নিজেকে শান্তি দেয়া যায়। বুক থেকে এক ধরনের চাপ কমে যায়। নিজের দুঃখবোধ বা কান্নাকে লুকিয়ে রাখলে নিজের সাথে নিজের প্রতারণা করা বা ধোঁকা দেওয়া হয়। নিজের শরীরের ও মনের ক্ষতি আহ্বান করা হয়। মানুষ কান্নার সময়ে যতবার ফোঁপাবে ততবার মুখের মাধ্যমে বাতাস তার শরীরে প্রবেশ করবে ফলে ঠান্ডা বাতাসের প্রভাবে মস্তিষ্ক ঠান্ডা হবে। ভাবুন তো, এর পরও কান্না চেপে রাখব?
একটি কু-সংস্কার আছে। কান্না সংসারে অমঙ্গল বয়ে আনে। এটি আপাদমস্তক একটি চাপিয়ে দেয়ার কৌশল বা মানসিক চাপ। কান্না মানুষের মনের এবং শরীরের একটি স্বাভাবিক প্রক্রিয়া, যা আবেগকে প্রকাশ করে। মানুষের কোনো কারণে যদি দুঃখবোধ হয়, কাঁদলে- না দুর্বলতা প্রকাশ পায়, না অমঙ্গল হয়। তাই কান্না লুকিয়ে রাখবেন না, চেপে রাখবেন না। মনে রাখবেন নিজের দুঃখবোধ বা কান্না লুকিয়ে রাখলে আপনি নিজেই নিজের সাথে প্রতারণা করছেন। অন্যের কথার গুরুত্ব বেশি দিচ্ছেন। আপনি মানুষ। মানুষের যেমন সুখে আনন্দ করার অধিকার আছে তেমনি দুঃখে কান্নার অধিকার আছে। কান্না আপনার দুর্বলতা প্রকাশ করে না বরং আপনিই মানসিকভাবে বেশি শক্তিশালী। আপনি আপনার দুঃখের আবেগকে প্রকাশ করতে ভয় পান না- সেটিই প্রমাণ করে।
কপিরাইট © ২০১৭ - ২০২০ ।। বইদেশ-এ প্রকাশিত কোনও সংবাদ, কলাম, তথ্য, ছবি, কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না
Design & Development by: TeamWork BD