তবুও ঋণী
।। মনোয়ার মোকাররম ।।
ব্যাপারটা এখন আর একদম স্বাভাবিক পর্যায়ে নেই। প্রথম প্রথম আশরাফ ভেবেছিল এটা কান্তির এমনি ছেলেমানুষি। আশরাফ পাত্তা না দিলে খুব বেশি গুরুত্ব পাবে না। কিন্তু এখন একদমই বাড়াবাড়ি পর্যায়ে চলে গেছে। একটা সামান্য গাছকে নিয়ে এতটা করার কোনো মানে হয় না।
– তুমি তাহলে গাছটা সরাচ্ছ না? কান্তির স্বর অনেক ঝাঁঝালো ঠেকে।
আশরাফ ভাবে সে চুপ করে থাকবে। কিছুটা সময় একা একা বকবক করে কান্তি হয়তো চুপ মেরে যাবে। সে টিভি দেখায় মন দেয়। কিন্তু ধারণা ভুল প্রমাণিত হয়। কান্তি থামছে না। কষ্ট করে শরীরটাকে বিছানা থেকে টেনে নিয়ে আশরাফের কাছের সিঙ্গেল সোফাটায় এসে বসে তার গায়ে একটা ঝাকুনি দেয়।
– আমার কথা কিছু শুনছ না?
– হুম শুনছি।
– তাহলে জবাব দিচ্ছ না কেন?
– সামান্য একটা গাছ নিয়ে কি শুরু করে দিলে। এত সুন্দর একটা গাছ। দেখতেই তো কেমন কিউট আর সুন্দর লাগছে।
– আমি এত কিছু বুঝি না। কিউট না ফাইজলামি। আমি তোমার হাত-পা ভেঙ্গে এই শোকেসে সাজিয়ে রাখি? তখন কেমন লাগবে? এই গাছ তুমি ঘরে রাখতে পারবে না। কদিন পর ঘরে আমাদের বাবু আসবে। আমার ভয় লাগে, যদি কিছু হয়। আমি রাতে খুব ভয়ংকর সব স্বপ্ন দেখি। এই গাছ তুমি সরাও।
– কোথায় সরাব? ফেলে দিব?
– যা খুশি করো। ফেলে দাও, উপড়ে ফেলো, ফেরত দিয়ে আসো। কিন্তু আমার বাসার ত্রিসীমানায় এই গাছ থাকতে পারবে না।
আশরাফ কী বলবে ভেবে পায় না। কান্তির সাত মাসের মতো চলছে। খুব যে কিছু সমস্যা হচ্ছে তা না। তবু এই সময়টাতে তাকে সে অহেতুক উত্তেজিত করতে চায় না।
– তুমি যদি আমার কথা না শোনো, আমি বাবা-মাকে জানাবো। তোমাদের বাসায় জানাবো।
– আচ্ছা ঠিক আছে, দেখা যাবে। সরিয়ে ফেলবো।
– কবে সরাবে? এরকম বলে বলে তো সাত দিন হয়ে গেল।
ঘটনা সাতদিন আগের। আশরাফদের অফিসে কিছু প্ল্যান্ট কেনা হয়েছে। অর্থবছর প্রায় শেষ। অফিস রক্ষণাবেক্ষন আর সৌন্দর্য বর্ধন খাতে এ বছরের বাজেট থেকে অল্প কিছু টাকা রয়ে গিয়েছিল। তাই দিয়ে তারা অফিসের জন্য কিছু গাছপালা কিনেছে। সবই ইনডোর প্ল্যান্ট। করিডোরে রাখার জন্য কিছু বড় ধরনের গাছ। আর সবার রুমের টেবিলে রাখার জন্য কিছু বনসাই। আশরাফ নিজেই প্ল্যান্ট ডেকোর-এ গিয়ে গাছগুলো পছন্দ করে কিনেছে। গাছগুলো কেনার পর অফিসের চেহারাই পালটে গেছে। দোকানি বলেছে, গাছগুলো শুধু সৌন্দর্য বর্ধনের কাজেই লাগবে না। এদের বাতাস পরিশোধনের মতো বিশেষ ক্ষমতা আছে। সেভাবেই এদের জেনেটিক মডিফিকেশন হয়েছে। ন্যাচারাল