দিদার হোসেন-এর গুচ্ছ কবিতা
একটি বাগানের মৃত্যু
একদা এখানে একটা বাগান ছিল।
রোজ সকালে পাখিদের কিচিরমিচির শব্দে প্রতিবেশিদের ঘুম ভাঙতো,
ভ্রমরের গুঞ্জনে মৌনতা ভাঙতো,
সম্বিৎ ফিরে শুনতো একাগ্রচিত্তে কোকিল কণ্ঠে ‘আমার সোনার বাংলা আমি তোমায় ভালোবাসি’।
এখানে মৌমাছি মধু সংগ্রহ করতো,
গড়ে তুলতো মৌচাক, মৌয়ালরাও ব্যস্ততায় কাটাতো সময়।
বাগানের মালিরাও সযত্নে পরিচর্যা করতো চারাগাছগুলো, যেন তারা দিনে দিনে হয়ে ওঠে মহীরুহ।
এখানে কতগুলো স্বপ্নবাজ স্বপ্নের বীজ বুনতো,
স্বপ্ন বাস্তবায়নের সিঁড়ি একেক করে উৎরে ওঠার কৌশল রপ্ত করতো।
অথচ এখন-
ঐসব স্মৃতিচিহ্নের লেশমাত্রও অবশিষ্ট নেই এখানে।
এক বৈশ্বিক অতিমারীকাল সবই ধূলিসাৎ করে দিয়ে গড়ে তুলেছে যান্ত্রিকযানের খাবারের গামলা!
এখানে শোনা যাবে পাখিদের কিচিরমিচি আর ভ্রমরার গুঞ্জনের পরিবর্তে যান্ত্রিক আওয়াজ,
লোকালয় অতিষ্ঠ হবে শব্দদূষণে।
মৌমাছির মৌচাক আর মৌয়ালের ব্যস্ততার পরিবর্তে বাড়বে তেলজীবিদের আনাগোনা।
বাগান মালির জায়গা দখলে করবে জ্বালানি যোগানদাতা!
এখানে এখন স্বপ্নবাজদের স্বপ্নের আনাগোনা আর সিঁড়ি উৎরানোর বদলে, উচ্চগতির রেকর্ড ভাঙার দম নিতে দেখা যাবে।
এভাবেই দোর্দণ্ডপ্রতাপশালী অতিমারীর প্রভাবে পড়ে অজস্র ভ্রুণের বটবৃক্ষ হওয়ার সূতিকাগারটি পরিণত হয়েছে যান্ত্রিকতার জ্বালানি যোগানদাতায়।
এখানেই লুকিয়ে আছে একটা বাগানের অপমৃত্যুর ইতিহাস।
বিবর্ণ মেহেদী
যে মেয়েটির আজ সলিল সমাধি হলো,
কিংবা গতদিনের বিয়ের প্যান্ডেলে যার জানাজা পড়তে হলো আজ,
তার কী তবে এমন করেই চলে যাওয়ার কথা ছিল?
যে স্বপ্নকে ঘিরে, এক জোড়া নর-নারী জোট বাঁধলো,
আশা ছিল, এক ছাউনির তলে একসাথে বাঁচার!
অথচ মুহূর্তেই যেন ধ্বসে গেল তাও,
প্রমত্তা নদী সব ভেঙে করলো চুরমার।
মেহেদিরাঙা হাত এখনো শুকায়নি যার,
জীবনটা নদীজলে মিশে হলো একাকার!
কে নিবে এর দায়ভার?
চঞ্চলা নদী!
অতিরিক্ত যাত্রীবাহী নৌযান কর্তৃপক্ষ!
নাকি নিয়তির নির্মম খেলা!
অথবা প্রকৃতির চরম প্রতিশোধ!
শুধু কী মেয়েটিই মরে গেল?
সাথে তো আরেকটা ছেলেও বিপত্নীক হলো।
মরে গেছে একটা জীবন্ত স্বপ্নও!
যে চলে গেছে, সে হয়তো বেঁচে গেছে,
কিন্তু, যে বেঁচে আছে, সে তো জীবন্মৃত!
রাঙা হাতের বিবর্ণ মেহেদি তাকে তিলেতিলে কাঁদাবে!
হয়তো বা নিশ্চিন্ত শান্ত্বনা খুঁজবে বিধাতার অমোঘ বিধানে..!
ফুলশয্যার আগেই ওদের মেহেদিরাঙা হাত ধুয়ে-মুছে বিবর্ণ করেছে রাক্ষুসে নদী!!
একটা গলাবন্ধের গল্প
চাইলেই কি ছুঁড়ে ফেলা যায়?
এতকালে যার প্রতি বেড়ে গেল দায়!
দু’যুগেরও বেশি গলায় জড়িয়ে আছো তুমি,
কী করে দূরে ঠেলে দেই তোমাকে আমি?
তোমার উষ্ণতায় কাটিয়ে দেই শীত,
গলায় পেঁচিয়ে কাঁপাই শীতের ভিত!
কতটা মায়ায় ছায়া হয়ে ঘিরে আছো ললাটে মোর!
কেউ কী সেই অনুভবের গভীরতার রেখেছে খবর?
কত শীতের কুয়াশাঘেরা রজনী করেছ পার,
কত বসন্তের পত্রঝরা ঋণে ঘুছিলে শুষ্কতার!
দু’যুগ মানে, চব্বিশ বছর কিংবা তারও বেশি!
মায়া-মমতার বাঁধনে ঘিরে, টিকে ক’জন এলোকেশী?
অথচ, তুমি রয়ে গেলে, সেই আগেরই মতন;
আমিও তোমায় শীত পেরুলে করেছি যতন।
কত রঙের, কত ঢংয়ের এলো-গেলো মাঝে,
কেউ তো আসন পারেনি গাড়তে হৃদয়ের খাঁজে!
গন্ধ শুঁকে পরতে পরতে আদর মেশানো অতীত,
তোমার ঋণ কেমনে শোধিবো, ভালোবাসার ভীত!
তুমি যে আমার উষ্ণতা ছড়ানো শীতের গলাবন্ধ!
স্মৃতিটা আগলে, দু’যুগ পরেও খুঁজি দাতার সুগন্ধ!!
কপিরাইট © ২০১৭ - ২০২০ ।। বইদেশ-এ প্রকাশিত কোনও সংবাদ, কলাম, তথ্য, ছবি, কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না
Design & Development by: TeamWork BD