সিরিয়ান গল্পকার ওসামা আলোমারের একগুচ্ছ অনুগল্প
অনুবাদ : আদনান সহিদ
গল্পকার পরিচিতি : ওসামা আলোমারের জন্ম ১৯৬৮ সালে সিরিয়ার দামেস্কে। স্বদেশ থেকে নির্রাসিত এই সাহিত্যিক বর্তমানে বাস করছেন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের শিকাগোতে। আলোমার মূলত তাঁর অনুগল্পের জন্য জনপ্রিয় ও সমাদৃত। তাঁর অনুগল্পগুলিতে নীতিকথা, রূপকথা, জাদুবাস্তবতা ও বুদ্ধিদীপ্ত রাজনৈতিক ইস্যুর ইঙ্গিত মেলে। আকারে বেশ সংক্ষিপ্ত তাঁর গল্পের মূল চরিত্রগুলোকে সাধারণত তিনি দৈনন্দিন মানবজীবনের নানা উপাদান, প্রাকৃতিক পরিবেশ (যেমন : সমুদ্র -জলাশয়- আগুন -পানি- বাতাস মেঘ-পাখি-মাছ) ও বিমূর্ত আবেগের আশ্রয়ে ব্যক্তি-রূপক অর্থে প্রকাশ করে থাকেন। আরবিতে প্রকাশিত তাঁর উল্লেখযোগ্য অনুগল্প সংকলনের মধ্যে রয়েছে ও ম্যান, টাঙ্গ টাই, অল রাইটস নট রিজার্ভড , ফুলব্লাড অ্যারাবিয়ান, দ্য টিথ অব দ্য কম্ব অ্যান্ড আদার স্টোরিজ। ইংরেজি ভাষা থেকে অনূদিত এখানে ছয়টি অনুগল্পে পাঠক ব্যতিক্রমী স্বাদ পাবেন।
হাস্যোজ্জ্বল মানুষেরা
ওয়াদি আল মানতুফ নামের এক ব্যক্তিকে নিজ নেতার ছবির দিকে সহাস্যে না তাকানোর অভিযোগে গ্রেপ্তার করা হলো। গোয়েন্দা পুলিশ এবং পথচারীরা রাস্তায় তাকে অনবরত কিল-ঘুষি মারতে লাগল। এমনকি শিশুরাও মুখ ভেংচি কেটে, তার দিকে থুতু ছিটিয়ে চরম ঘৃণা প্রকাশ করতে পিছপা হলো না। গ্রেপ্তারের পর থানায় নিয়ে দীর্ঘদিন আটকে রাখা হলো তাকে। অবশেষে আদালতে বিচারের মুখোমুখি হলো সে। সারাজীবন ধরে তার নেতার দিকে তাকিয়ে তাকিয়ে হাসতে হবে- এই দণ্ড দেওয়া হলো ওয়াদি আল মানতুফকে। ভবিষ্যতে এই ধরনের অপরাধ যাতে আর কেউ না করে সেজন্য দেশজুড়ে প্রচুর ‘হাস্যোজ্জ্বল’ মুখোশ বানিয়ে পুরো জাতিকে বন্টন করা হলো। সদ্য নবোজাত থেকে প্রবীণ ব্যক্তি- কেউই সেই মুখোশ পরা থেকে বাদ গেল না। সব মানুষ দুঃখ ভুলে গেল। চারপাশে দেখা গেল কেবল হাসিখুশি মুখ। আর পৃথিবীর বিভিন্ন দেশের দর্শনার্থীরা সেই হাস্যোজ্জ্বল দেশটি ভ্রমণের জন্য ব্যস্ত হয়ে পড়ল।
ঝিনুক
সমুদ্রতীরে হেঁটে হেঁটে বাৎসরিক ছুটি উপভোগ করছিলেন এক ব্যক্তি। খুশিতে কখনো সমুদ্রতটের বালিতে পা ছুঁড়ছিলেন, কখনো আবার তীরে আছড়ে পড়া ঢেউয়ের উপর সোনালি মুক্তোর মতো বসে পরম আনন্দে সূর্যস্নান করছিলেন। হঠাৎ তাঁর পা বেশ শক্ত কিছু একটায় ঠেকল। নিচু হয়ে বালির নিচ থেকে খুব সহজেই শক্ত বস্তুটি টেনে বের করলেন তিনি। হাতে নিয়ে দেখলেন- একটা বড় ঝিনুক! মুহূর্তেই হাঁটা বন্ধ করে ঝিনুকটি কানে দিয়ে মন্ত্রমুগ্ধের মতো সমুদ্রের গর্জন শোনার চেষ্টা করলেন। অনুভব করলেন, তিনি যেন সমুদ্রে ডুব দিয়ে কিছু বিস্ময়কর প্রাণীর গান শুনছেন। সমুদ্র তলদেশের চমৎকার জগতের সাথে একাত্ম হয়ে যাওয়ার ইচ্ছা হলো তাঁর। মনে হলো, ঝিনুকটি যেন ব্যথায় গোঙাচ্ছে। কারণ, সে শুনতে পাচ্ছে ইচ্ছার বিরুদ্ধে মানবাত্মার সংগ্রাম ও নির্যাতনের কাহিনি, নির্যাতিতের আর্তচিৎকার, সন্তানহারা মায়ের আর্তনাদ, এতিমের হাহাকার, রক্তের বন্যা এবং লক্ষাধিক মানবতার হৃদয় ছিন্নকারী হতাশা, দুঃখবোধ ও ধ্বংসের লীলাখেলা!