এয়ার পিউরিফায়ারের কাজ করবে এই গাছগুলো। তার নিজের রুমে একটি বড় গাছ রাখা হয়েছে। এর নাম শেফলেরা। তার বসার চেয়ারের পিছনে রাখা হয়েছে গাছটি। চেয়ারে বসে থাকা অবস্থায় মনে হয় গাছের নিচে বসে আছে। বিকেলে যখন আলো একটু একটু কমতে শুরু করে তখন তার সামনে দেয়ালে গাছের ছায়া পড়ে খুব সুন্দর একটা অবয়ব তৈরি হয়। মনে হয় দেয়ালে জলছাপের কারুকাজ। দারুণ লাগে দেখতে। তার টেবিলে দেয়া হয়েছে একটা বনসাই। সেটাকেও ভালো লাগছে। কেমন একটা সবুজ সবুজ ভাব। গ্লোবাল ওয়ার্মিং আর জলবায়ু পরিবর্তনের এই যুগে কিছুটা অবদান রাখতে পারছে সেটা ভেবেও একটু ভালো লাগছে। সাইকোলজিক্যালিও ব্যাপারটা চোখের জন্য আরামের। মনস্তত্ত্ব নিয়ে যারা কাজ করেন তারা তো পরামর্শ দেন কর্মক্ষেত্রে কিংবা এমনকি বাসায়ও কাজ করতে করতে যদি চোখ ক্লান্ত হয়ে যায় তখন আশেপাশে যদি সবুজ গাছপালা থাকে, সেদিকে কিছুটা তাকাতে। চোখের অনেক উপকার হয়। ক্লান্তি দূর হয়। একঘেয়েমি দূর হয়। মন সতেজ থাকে।
বনসাইগুলো দেখে পছন্দ হয়েছিল। তাই বাসার জন্যেও নিজের পকেটের টাকা দিয়ে একটা কিনেছে। বিপত্তিটা হয়েছে সেখানেই।
কান্তি কিছুতেই বাসায় বনসাই রাখতে দেবে না। এ ব্যাপারে তার কুসংস্কার প্রবল। যদিও সে তাকে কুসংস্কার বলতে নারাজ। তার ধারণা এর পেছনে একটা যৌক্তিক ব্যাখ্যা আছে। বনসাই বলতে তার মাথায় ঢুকে গেছে এটা বামন বৃক্ষ। আর এর পেছনে দায়ী মানুষ। সেজন্য যে ঘরে বনসাই থাকে সে ঘরের মানুষদের সে অভিশাপ দিতে থাকে।
– তো তোমার কাছে কি কোনো প্রমাণ আছে, ঘরে বনসাই রাখাতে কোনোকালে কোনো মানুষের ক্ষতি হয়েছে?
– অবশ্যই প্রমাণ আছে। আমার নিজের ভাই এর প্রমাণ?
– কে? মারুফ?
– হ্যাঁ, মারুফ।
– কী হয়েছে মারুফের?
– একবার ও শখ করে তোমার মতোই এরকম বনসাই এনেছিল। নিজের ঘরে রেখেছিল। কিছুদিন যেতে না যেতেই মারুফের হঠাৎ সারাদিন পিঠে ব্যথা করে।
– সেটা তো ব্যাকপেইন। সবারই হতে পারে। যে কোনো সময়েই হতে পারে।
– শোনো আগে পুরোটা। কান্তি কিছুটা চাপা রাগত স্বরে বলে।
– আচ্ছা বলো ।
– এরপর হঠাৎ ওর একদিন বলা নেই কওয়া নেই শুরু হলো রক্তবমি। প্রচণ্ড জ্বর। সারা শরীর ব্যথা। এভাবে অনেক দিন চলল। সুস্থ্য তরতাজা একটা মানুষ কয়েক সপ্তাহেই হাড্ডিসার হয়ে গেল। কান্তি কিছুটা থামল।
আশরাফ খুব মনোযোগ দিয়ে কান্তির এক্সপ্রেশন লক্ষ্য করছে। তাকে খুবই বিচলিত মনে হচ্ছে। মনের মধ্যে দৃঢ় একটা কুসংস্কার বা বিশ্বাস নিয়েই সে কথাগুলো বলছে এটা বেশ পরিস্কার ।
– তারপর?
