একজন কবির মৃত্যুরহস্য
।। হোসেন শহীদ মজনু ।।
—
কবিতার জন্য আরাধনা
স্বাস্থ্যবান। লম্বায় খাটো। বয়স তিরিশের কোটায়। তার ভাবনার বিষয়বস্তু অনিবার্যভাবে কবিতা! কেননা তিনি একজন কবি। নাওয়া-খাওয়ার বাইরে তার সমস্ত সত্তায় কবিতার বসবাস। কিন্তু মাথার মগজে আর টেবিলের ডায়েরিতে হাজারও কবিতার ছড়াছড়ি থাকলেও প্রকাশের সংখ্যাটা খুবই নগণ্য। না, দেশের জাতীয় দৈনিকগুলোর কোনোটিতেই তার কবিতার ঠাঁই হয়নি। মফস্বলের একটা সাপ্তাহিক আর তৃতীয় শ্রেণির কয়েকটা দৈনিক অবশ্য সাগ্রহে তার কবিতা ছাপে। এসব নিয়ে যে তার খুব বেশি আফসোস আছে তেমনও মনে হয় না। এ মুহূর্তে তিনি একটি নতুন কবিতা নিয়ে ভাবছেন। কীভাবে এর শরীর নির্মাণ করা যায়; বর্ণ থেকে শব্দ; শব্দ থেকে অর্থবহ ব্যঞ্জনা-সুর; চোখের তারায় জ্বলজ্বল করা একটা নিপাট কবিতা-কাঠামোকে কালির আঁচড়ে কাব্যময় করার ঘোর তৈরি হচ্ছে…। কবির চোখ বন্ধ; ভাবনাগুলো শব্দে রূপ পাচ্ছে না; সামনের টেবিলে খোলা ডায়েরির ওপর নিস্ক্রিয় কলম।
ফ্লাশ ব্যাক
সাম্প্রতিক সময়ে দেশে নতুন পত্রিকা প্রকাশের যেন প্রতিযোগিতা শুরু হয়েছে। দু-তিনমাস পর পর একটা দুটো দৈনিক আত্মপ্রকাশ করছে। এগুলোর দু-একটি আবার খুব দ্রুততার সঙ্গে প্রথম শ্রেণির তালিকাভুক্তও হচ্ছে। কবিতার বাইরে মাঝে-মধ্যে এসব নিয়েও কবিকে ভাবতে হয়! কেননা নতুন কোনো পত্রিকা প্রকাশের খবর পেলেই তিনি সন্তর্পণে একটি আকাঙ্ক্ষার দীপে অগ্নিসংযোগ করেন! এবার বোধহয় নতুন পত্রিকাটিতে তার একটি কবিতা ছাপা হবে! কিন্তু সে প্রত্যাশার পেলবভূমিতে ক্ষতই সৃষ্টি হয়েছে বারবার। তাই কোনো এক বুধবারের সকালে দৈনিক সমকণ্ঠ পড়তে গিয়ে নতুন আর একটি প্রকাশিতব্য দৈনিকে খবর তার সেই ক্ষতে যেন লবণ ছিটিয়ে দিল! এরপরও কি কবিতাময় কবির নিজের অজান্তেও মনে দানা বাধে-প্রত্যাশা নামক প্রপঞ্চের অলীক বীজ! -আগামী মাসের প্রথম দিনে যে দৈনিকটি প্রকাশিত হবে তাতে বোধহয় তার একটা কবিতা ছাপা হবে! আর সত্যি সত্যি যদি তেমনটা হয়…। এরপর তার সেই কবিতা নিয়ে অন্য কোনো পত্রিকায় একটু সমালোচনা-আলোচনা বেরুলেই তথাকথিত কবির স্বীকৃতিটাও হাতের মুঠোই আসে! সেটা কী খুব জরুরি?
