মন বলি কারে
মূল : ড. সিলভিয়া হেলেনা কারদোসো
।। অনুবাদ : জাহাঙ্গীর সুর ।।
গ্রিক দার্শনিক প্লেটোর (৪২৮-৩৪৮ খ্রিস্টপূর্বাব্দ) মন-দেহ দ্বৈতবাদকে বিস্মৃতির হাত থেকে রক্ষা করেছিলেন ফরাসি দার্শনিক রেনে দেকার্তে (১৫৯৬-১৬৫০)। প্লেটোর (বাঁয়ে) দর্শনে মন আর দেহ ছিল সম্পূর্ণ আলাদা সত্তা। দেকার্তে (ডানে) একটা বিতর্কিযোগ্য প্রশ্ন ছুড়ে দিয়েছিলেন, ‘অশরীরী মন কীভাবে মস্তিষ্ককে প্রভাবিত করে? এবং উলটোভাবে মস্তিষ্ক মনকে?’ ছবি : উইকিমিডিয়া কমনস
পৃথিবীতে, এবং সম্ভবত মহাবিশ্বে, বিদ্যমান জটিল কাঠোমাগুলোর সবচেয়ে মধ্যে প্রধান হলো মস্তিষ্কের (ব্রেইন) গঠন। তবুও মস্তিষ্ক হলো সুসংজ্ঞায়িত একটা বস্তু : একটা বাস্তব সত্তা, যার অবস্থান মাথার খুলির ভেতর। মস্তিষ্ককে ঠাহর করা যেতে পারে, স্পর্শ করা যেতে পারে এবং একে নিয়ন্ত্রণও করা যেতে পারে। রাসায়নিক পদার্থ, এনজাইম ও হরমোন দিয়ে গঠিত মস্তিষ্ক। একে পরিমাপ করা যায়, বিশ্লেষণ করা যায়। এর নির্মাণকলা নির্ভর করে স্নায়ুকোষ, পথ ও সিনাপটিক সংযোগের ওপর। এর কর্মকলা নির্ভর স্নায়ুকোষের (নিউরন) ওপর, যারা অক্সিজেন গ্রাস করে, প্লাজমা পর্দার ভেতর দিয়ে রাসায়নিক পদার্থ লেনদেন করে। এভাবে কোষের ভেতর ও বাইরে বেদ্যুতিক মেরুকরণ (বিপরীতধর্মী আধানের সৃষ্টি) হয়। কখনো-সখনো এই মেরুকরণ বাধাগ্রস্তও হয়।
কিন্তু… মন কী জিনিস?
নিশ্চিত করে বলা খুবই কঠিন কাজ। যদিও কয়েক শতক ধরে দার্শনিকরা চিন্তাভাবনা করেছেন, মস্তিষ্ক গবেষণায় ব্যাপক আত্মনিয়োগ ছিল, স্নায়ুবিজ্ঞানে উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি হয়েছে; তার পরও বলতে হচ্ছে- মনের ধারণা এখনো অস্পষ্ট, এখনও তর্কযোগ্য। এবং আমাদের ভাষার যে পরিসীমা, তার মধ্য থেকে মনকে সংজ্ঞায়িত করা অসম্ভব।
একটা শক্ত দর্শন হলো : মস্তিষ্ক থেকে সম্পূর্ণ ভিন্ন একটা সত্তা মন (মাইন্ড)। এই দর্শনের ঐতিহাসিক পটভূমি আছে। মস্তিষ্কের কার্যাবলির দ্বৈতবাদী অনুমান (ডুয়ালিস্টিক হাইপোথিসিস অব দ্য ব্রেইন ফাংশন) নামে একটা পুরনো তত্ত্ব আছে। এই তত্ত্ব বলে, বস্তুগত মস্তিষ্ককে অধিযন্ত্রবাদ (পুরোপুরি নিয়ন্ত্রণযোগ্য বস্তুনির্ভর) দিয়ে ব্যাখ্যা করা যেতে পারে। কিন্তু মন হলো এমন এক সত্তা, যার বস্তুগত বৈশিষ্ট্য আলাদা এবং যা এখনও সংজ্ঞায়িত করা যায়নি। এই রকম তত্ত্বে মনকে দেখানো হয় আত্মার (সোল) সমর্থক শব্দ হিসেবে। এমন চিন্তা প্রচলিত ধর্ম-সংস্কৃতির একটা অখণ্ড অংশ হয়ে উঠেছিল। উদাহরণ হিসেবে ফরাসি দার্শনিক রেনে দেকার্তের (১৫৯৬-১৬৫০) কথাও বলা যায়। তিনি প্লেটোর (৪২৮-৩৪৮ খ্রিস্টপূর্বাব্দ) মন-দেহ দ্বৈতবাদকে বিস্মৃতির হাত থেকে রক্ষা করেছিলেন। প্লেটোর দর্শনে মন আর দেহ ছিল সম্পূর্ণ আলাদা সত্তা। দেকার্তে একটা বিতর্কিযোগ্য প্রশ্ন ছুড়ে দিয়েছিলেন, ‘অশরীরী মন কীভাবে মস্তিষ্ককে প্রভাবিত করে? এবং উলটোভাবে মস্তিষ্ক মনকে?’