– অনেক ডাক্তার দেখানো হলো। অনেকে অনেক কিছু বলে, এই ঔষধ দেয়, সেই ঔষধ দেয়। কিন্তু মারুফের স্বাস্থ্যের কোনো উন্নতি হচ্ছে না। আমরা ওকে নিয়ে ভারত পর্যন্ত গেছি। কোনো লাভ হয়নি।
– তারপর?
– তারপর আর কি ? আমরা হাল ছেড়ে দিয়েছিলাম। কিন্তু অবাক করা ব্যাপার হলো, একদিন আমার বড় খালা ঘরে বনসাই দেখে বললেন, ‘ঘরের মধ্যে এসব বনসাই রাখা কোনো মঙ্গলের ব্যাপার না। এগুলি সরাও। এগুলি অমঙ্গল বয়ে আনে।’ কী মনে করে আমরা তখন বনসাইটাকে সরিয়ে ফেললাম।
– তারপর মারুফ ভালো হয়ে গেল?
– হ্যাঁ। তারপর থেকে ধীরে ধীরে ওর অবস্থা ভালো হতে লাগল।
– সেটা যে বনসাই সরানোর কারণে তার বৈজ্ঞানিক ভিত্তি কি? এমনি এমনিও ভালো হয়ে যেতে পারে? বনসাই সরানোটা কাকতাল ছাড়া হয়তো আর কিছু নয়।
– বৈজ্ঞানিক ভিত্তি নেই। এটা আমাদের বিশ্বাস ছিল। শুধু এটাই না, আরও ঘটনা আছে।
– আর কি ঘটনা?
– আমাদের একজন পরিচিত ভদ্রমহিলা বনসাই নিয়ে কাজ করতেন। বাড়িতে বনসাই বানিয়ে তিনি অনলাইনে বিক্রি করতেন। তিনি অনেক চেষ্টা করেও মা হতে পারছেন না।
– বনসাই বানানো বন্ধ করে দিলেই তো হয় তাহলে, তোমার ফর্মুলা অনুযায়ী।
– দিয়েছেন ।
– তাহলে তো হলোই। এখন নিশ্চয়ই বাচ্চা-কাচ্চা হতে কোনো সমস্যা হবে না।
– তুমি আমার কথাটাকে সিরিয়াসলি নিচ্ছ না। বৈজ্ঞানিক যুক্তি দিয়ে বোঝানোর চেষ্টা করছ। কিন্তু বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যার বাইরেও তো অনেক কিছু আছে। অনেক পৌরাণিক গল্পেই বনসাই-এর অতিপ্রাকৃতিক শক্তির কথা বলা হয়েছে। আর বিজ্ঞান তো বলেছেই, গাছের প্রাণ আছে। জগদীশ চন্দ্র তো সে কথা অনেক আগেই বলে গেছে। তাহলে প্রাণ আছে যে জিনিসের সে জিনিসের তো স্বাভাবিক বৃদ্ধিও আছে। তো বনসাইয়ের মাধ্যমে আমরা কি সেই স্বাভাবিক বৃদ্ধি ব্যহত করছি না? তার অধিকার হরণ করছি।
আমি কনককে উত্তেজিত করতে চাইলাম না। মনে মনে বললাম, মানুষ এখনও বিশ্বব্যাপী মানুষেরই অধিকার প্রতিষ্ঠা করতে পারলো না। আর সে আসছে প্ল্যান্টের অধিকার নিয়ে।
– আচ্চা ঠিক আছে বনসাই আমি সরিয়ে ফেলবো। তুমি এখন একটু বিশ্রাম নাও।
– যাচ্ছি। তবে এটা মনে রেখো প্রকৃতির নিয়মকে চ্যালেঞ্জ জানিয়েই আমরা এমনটা করছি। এর পরিণতি কিছুতেই ভালো হবার কথা না। এই যে একটা মহামারি পুরো পৃথিবীটাকে গ্রাস করছে, তারপরেও কি মানুষের শিক্ষা হবে না?