কবিতার জন্য আরাধনা – ২
অনেক সময় চলে গেছে। কবির হাতে এখন বন্ধ ডায়েরি। সামনের টেবিলে বিক্ষিপ্ত কিছু কাগজপত্র। অন্যদিকে তার ভ্রুক্ষেপ নেই। তিনি কবিতার বিষয়বস্তু নিয়েই চিন্তাচ্ছন্ন। তার চিন্তাকে কবিতায় রূপ দেওয়ার আগে মনের ভেতর একটা চিত্রকল্প আঁকতে চেষ্টা করেন। -কবিতাটি অত্যন্ত সরল; সাবলীল গতিময়তার বিন্যাসে লিখবে। লেখার প্রতিটি শব্দে বিষয়বস্তুর আদল ফুটে উঠবে। কবিতাটির বিষয়বস্তু হবে-একটা চেয়ার পড়ে আছে। পাশে পড়ন্ত বিকেলে যেমন মানুষের দীর্ঘ ছায়া পড়ে ঠিক তেমন একটি ছায়া। কিন্তু মানুষটি দৃশ্যমান নয়। এই যে দৃশ্য-অদৃশ্যের চিত্ররূপ-একেই তিনি কবিতায় বিন্যস্ত করতে চান। এই চিত্রকল্পই হবে তার কবিতার অঙ্গসৌষ্ঠব।
ফ্লাশ ব্যাক – ২
‘আধুনিক হও। আর কত রাবীন্দ্রিক কিংবা নজরুলীয় ধাঁচে লিখবে।’
‘চেষ্টা তো কম করছি না দোস্ত। তোদের সঙ্গে এখানটায় বোধহয় আমার মিলবে না।’
‘আরে না, মিলবে মিলবে। আজিজ মার্কেটে এসো।’
‘আমার যে ভাল্লাগে না।’
‘আসো, আড্ডা দাও ভাল্লাগবে। প্রতিদিন জিনিয়াসদের পাশাপাশি ঘুরলেও একটা আঁচ পাবে।’
কবিবন্ধুদের ব্যঙ্গ-বিদ্রুপ আকণ্ঠ পান করে! তারপরও কবি আজিজ মার্কেটের আড্ডায় সময় কাটাতে পারে না। শব্দ নিয়ে অহেতুক ছলচাতুরির খেলায় তার আকর্ষণ জন্মে না। কবি-বন্ধুদের লম্বা চুল আর কথার তুবড়িতে তাকে বড় বেমানান লাগে! তাদের জটিল জটিল শব্দ বিন্যাসের খটমটো কবিতার কোনো অর্থও করতে পারে না। কবিতার ব্যাপারে তার একটা সুচিন্তিত মতামত আছে। কবিতা হবে বাস্তবতার আলোকে। আধুনিক কবিতায় এই বাস্তবতার খণ্ডচিত্র তাকে কষ্টের বেনোজলে ভাসায়।
কবিবন্ধুদের জন্য কবির দুঃখ হয়। তিনি একদিন এ বিষয়ে একটি গুরুগম্ভীর লেখাও লিখে ফেলেন। যথারীতি বন্ধুরা কবিকে তাচ্ছিল্য আর বিদ্রুপ বাণে জর্জরিত করে। তবু কবি সেই লেখাটাকে ভুলতে পারেন না। সবটা মনেও নেই। তার মনে পড়ে-
কী কবিতা, আর কী কবিতা নয়? এ প্রশ্নের উত্তর সবচেয়ে ভালো জানেন বুঝি কবিতা-পাঠক! কেননা কবিতা লিখেই তো কবির দায়িত্ব শেষ! [আদৌ কি শেষ হয়]। কিন্তু পাঠককে তা পড়তে হয়, আত্মস্থও করতে হয়! তাই কবিতা কিংবা অ-কবিতা অথবা ‘কবিতা হয়ে ওঠা’র বিষয়টি সম্যকভাবে বোঝেন পাঠক! অবশ্য পাঠকও কবি হতে পারেন।
