দ্বাদশ শতাব্দী থেকে যে সকল রাজা নেপাল শাসন করেছিলেন তাদের নামের শেষে ‘মল্ল’ শীর্ষক একটি শব্দ ছিল। ১২০১ খ্রিস্টাব্দ থেকে ১৭৭৯ সাল পর্যন্ত মল্লরা ছিলেন নেপালের শাসক। যদিও গোর্খারাজ পৃথ্বীনারায়ণ শাহ ১৭৬৮ সালে নেপালের বেশিরভাগ অংশ একত্রিত করে ১৭৬৯ সাল নাগাদ একক নেপাল রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করতে সমর্থ হন। মল্লদের শাসনামলে ষোড়শ ও সপ্তদশ শতকে মৈথিলি ভাষা পুরো নেপাল জুড়ে ছড়িয়ে পড়েছিল। এর প্রভাব পড়েছিল অধিবাসীদের শিল্প, সাহিত্য ও প্রাত্যহিক জীবনাচরণে।
মল্ল রাজবংশের শাসনামলে মৈথিলি ভাষায় অন্তত সত্তরটি নাটক লিখিত হয়েছিল। এসব নাটক অভিনয় হতো পেশাদার দল দ্বারা। দলের সদস্যগণ ‘দলিত’ নামে পরিচিত নিম্ন শ্রেণির হিন্দু ধর্মাবলম্বী শিল্পী। পেশাগত কারণে তারা কীর্তনীয়া বলে পরিচিতি লাভ করেছিলেন। কীর্তনীয়া শব্দের বাংলা অর্থ হচ্ছে কীর্তনগায়ক। নেপালের কীর্তনীয়ারাও বাংলা আভিধানিক অর্থের অনুরূপ শিল্পী। তারা মূলত ভজন ও ভক্তিমূলক গানের চর্চা করত। মৈথিলি ধারায় ‘কীর্তনীয়া’ নাটকের উদ্ভব চতুর্দশ শতক থেকে। চতুর্দশ শতকের পূর্ব পর্যন্ত নেপালে সংস্কৃত নাট্যরীতি চর্চিত হতো, তা থেকে এ ধারা ভিন্ন। বিদ্যাপতির ‘গোরক্ষবিজয়নাটক’ কীর্তনীয়া নাট্যের প্রথম নিদর্শন।
ষোড়শ ও সপ্তদশ শতকে কীর্তনীয়াগণ জনসমাগম স্থলে এবং ধনাঢ্য ব্যক্তিদের বাড়িতে মৈথিলি নাটক অভিনয় শুরু করে। এই সময়ে নেপালের রাজদরবারেও তারা অভিনয় করতেন বলে জানা যায়। সেই সময়ের একজন নাট্যকার সিদ্ধিনারায়নদেব (১৬২০-৫৭ খ্রিষ্টাব্দ) ‘হরিশ্চন্দ্রনৃত্যম’ নামে একটি নাটক রচনা করেন। বিশেষভাবে নাম উল্লেখের কারণ হচ্ছে সংলাপে ভাষার বৈচিত্র্য। কিছু চরিত্রের সংলাপ ছিল খাঁটি মৈথিলি ভাষায় আবার কিছু চরিত্রের মুখে ছিল বাংলা, সংস্কৃত, ব্রজবুলি কিংবা প্রাকৃত ভাষা।
মৈথিলি ইন্দো- আর্য ভাষাগোষ্ঠির একটি ভাষা। পুর্বে ভারতের আদমশুমারিতে এটাকে হিন্দির একটি উপভাষা হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছিল। কিন্তু বর্তমানে স্বতন্ত্র ভাষা হিসেবে বৈজ্ঞানিকভাবে স্বীকৃত হয়েছে। মৈথিলি ভারতের বিহার রাজ্য এবং নেপালের পূর্বাঞ্চলীয় তরাই এলাকায় প্রচলিত। বর্তমান ভাষাবিজ্ঞানীগণ একে পূর্ব ইন্দো-আর্য ভাষাসমূহের একটি হিসেবে চিহ্নিত করেছেন। ফলে এটা কেন্দ্রীয় ইন্দো-আর্য ভাষা বা হিন্দির মত ভাষার চেয়ে আলাদা। বাংলা, অসমীয় এবং ওড়িয়া ভাষার সাথেই এর সম্পর্ক গভীর।
মৈথিলি ভাষা লেখা হতো মৈথিলি লিপিতে, যার সাথে বাংলা লিপির যথেষ্ট মিল রয়েছে। পূর্ব দেবনাগরী লিপি থেকে সৃষ্ট হয়েছিল মৈথিলি লিপি। বর্তমানে লেখার জন্য দেবনাগরী লিপি ব্যবহৃত হয়। উল্লেখ্য সিলেটি ভাষাও এই লিপিতেই লেখা হতো এবং সিলেটিকে কখনও একটি স্বতন্ত্র কখনও বাংলার উপভাষা হিসেবে বিবেচনা করা হয়। মিথিলার কবি বিদ্যাপতির বৈষ্ণব পদাবলি বাংলায়ও সমান আদরের। ফলে বাংলার সাথে মৈথিলি ভাষার আত্নীয়তার সম্পর্ক সহজেই অনুমান করা যায়। বর্তমানে প্রায় সাড়ে চার কোটি মানুষ মৈথিলি ভাষায় কথা বলে।