– মানুষ তো দিগ্বিজয়ী। সে ঠিকই এই সমস্যার সমাধান বের করে ফেলবে।
– এত সহজ না। এইতো সেদিন একটা ফিচার পড়লাম একটা অনলাইন পত্রিকায়। সেখানে দাবি করা হয়েছে, এই যে মানুষ হন্যে হয়ে এলিয়েনের খোঁজ করছে, আদতে মানুষ নিজেই আসলে এই পৃথিবীতে একটা এলিয়েন। যে বিজ্ঞানী এটি দাবি করেছে, তার নাম এলিস সিলভার। তিনি তার ‘হিউম্যান আর নট ফ্রম আর্থ’ নামক বইয়ে রীতিমতো যুক্তি দিয়ে প্রমাণ করতে চেয়েছেন মানুষ এই পৃথিবীর জীব নয়। সে আসলে এই পৃথিবীতে অতিথি। বহু বছরের গবেষণার পর তার সিদ্ধান্ত, কয়েক লক্ষ বছর আগে অন্য গ্রহ থেকে মানুষকে পৃথিবীতে ছেড়ে দেওয়া হয়েছিল। এবার মনে হয় প্রকৃতি এই অনাহুত অতিথিকে বিদায় করার মিশনে নেমেছে।
– তাহলে স্টিফেন হকিং-এর তত্ত্ব ভুল? মানুষ নিজেই এলিয়েন? সিলভারের থিউরির যুক্তি কি?
– সিলভার অনেক যুক্তি দেখিয়েছেন। প্রথমত, এই পৃথিবীতে একমাত্র মানুষেরই অবয়ব ভিন্ন। পৃথিবীর অন্যান্য প্রাণী থেকে মানুষের শারীরিক পার্থক্য অনেক। দ্বিতীয়তঃ পৃথিবীর সব প্রাণীই প্রকৃতি থেকে সরাসরি খাবার খায়, কিন্তু মানুষ পারে না। তাকে খাবার রান্না করে খেতে হয়। মানুষ ছাড়া বাকি সব প্রাণীই প্রকৃতিতে ন্যাচারালি সারভাইব করতে পারে। তারা রোদে পুড়ে, বৃষ্টিতে ভিজে সারভাইব করতে পারে। মানুষের মতো ঘর-বাড়ি, কাথা-কম্বল এসব লাগে না।
– সৃষ্টির শুরুতে তো মানুষও রান্না ছাড়াই খেত। মানুষের বুদ্ধিবৃত্তির লেভেল অনেক উন্নত। তাই সে আগুন আবিস্কার করেছে। মশলা-পাতি আবিষ্কার করেছে। খাবার রান্না করে খায়। ঘর-বাড়ি-অট্টালিকা বানায়। এসবই তার জীবনকে আরামপ্রদ করতে তার বুদ্ধির ব্যবহার। গরু-ছাগলের বুদ্ধি থাকলে তারাও ঘাস রান্না করে খেত। তারাও এসি রুমে থাকত।
– এই তো তুমি লাইনে এসেছো। মানুষ অন্য কোথাও থেকে এসেছে এটা তো ধর্মও স্বীকার করে। মানুষের উন্নত বুদ্ধিবৃত্তি দিয়ে মানুষ যার ঘরে বেড়াতে এসেছে তাদেরকেই এখন ডমিনেট করছে। সেই রিভেঞ্জই এখন প্রকৃতি নিচ্ছে।
মারুফের কাছে কান্তির এসব কথা-বার্তা কিছুটা অ্যাবসার্ড মনে হয়। বুঝতে পারে অনাগত সন্তান নিয়ে চিন্তা-ভাবনা তার কথা-বার্তাতে প্রভাব ফেলছে। সে বলল,
– বুঝলাম, কিন্তু তার সাথে বনসাইয়ের কী সম্পর্ক?
– সম্পর্ক এটাই যে, বনসাইও প্রকৃতির অংশ। মানুষ বনসাইয়ের স্বাভাবিক বৃদ্ধি ব্যহত করছে শুধু তার নিজের মনোরঞ্জনের জন্য। যেটা বনসাইয়ের পছন্দ হবার কথা না। এটা একটা উদাহরণ মাত্র। এরকম অসংখ্য ভিক্টিমের পক্ষ হয়ে তার শুভাকাঙ্ক্ষীরা যুদ্ধ ঘোষণা করেছে।
– তুমি বলতে চাচ্ছ, করোনার জীবাণু এই বনসাইয়ের শুভাকাঙ্ক্ষী?