‘স্ব’ বা আত্মা নিয়ে সমস্যা সমাধানে এতদিন যে ধাঁচে গবেষণা হচ্ছিল, দেকার্তের দর্শন সেই পথটায় পরিবর্তন এনে দিল। তখন পর্যন্ত যেহেতু মন আর মস্তিষ্ককে স্বতন্ত্র দুটো সত্তা হিসেবে দেখা হচ্ছিল, এ দুটো বিষয় নিয়ে গবেষণাগুলোও মৌলিকভাবে আলাদা আলাদা মেজাজের ছিল। যারা প্রাণরসায়নবিদ, তারা বস্তুগত শরীরী প্রক্রিয়া নিয়ে কাজ করতেন। যারা মনোবিদ, তারা মনের প্রকাশকে বোঝার মল্লযুদ্ধ চালিয়ে যেতেন। আর যারা দার্শনিক ও ধর্মবিদ, তারা মনোশক্তি (স্পিরিট) ও আত্মার (সোল) গবেষণায় মনোযোগী ছিলেন।
‘মিনদিস’ (আমি সব সময়ই আছি) একটা ধারণা, যা মানুষের অস্তিত্বকে টিকিয়ে রাখার কথা বলে। মানুষের অস্তিত্ববোধ আসে মনের নানাবিধ ক্রিয়াকলাপের উপস্থিতি থেকে। যেমন চিন্তা করা, ভালোবাসা ও ঘৃণা করা, শেখা ও স্মরণ রাখা; সমস্যা সমাধান করা, কথায় ও লেখায় যোগাযোগ করা; সভ্যতা সৃষ্টি ও বিনাশ করা। এই ধরনের অভিব্যক্তি মস্তিষ্কের ক্রিয়াকলাপের সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে সম্পর্কিত। সুতরাং মস্তিষ্ক বিনে মন থাকতে পারে না। আচরণগত অভিব্যক্তি বিনে মনের প্রকাশ ঘটে না।
অনেক সময় মনে হয়, মনোশক্তি আর আত্মা হলো মনের ধর্মীয় ও আধ্যাত্মিক ব্যাখ্যা। এদিকে পরীক্ষামূলক পর্যবেক্ষণ ও অনুসন্ধানের মধ্য দিয়ে মনকে বোঝার চেষ্টা করে আসছে স্নায়ুবিদ্যা। মনোশক্তি ও আত্মার অস্তিত্বকে গ্রহণ বা প্রত্যাখ্যান করাটা নির্ভর করে বিশ্বাস ও ধর্মীয় প্রতীতির ওপর, যা কিন্তু পরীক্ষা-নিরীক্ষায় প্রমাণ ও অপ্রমাণ করা যায় না। ফলে এভাবে চিন্তা করাই যৌক্তিক যে, মস্তিষ্কের শারীরবৃত্তীয় কার্যাবলি ও আমাদের সাংস্কৃতিক আবহাওয়ার ওপর নির্ভর করে আমাদের বিশ্বাসবোধ। আমাদের ধর্মীয় কোনো ধারণাই থাকত না, যদি আমাদের সচল একটা মস্তিষ্ক না থাকত। যেমন কেউ কোমায় থাকে কিংবা অ্যানেস্থেসিয়া করা হয়, তখন মস্তিষ্কের কাজ-কারবার বাধাগ্রস্ত হয়। এবং আমরা যদি কোনো কিছু না শিখি, না শুনি বা অভিজ্ঞতা না নিই, তা হলে তা আমরা বিশ্বাস করতাম না। এমনটা ভাবা যায়, কেউ কেউ ঈশ্বরের অস্তিত্ব, মৃত্যুর পরের জীবন ও ঐশ্বরিক শক্তিতে বিশ্বাস করতে শেখে। এ কাজে তাকে সাহায্য করে মস্তিষ্কই; মানসিক চাহিদা মেটানোর জন্য মস্তিষ্কে আবেগের কেন্দ্রও আছে। আমি নিজেকে প্রায়ই এই প্রশ্নটা করি, ‘মস্তিষ্কের ভেতর এমন কি কোনো অংশ রয়েছে, যা রহস্যময় ধর্মীয় অনুভূতির সঙ্গে সম্পর্কযুক্ত? ওই অংশে ক্ষত হলে কিংবা তার অনুপস্থিতিতে ধর্মীয় বিশ্বাসকে বিনাশ করতে পারে কি? কিংবা উলটোভাবে বললে, কিংবা মস্তিষ্কে ‘বৈদ্যুতিক ঝড়’ (স্নায়ু সার্কিট) সৃষ্টি করার মাধ্যমে ধর্মীয় অনুভূতি তৈরি করে এমন অঞ্চল তৈরি করা যায়?’