এ কথা সত্য; শূন্যতায় কবিতা হয় না, কবিতা হতে হলে মাটি-মানুষ, জীবন-জীবিকার সঙ্গে ওতোপ্রোতভাবে সম্পর্কিত উপাদান জরুরি, স্বপ্ন-কল্পনার ফানুসও হতে পারে কবিতা! তবে তা জীবনকে বাদ দিয়ে নয়। ‘কবিতা হয়ে ওঠা’র জন্য তাই জরুরি দেশ-কাল-ঠিকানা।
সাধারণ পাঠক কবিতা পছন্দ করেন না-এমন অভিযোগ আজকালকার কবিদের কেউ কেউ করেন। যদি কথাটা এমন হয়; এই সময়ের কবিরা সাধারণ পাঠককে বোঝেন না। আদতে কোন মন্তব্য সত্য; তার সুরাহা অনেকাংশে অসম্ভব। কথার পিঠে কথা সাজানো যাবে, তর্কও বহুদূর নেওয়া যাবে। তাই এ প্রসঙ্গ রেখে বরং চলুন না; মননের কথা, আস্থার কথা, শিল্পিত সময়ের রেখাচিত্রের কথা বলি-যা একজন কবির নিপূণ কারুকার্যে কবিতা হয়ে উঠতে পারে! এমনও হতে পারে; যে ঈশ্বর লাভ করে, সে তাঁকে [ঈশ্বরকে] হামেশায় ভুলে যায়! সত্যিকার কবির কাছে কবিতাও তাই! অন্যভাবে বললে কবিতা যেন ঠিক তাই; যেটি হয়ে ওঠে কিংবা কবিতা হওয়ার চেষ্টা করে, যাকে বার বার পড়তে ইচ্ছে করে; দেখতেও! কবিতা হয়ে উঠলে তা কবির চেয়ে পাঠকের কাছেই যেন বেশি পূজনীয়!
বাকিটা আর মনে পড়ে না কবির। আসলে এতটা পেছনে ফেরা যায় কি?
কবিতার জন্য আরাধনা – ৩
চিত্রকল্প মাথায় এলেও কবিতারূপ কেন জানি তখনও হয়ে ওঠেনি। তাই হাতের বন্ধ ডায়েরি টেবিলে রেখে কবি তার পুরনো অভ্যাসে ফিরে যায়। সামান্য কিছু করলেও গুছিয়ে করার মানুষ তিনি। কাউকে ফোন করতে চাইলে, কোনো কিছু কিনতে চাইলে কিংবা রাতে কি রান্না করবেন তাও যদি মনে পড়ে তবে সেসব একটা কাগজে লিখে রাখেন। তারপর তালিকা অনুযায়ী বাস্তবায়ন করেন। অধিকাংশ কবিতা লেখার ক্ষেত্রেও এমন হয়েছে পছন্দনীয় শব্দগুচ্ছ একটা কাগজে লিখে ফেলেন। এরপর শব্দগুলোর বিন্যাসে জীবনঘনিষ্ঠ কোনো ঘটনার সাবলীল বর্ণনায় কবিতা প্রাণময় হয়। সেটা ডায়েরিতে লিখে রাখেন। এবারও ‘একটা চেয়ার পড়ে আছে। পাশে পড়ন্ত বিকেলে যেমন মানুষের দীর্ঘ ছায়া পড়ে ঠিক তেমন একটি ছায়া। কিন্তু মানুষটি দৃশ্যমান নয়।’-এই বিষয়ের ওপর কবিতা লেখার জন্য তিনি খসড়া করতে বাধ্য হন। টেবিল থেকে সাদা কাগজ নিয়ে সেখানে পছন্দনীয় শব্দগুলো পরপর লিখতে থাকেন। তিনি প্রথম লাইনে লিখলেন, খসড়া। তারপর নিচে লিখলেন-ভদ্রস্থ আলটপকা… ইত্যাদি আরও কত শব্দ, কথা।
কবিতার জন্য আরাধনা – ৪
অত্যন্ত গভীর মনোযোগ ও চিন্তার বিস্তৃতিতে চমৎকার এক কবিতা লিখে ফেলেন কবি। সারারাত জেগে ধৈর্য্য ও উদ্যম নিয়ে শেষ পর্যন্ত এ কবিতা লিখে তার মনে হলো, জীবনে অন্তত একটা উঁচু মানের কবিতা লিখতে পেরেছেন!