ধর্মীয় কারণে বাংলা ও এর পার্শবর্তী অঞ্চল কখনও কখনও একই দর্শন ও সংস্কৃতির অনুশীলন করেছে। আবার রাজনৈতিক কারণে প্রায়শ শাসিত হয়েছে একই রাজ্যভুক্ত হিসেবে। ফলে অতীতে এই অঞ্চলের জনমানুষের তীর্থ এবং জ্ঞানান্বেষণের গন্তব্য একই। যে কারণে শিল্প, সাহিত্য, সংগীত এমনকি প্রাত্যহিক জীবনাচরণকৃত্যের বিনিময় ছিল অনিবার্য। তুলনামূলক বৃহত ভাষা ও জনগোষ্ঠি হিসেবে বাংলা অন্যদের দ্বারা প্রভাবিত হওয়ার বদলে প্রভাবিত করেছে তা ঐতিহাসিকভাবেই স্বীকৃত। প্রাচীন বাঙালি সিদ্ধা মীননাথের নাথধর্ম কেবল বাংলার আশপাশের প্রতিবেশীদের মধ্যে নয় সমগ্র ভারতেই বিস্তার লাভ করেছিল। তাই সীমান্তবর্তী উড়িষ্যা, আসাম, নেপাল, ত্রিপুরা রাজ্য যা ‘বৃহতবঙ্গান’ নামে পরিচিত, তার ওপর বাঙালি চিন্তা ও মননের প্রভাব ছিল অমোচনীয়।
আমাদের মনে রাখতে হবে বাংলার সম্পদ চর্যাপদ পাওয়া গেছে নেপালেই। সরাসরি প্রাচীন বাংলা এবং স্থানীয় ভাষার অনুবাদে আলাদা আলাদা পুথিও আবিস্কৃত হয়েছে। চর্যাপদের ১৭ সংখ্যক চর্যায় রয়েছে-
নাচন্তি বাজিল গান্তি দেবী
বুদ্ধনাটক বিসমা হোই।।
অর্থাৎ দেবী নাচলেই, বজ্রধর গাইলেই, এভাবেই কষ্টসাধ্য বুদ্ধনাটক সম্পন্ন হল। প্রাচীনকালের বুদ্ধনাটক বাংলার নিজস্ব সম্পদ তা প্রমাণিত। আর নেপালিগণ চর্যাপদের মাধ্যমে এ নাটকের সাথে পরিচিত ছিলেন ধারণা করা যায়। ফলে বাংলার প্রতি নেপালিদের আগ্রহ ছিল সেটা সহজেই অনুমেয়। শিব বিষয়ক নানা কৃত্য যা নাট্য হিসেবেও স্বীকৃত এবং বর্তমানে গম্ভীরা নামে পরিচিত তাও অন্যান্য প্রতিবেশীর মতো নেপাল রাজ্যেও চর্চিত হয়েছিল। পূর্বেই উক্ত, নেপালের রাজ দরবারে কীর্তনীয়াগণ যৌথ ভাষায় নাট্যাভিনয় করতেন। এইসব নাটককে ‘ভাষা নাটক’ বলা হয়। কিছু ভাষা নাটক বাঙালি কবিদের দ্বারাও রচিত হওয়ারও প্রমাণ মেলে। দুটি ভিন্ন ভাষায় রচিত তাই ‘ভাষা নাটক’ হিসেবে কোন কোন বিশেষজ্ঞ চিহ্নিত করেছেন। প্রকৃত রচয়িতাগণ তাদের নাটককে এই নামে অভিহিত করেননি।
বাঙালির নিজস্ব দর্শন এত শক্তিশালী যে মধ্যযুগে প্রভাবশালী সংস্কৃত রীতি অনুযায়ী নাট্যচর্চা এখানে হয়নি। তার বদলে ওই ভাষায় নিজস্ব রীতি অনুযায়ী নাট্য রচনার প্রমাণ মেলে জয়দেবের ‘গীতগোবিন্দ’ থেকে। এই দৃশ্যকাব্যের ভাষা সংস্কৃত। কিন্তু ত্রিচরিত্র এমন নাট্য সংস্কৃত সাহিত্যে একটিও নেই, উল্লেখ নেই নাট্যশাস্ত্রেও। উদাহরণ আছে কেবল আছে বাংলায়। নাট্যশাস্ত্রে বাঙালিদের নিজস্ব নাট্যকে ‘ওড্রমাগধী’ রীতি হিসেবে চিহ্নিত করেছেন ভরতমুনি। ওড্রমাগধি রীতি ভারতী ও কৌশিকী