– হতেও পারে। এরকম ছোট ছোট অনেক অন্যায়ের সমন্বিত প্রতিবাদ এই করোনা।
মহামারির কথায় আশরাফ কিছুটা দমে যায়। কী এক মহামারি এলো দেশে। দেশে কি সারা পৃথিবী জুড়েই তো এই মহামারি। এক বছরের উপর হয়ে গেল এই কোভিড-১৯ মহামারির প্রাদুর্ভাব। প্রথম ঢেউ, দ্বিতীয় ঢেউ পেরিয়ে এখন তৃতীয় ঢেউও শুরু হয়ে গেছে পৃথিবীজুড়ে। দেশে অবশ্য এখন দ্বিতীয় ঢেউ। সবকিছু প্রায় নিয়ন্ত্রণে চলে এসেছিল। কিন্তু লকডাউন কিছুটা শিথিল হতেই যেন সবার বাধ ভেঙ্গে গেল। কক্সবাজার, সেন্ট মার্টিনে ঘোরাঘুরির হিড়িক পড়ে গেল। এখন টিভিতে কোভিডের খবর দেখতে দেখতে একটা ভয় ঠিকই মনের মধ্যে কাজ করে। এই সংখ্যাগুলো কেমন মনের মধ্যে কিলবিল কিলবিল করতে থাকে। বাংলাদেশে এখন পর্যন্ত শনাক্ত সাড়ে সাত লাখ, মৃত্যু ১১ হাজারের মতো; বিশ্বব্যাপী শনাক্ত ১৫ কোটি, মৃত্যু প্রায় ৩২ লাখ। কখন কার পালা চলে আসে কে জানে। প্রথমে একটা ধারণা ছিল, শুধু বয়স্করাই এ রোগে মারা যায়। এখন তো ইয়াং লোকজনও চলে যাচ্ছে। আগে পত্রিকায় পড়তো মৃত্যুর খবর, এখন পত্রিকা পড়ে জানতে হয় না। আশেপাশের সার্কেল থেকে আত্মীয়-স্বজনে ঢুকে গেছে।
আশরাফ সেরকম অর্থে কখনোই পরিবেশবাদী ছিল না। এই ব্যাপারগুলো নিয়ে সে আসলে ঠিক সেভাবে ভাবেও না। তবে স্কুলের অর্থনীতির বইয়ে ম্যালথাসের জনসংখ্যা তত্ত্বে সে পড়েছিল, মানুষ যখন অনিয়ন্ত্রিত হারে বংশ বৃদ্ধি করতে থাকবে, প্রকৃতি যখন আর মানুষের ভার নিতে পারবে না। তখন সে নিজেই তার হাতে মানুষ কমানোর দায়িত্ব তুলে নিবে। এই করোনা মহামারি কি সেই তত্ত্বেরই প্রতিফলন? কি জানি। কিন্তু আশরাফের ব্যক্তিগত অভিমত প্রকৃতির সাথে এই সংঘাত কিছুটা অনিবার্য। এই যে আমরা মুরগি খাই, গরু খাই, ছাগল, মহিষ- আরও অনেক জীবন্ত প্রাণী খাই। কারণ তাদের ওপর আমাদের কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। তাদের না খেলে আমাদের প্রোটিনের যোগান হবে না। গায়ে শক্তি মিলবে না। পৃথিবীতে মানুষের যে অভিযাত্রা তাতে জ্বালানী জুটবে না। তাই আমরা তাদের খাই। আবার বনে-জঙ্গলে সুযোগ পেলে বাঘও মানুষ খায়। আজকে যদি বাঘ মানুষের ওপর কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা করতো, আমরা বাঘের ফুড মেন্যুতে থাকতাম। এটাই বাস্তুসংস্থান। এই পৃথিবীতে একজন আরেকজনের আহার। মশা খেয়ে ব্যাঙ বাঁচে, ব্যাঙ খেয়ে সাপ বাঁচে, সাপ খেয়ে ঈগল বাঁচে। আবার হরিণ খেয়ে বাঘ বাঁচে, বাঘ সুযোগ পেলে সুন্দরবনের আশেপাশে মানুষের ঘাড়ে কামড় বসায়- এভাবে চলতে থাকে। সবাই