সবকিছু গোছানোয় অভ্যস্ত কবি হঠাৎ করে সমকণ্ঠের সেই কপিটা খুঁজে না পেয়ে অস্থির হয়ে উঠলেন। খুঁজতে খুঁজতে হাপিয়ে উঠলেও উদ্যম হারালেন না। শেষপর্যন্ত অবশ্য লেগে থাকার ফল পেলেন! কাঙিক্ষত সমকণ্ঠ পাওয়া গেল। এরপর তড়িঘড়ি করে প্রকাশিতব্য দৈনিকের ঠিকানায় সাহিত্য সম্পাদক বরাবর পাঠিয়ে দিলেন রাতের লেখা সেই নতুন কবিতাটি।
অধীর আগ্রহ নিয়ে কবি অপেক্ষা করতে লাগলেন। একই সঙ্গে তার কবিতা লেখাও শিকেয় উঠলো। উত্তেজনা-টেনশনকে আপাতত পাত্তা না দেওয়ার ভান করলেও ভেতরে ভেতরে অস্থির হয়ে উঠলেন। নতুন মাসের প্রথমদিন এলো। পত্রিকার স্টল থেকে কবি একটা পত্রিকা কিনলেন। সাহিত্যপাতায় দ্রুত চোখ বুলালেন। না, কোথাও তার কবিতাটি নেই। বিমর্ষ মনে পাতা উলটাতে যাবেন, হঠাৎ তার চোখ আটকে গেল! ‘খসড়া’-লেখকের জায়গায় তার নাম লেখা। কবির চোখ ছানাবড়া!-ঐ কবিতা লেখার জন্য নির্বাচিত শব্দের যে খসড়া তিনি করেছিল তা-ই হুবহু ছাপিয়ে দিয়েছে! শরীর শিউরে উঠল! তাহলে এত পরিশ্রম করে লেখা কবিতাটি না পাঠিয়ে খসড়া…। আর তাই ছাপা হয়েছে। রাগ-দুঃখ-ক্ষোভে কবির দু’চোখ ভরে কান্না এলো।
হলুদ খাম এবং…
হলুদ রঙের একটা খাম। খামের উপরে গোটা গোটা অক্ষরে কবির নাম-ঠিকানা লেখা। অন্যপাশে ছাপার অক্ষরে নতুন দৈনিকটির নাম-ঠিকানা। চিঠি খুলে কবি দেখলেন-সাহিত্য সম্পাদক খসড়া কবিতার জন্য কবিকে ধন্যবাদ জানিয়ে আরও কবিতা প্রত্যাশা করেছেন।
না। এরপর কবি আর কখনো কোনো পত্রিকায় কবিতা পাঠাননি। বেঁচে থাকলে হয়তো কবিতা না পাঠিয়ে থাকতে পারতেন না। চিঠি পাওয়ার পর দিন-দুপুরে তাকে নিজ বিছানায় মৃত অবস্থায় পাওয়া যায়। পাশের কক্ষের মেসের ছাত্ররা দরজা ভেঙ্গে লাশ দেখে পুলিশে খবর দেয়। …ময়নাতদন্তে জানা যায়, অনেকগুলো ঘুমের বড়ি খেয়ে কবি আত্মহত্যা করেন।
মজার বিষয় হচ্ছে, কবির এই আত্মহত্যার সঙ্গে হলুদ খামের ওই চিঠি কিংবা ‘খসড়া’ কবিতা প্রকাশিত হওয়ার কোনো যোগসূত্র তদন্ত রিপোর্টে পাওয়া যায়নি!
[পাঠকের জন্য ধাঁধাঁ : একজন জনপ্রিয় কথাসাহিত্যিকের গল্পের অনুছায়া অবলম্বনে এই গল্পটি লেখা। আপনি যদি সেটি পড়ে থাকেন তাহলে তো বুঝেই গেলেন; না হলে খোঁজ করুন সেই গল্পটি]
কপিরাইট © ২০১৭ - ২০২০ ।। বইদেশ-এ প্রকাশিত কোনও সংবাদ, কলাম, তথ্য, ছবি, কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না
Design & Development by: TeamWork BD