ওই ব্যক্তির মনে হলো, নিমিষেই তিনি যদি ঝিনুকটিকে দূর সমুদ্রে সজোরে নিক্ষেপ না করেন, তবে তা তাঁর কানের ভেতর ফেটে চৌচির হয়ে যাবে। অগত্যা তিনি তাই করলেন। ঝিনুকটি সমুদ্রে নিক্ষেপ করে স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেললেন। তারপর খুশি মনে আবার সমুদ্রের বুকে ঝাঁপ দিয়ে আনন্দে মশগুল হয়ে উঠলেন।
মুখের অভিব্যক্তি প্রকাশের স্বাধীনতা
দেশের সরকার নাগরিকদের মুখের অভিব্যক্তি প্রকাশের স্বাধীনতা নিশ্চিত করার আদেশ জারি করলেন। আদেশটি সরকারের এক মহৎ উদ্যোগ হিসেবেই গণ্য হলো।কারণ, অনেক দেশেই মুখের অভিব্যক্তি প্রকাশের স্বাধীনতা নেই। লক্ষ লক্ষ মানুষ রাস্তায় নেমে গণতন্ত্র রক্ষাকারী এই গৌরবোজ্জল আদেশের পক্ষে আনন্দ-উল্লাস করতে লাগল। জয়ধ্বনি করতে করতে যারা এগিয়ে যাচ্ছিল, তাদের মুখে ‘হাসি মাখা মুখোশ’ আঁটা দেখা গেল।
পর্দা
পাতলা, রঙিন ও মনোরম একটা কাল্পনিক পর্দা ছুড়ে দিলাম বাস্তবতার পাথুরে ভূমিতে। চমৎকার একটা দৃশ্যের উদ্ভব হলো। কিন্তু মূল পাথুরে ভূমির কোনো পরিবর্তন হলো না।
সুশ্রী মুখমণ্ডল
পাহাড়ের চূড়ায় বসে ইতিহাসের সুশ্রী মুখমণ্ডলের দিকে তাকিয়ে দেখছিলাম। মনে হলো, ইতিহাসের এই সৌন্দর্য যে কোনো সুন্দরতম মানবের আকৃতি ও দেহসৌষ্ঠবকেও হার মানিয়েছে। পাহাড় থেকে নেমে ইতিহাসের দিকে এগিয়ে গেলাম। তাকে দেখে মুগ্ধ হলাম এবং মনে হলো হৃদয়ে যেন ‘ভালোলাগার’ একগুচ্ছ ফুল বহন করে চলেছি। কিন্তু আরও কাছে যাওয়া মাত্রই তাঁর অপূর্ব চোখ দুটি আমায় চমকে দিলো। সে চোখের পাপড়ি খুলতেই মনে হলো, সেখান থেকে কোনোকালের ধারাবাহিকতায় অগ্নিগোলক বর্ষিত হচ্ছে। আর তার সুদর্শন মুখ থেকে বেরিয়ে আসছে শতাব্দী প্রাচীন অপমান, অপবাদ ও অশ্লীলতার চূড়ান্ত প্রতিচ্ছবি। কালের সীমানা অস্বীকার করা ক্ষোভ ও ঘৃণার প্রকাশও ফুটে উঠেছে সেই মুখভঙ্গিতে!
আমি ইতিহাসের দিক থেকে পেছনমুখ করে দাঁড়ালাম।তারপর আমাদের ভবিষ্যৎ ধ্বংসকারী এমন আড়ম্বরপূর্ণ ইতিহাসকে গালি দিতে দিতে দ্রুত বাড়ি ফিরে এলাম।
আমাদের এলাকার ইউনিয়ন
ওইসব দেশের নাগরিকদের কোনো তল্লাশির মুখোমুখি হওয়া ছাড়াই সীমান্ত পার হতে দেখলে বেশ অবাক লাগে। তাদের ব্যাগপত্র খুলতে হয় না। নিরাপত্তারক্ষীর প্রশ্নের সম্মুখীন হতে হয় না। কেবল পরিচয়পত্রটা বের করে দেখানোর পর দ্রুতই আবার পকেটে ঢুকিয়ে ফেললেই হয়ে গেল! তাদের সাথে হাস্যোজ্জ্বল মুখে বিনয়ী ব্যবহার করা হয়- হ্যাঁ! এ ধরনের আচরণ আমি দেখেছি ইউরোপীয় ইউনিয়নের বিভিন্ন দেশে।
এখন নিজ এলাকার ইউনিয়নের কথা ভাবলে মনে পড়ে, পাশেই অবস্থানরত কেবল ভাইয়ের বাড়িতে যেতে চাইলেই আমাকে কত রকমের বাধ্যতামূলক নজরদারি, তল্লাশি ও অনুসন্ধান পার হতে হতো!
কপিরাইট © ২০১৭ - ২০২০ ।। বইদেশ-এ প্রকাশিত কোনও সংবাদ, কলাম, তথ্য, ছবি, কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না
Design & Development by: TeamWork BD