যদি সবাইকে খাওয়া বন্ধ করে দেয় তাহলে তো মশা, ব্যাঙ, সাপ, হরিণ, বাঘ-সিংহ গরু-ছাগলে পৃথিবী ভরে যাবে। তবে এটা ঠিক যে সবাই সবাইকে যে হারে খায়, মানুষকে কেউ সে হারে খায় না। সুতরাং মানুষের বৃদ্ধির হার বেশি। তাদের কর্মকাণ্ডও বেশি। তাদের বুদ্ধি বেশি। তাদের আধিপত্যও বেশি। তাই প্রকৃতির যখন দেয়ালে পিঠ ঠেকে যায়, তখন সে কি কিছু একটা মহামারির মাধ্যমে মানুষের লাগাম টেনে ধরে? হতেও পারে।
তবে এর সাথে বনসাইয়ের ব্যাপারটিকে আসলে সে মেলাতে পারে না। আশরাফের চিন্তাশক্তি বলে, এমনটা হওয়ার কথা না। আমরা মুরগি-গরু-ছাগল-মাছ খাই। ভাত খাওয়ার জন্য ধান গাছ লাগাই। সেই গাছ আবার কাটি, শাক-লতাপাতার জন্যেও অনেক গাছ-লতা-পাতা কাটি। বেঁচে থাকার প্রয়োজনেই এগুলি করতে হয়। বেঁচে থাকার জন্য আমাদের ধরিত্রির ওপর নির্ভর করতে হয়, Mother Earth, মায়ের মতো, ‘আলো দিয়ে বায়ু দিয়ে বাছাইছে প্রাণ’। এখন সবাই যদি অভিশাপ দেয় আর তা যদি লেগে যায় তাহলে তো পৃথিবীতে মানুষের বেঁচে থাকা মুশকিল।
আশরাফ মোবাইল ফোনটা রেখে বনসাইয়ের কাছে গেল। ভালো করে লক্ষ্য করলো গাছটার দিকে। কেমন যেন একটা বিকৃত আকৃতি পাতার নিচের দিকের শিকড়-মুল-কাণ্ডসমেত পুরো শরীরের। পাতাগুলোও কেমন সংকুচিত। আগে কখনো এভাবে দেখেনি। হঠাৎ করে কেন এমন মনে হচ্ছে? এই গাছ ঘরে থাকলে কী হবে? কোনো অমঙ্গল? কী ধরনের অমঙ্গল? কোনো অসুখ? কান্তির ধারণা তাদের অনাগত সন্তানের কোনো অমঙ্গল হতে পারে। সে সেরকমই স্বপ্নে দেখে। আশরাফ কী করবে বুঝতে পারে না। গাছটাকে কি ফেলে দিবে? ফেলে দিলে তো তার মৃত্যু হবে। বৃক্ষকে বাড়তে না দেওয়া যদি অপরাধ হয়, তাহলে তো বৃক্ষ হত্যাও পাপ হবার কথা। বৃক্ষকে হত্যার জন্যে যদি সব বৃক্ষ হঠাৎ অক্সিজেন দেওয়া বন্ধ করে দেয়। এখন তো যারা করোনা আক্রান্ত হচ্ছে, তাদের অনেকে বাতাসে ভেসে থাকা অক্সিজেন নিতে পারছে না, মারা যাচ্ছে। আশরাফ ঠিক বুঝতে পারছে না। কেমন ভাবনার একটা হ্যালুসিনেশন মনে হচ্ছে।
বনসাইটা হাতে নিয়ে উঠে দাঁড়ালো আশরাফ। কান্তির ঘরে উঁকি দিলো। কান্তিকে দেখলো। এই সময় মেয়েরা কিছুটা মুটিয়ে যায়। শরীর-স্বাস্থ্যের ঠিক থাকে না। তবু কেমন যেন একটা স্বর্গীয় সৌন্দর্য খেলা করে তাদের চেহারায়।
কান্তির চিৎকারে ঘুম ভাংলো আশরাফের। চোখ কচলে তাকালো। সকাল হয়ে গেছে? কটা বাজে? দুদিন আগ থেকে শুরু হওয়া দ্বিতীয় লকডাউনে তাদের অফিস এখন সাধারণ ছুটি। রাত করে ঘুমিয়েছে। কান্তি আবার আগে আগে ঘুমায়, উঠেও আগে আগে।
– আশরাফ, এই আশরাফ?