বিজ্ঞানীরা সাধারণত তাদের পরীক্ষামূলক গবেষণাকে দর্শনের সঙ্গে মেলাতে চান না। নিজেদের গবেষণায় ধর্মতত্ত্বের সম্ভাব্য প্রভাব তারা বিবেচনায় নিতে নারাজ। তবে এ ক্ষেত্রে এখন হাতেগোনা হলেও কিছু গবেষণা হচ্ছে। যেমন সেভার ও রবিন গবেষণায় দেখেছেন, ধর্মীয় অনুভূতি, মৃত্যুর মতন অভিজ্ঞতা ও মায়া-বিভ্রমের সৃষ্টি লিমবিক এপিলেপ্সি (মস্তিষ্কে আবেগপ্রবণতার ব্যবস্থা) থেকে। রামচন্দ্র দেখেছেন, যেসব রোগীর টেমপোরাল লোবে অস্ত্রপচার হয়েছে, তারা কখনো কখনো ঈশ্বরকে অনুভব করেছে, ধর্মীয় আনন্দ পেয়েছেন এবং এসব রোগী প্রবলভাবে ধর্মপ্রাণ। আসাল ও বিন্ডসকায়েদার ৩৯ বছর বয়সী এমন নারীর কথা শুনিয়েছেন, যিনি ধর্মীয় ভ্রান্তিতে ভুগছিলেন। ১৩ বছর আগে মানুষটি তার মাথায় ডান টেমপোরাল লোবে আঘাত পেয়েছিলেন।
কিছু স্নায়ুবিজ্ঞানী, এদের দলে রয়েছেন নোবেলজয়ী স্যার জন একলেস, জোর দিয়ে আগে বলেছিলেন যে, মন হলো দেহ থেকে স্বতন্ত্র এক সত্তা। কিন্তু তাদের বেশিরভাগই এখন বিশ্বাস করেন, মনকে (যাকে চেতনা বলে ধরা হয়) বস্তুবাদ দিয়ে, দেহাত্মবাদ দিয়ে ব্যাখ্যা করা যায়। তারা এখন মানছেন যে, মন হলো স্নায়ু কোষের চালচলন। প্রখ্যাত স্নায়ু-শারীরতত্ত্ববিদ হোসে মারিয়া ডেলগাডোর মনে করেন, ‘মনকে বরং এভাবে বিবেচনায় নেওয়ায় বাঞ্ছনীয় : মন হলো একটা ক্রিয়ামূলক সত্তা, যা জন্মগত ধর্মীয় প্রভাব থেকে মুক্ত ও দর্শন বর্জিত। এবং মন কেবল মস্তিষ্কের অস্তিত্বের সঙ্গে সম্পর্কযুক্ত।’
সূত্র : ব্রেইন অ্যান্ড মাইন্ড ম্যাগাজিন
ড. সিলভিয়া হেলেনা কারদোসো : ব্রাজিলের মনোজীববিজ্ঞানী। ব্রেইন অ্যান্ড মাইন্ড ম্যাগাজিনের প্রতিষ্ঠাতা ও প্রধান সম্পাদক।
জাহাঙ্গীর সুর : বিপিএইচআর ইয়াং অ্যাপ্রিসিয়েশন অ্যাওয়ার্ড ২০১৮ বিজয়ী বিজ্ঞান লেখক।
কপিরাইট © ২০১৭ - ২০২০ ।। বইদেশ-এ প্রকাশিত কোনও সংবাদ, কলাম, তথ্য, ছবি, কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না
Design & Development by: TeamWork BD