– কী হলো। চিৎকার করছো কেন?
– বনসাইটা কই? তুমি সরিয়েছ?
– হ্যাঁ। এত চিৎকার করার কী হলো?
– যাক্ বাবা, বাঁচালে। এখন একটু শান্তিতে ঘুমাতে পারবো। আচ্ছা ঘুমাও তুমি আরও কিছুক্ষণ। মাত্র নয়টা বাজে।
এই ঘটনার পর কান্তিকে অনেক ফুরফুরে লাগছে। তিনমাস পর কান্তি ফুটফুটে একটি ছেলে সন্তানের জন্ম দিলো। তিনদিন পর হাসপাতাল থেকে বাচ্চাসহ কান্তিকে বাসায় নিয়ে আসে। বাচ্চা ঘুমাচ্ছে, কান্তি অপলক চোখে বাচ্চার দিকে তাকিয়ে আছে। আশরাফ তাকিয়ে আছে কান্তির দিকে।
– কী এভাবে তাকিয়ে আছ কেন?
– তোমাকে একটা জিনিস দেখাবো?
– কী?
– আমার সাথে আসো, অন্য ঘরে।
কান্তি ধীরে ধীরে সাবধানে উঠে আসে। টেবিলের কাছে গিয়ে থমকে দাড়ায় কান্তি। টেবিলে ওটা কি? একটা বনসাই?
– এটা কি সেই বনসাই গাছটা? আশরাফকে একটা দিধান্বিত প্রশ্ন করে।
– হ্যাঁ?
– কোথায় ছিল?
– এই ঘরেই ছিল।
– মানে?
– লুকিয়ে রেখেছিলাম।
– কেন?
– আমি আসলে মন থেকে বিশ্বাস করতে পারছিলাম না, একটা গাছ আমাদের কোনো ক্ষতি করতে পারে। এই গাছই তো আমাদের অক্সিজেন দিয়ে বাঁচিয়ে রেখেছে। গাছটা ফেলে দিলে মরে যেত। তাই আমি এটাকে লুকিয়ে রেখেছিলাম। বিশ্বাস করো আমার একবারও মনে হয়নি যে খারাপ কিছু হতে পারে। দেখো, তোমার বা বাচ্চার কিছু তো হয়নি। আলহামদুলিল্লাহ।
– কিন্তু?
– দেখো গাছটাতে কী সুন্দর বড় বড় পাতা গজিয়েছে, অবাক করা ব্যাপার না?
কান্তি দেখলো সত্যি সত্যি গাছটির পুরনো ছোট ছোট পাতার ফাঁক দিয়ে বেশ বড় বড় সবুজ সুন্দর অনেকগুলো নতুন পাতা বেড়িয়েছে। এই পাতাগুলো সম্পূর্ণ স্বাভাবিক আকৃতির পাতা, আগেরগুলোর থেকে আলাদা। দুইটা কাণ্ড একটু বড় হয়ে বেশ কিছুটা উপরে উঠে গেছে।
– এই যে গাছটা বাড়ছে, একে আর আমরা আর না ছাটি। বাড়তে থাকুক। দূরে সরিয়ে না দিয়ে বরং যত্ন করি।
কান্তি হাসলো।
– ঠিক আছে বাড়তে থাকুক। যত্ন করে ক্ষত সারিয়ে তুলি।
তারা দুজনেই গাছটার দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে রইলো। জানালা দিয়ে আসা মৃদু বাতাসে গাছের নতুন পাতা দুলে উঠলো।
“পৃথিবীর গভীর গভীরতর অসুখ এখন;
মানুষ তবুও ঋণী পৃথিবীরই কাছে।”
– জীবনানন্দ দাশ
কপিরাইট © ২০১৭ - ২০২০ ।। বইদেশ-এ প্রকাশিত কোনও সংবাদ, কলাম, তথ্য, ছবি, কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না
Design & Development by: TeamWork BD