দুটি প্রবৃত্তির আশ্রয়ে রচিত। এর বৈশিষ্ট্য সম্পর্কে ভরতমুনি বলেছেন, এ দুটি বৃত্তি ‘বহুনৃত্তগীতবাদ্য’ সংযুক্ত ললিত-অঙ্গাভিনয়। মধ্যযুগে পাঁচালির পরিবেশনারীতি বিশ্লেষণ করলে এর প্রমাণ মেলে। বাঙালি নিজেদের জন্য রচনা করেছে পাঁচালি। আবার নেপালি রাজদরবারের জন্য মৈথিলি ও বাংলা যৌথ ভাষায় রচিত নাটকে ‘বহুনৃত্তগীতবাদ্য’ প্রযুক্ত করলেও তা সংস্কৃত রীতি অনুসরণ করে লিখেছে। এটাকে আমরা ওই রাজসভার নিজস্ব রুচি বলে চিহ্নিত করতে পারি।
নেপালের রাজদরবারে বাংলাকে গুরুত্ব দেওয়ার কারণ- মল্ল বংশীয় রাজাদের পুরোহিত ছিলেন বাঙালি। নেপালে ‘নৃত্য স্মারক’ দশ ভূজধারী ‘নৃত্যনাথ’ রূপে পূজিত। এই নৃত্যনাথ যে বাঙালি শিবের নেপালি সংস্করণ তা বুঝতে বেগ পেতে হয় না। কারণ শিবের অন্য রূপ চতুর্ভূজধারী, গলায় সাপের বদলে মৃদঙ্গ। এতে নান্দীগীতের পর জমনিকা সংস্থাপন উপলক্ষ্যে সূত্রধারের নান্দীপাঠ। জমনিকা হচ্ছে জমনিকা পট্ট-পুতুল নাচ ও নাট্যাভিনয়ে ব্যবহৃত হয়, যাত্রাভিনয়েও এর ব্যবহার ছিল, নারায়নদেবের মনসামঙ্গলেও উল্লেখ রয়েছে। ফলে ‘নৃত্য স্মারকের’ জমনিকা পট্ট যে বাংলা প্রভাবিত সেটা অনুমান করা যায়।
সপ্তদশ শতকে জগর্জ্জ্যোতিমল্ল বৃজবুলিতে পঞ্চাটি গান রচনা করেন। যেগুলো পরে ‘কুঞ্জবিহারী’ এবং ‘মুদ্রিত-কুবলয়াশ্ব’ নাটকে ব্যবহার করা হয়। বাংলা ও মৈথিলি যৌথ ভাষার নাটকে সংলাপকে বলা হয় ‘ভাষা’, দৃশ্য হচ্ছে ‘লু’, গানকে কখনও ‘মে’ কখনও ‘মেপু’ বলা হয়েছে। ‘মুদ্রিত-কুবলয়াশ্ব’ নাটকের দ্বিতীয় লু’তে উল্লেখ আছে-
নচারী।। কৌশিক।। এ
জাহি জনকো ধরমহি চীতি
সে মোর সহজ সহোদর মীতি।।
সম্পতি দান ভোগ নাসহি জাএ
অবসর এক প এ ধরম সহাএ।।
মধ্যযুগে বাঙালির গর্ব ‘পাঁচালি’, তার পাঁচটি অঙ্গ। পাঁচালি অর্থাৎ পা চালনা পূর্বক, ভাবকালি অর্থাৎ হাবভাব সহকারে, নাচাড়ি অর্থ নৃত্যসহযোগে, বৈঠকি অর্থাৎ বসে বসে, দাঁড়াকবি অর্থাৎ দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে-প্রণয় পাঁচালি এবং কৃত্য পাঁচালি দুটির পরিবেশন রীতি বিশ্লেষণ করে এই পাঁচটি বৈশিষ্ট্য চিহ্নিত করা যায়। প্রাচীন বা মধ্যযুগে সংস্কৃত বা অন্য কোন ভাষায় চর্চিত নাটকে নাচাড়ির খোঁজ মেলে না। ‘নাচাড়ি’ উল্লেখ থাকা পদটি নৃত্যসহযোগে গাইতে হয়, মধ্যযুগের বাংলা নাট্যের যা অপরিহার্য বৈশিষ্ট্য ।
‘মুদ্রিত-কুবলয়াশ্ব’ নাটকে সংলাপ মূলত সংক্ষিপ্ত এবং বাংলা ও মৈথিলি মিশ্র। বৃহত সংলাপও কিছু মেলে। কোন অংশটি কীভাবে অভিনয় করতে হবে তার সংকেত যৌথ ভাষার নাটকে লভ্য। এ রকম সংকেত হচ্ছে ‘গদ্য’ যা কথোপকথন নির্দেশ করে, ‘কোণভাষা’ যা নির্দেশ করে সংলাপ। ‘মুদ্রিত-কুবলয়াশ্ব’ নাটকের সংলাপে মৈথিলি-বাংলার ব্যবহার নিম্নরূপ-
কোণভাষা
গালব । হে চ্ছাত্র, ঈ বস্তু লএ রাজা আরাধনা করু।
শিষ্য । তথী সংদেহ কওন।।
দ্বিতীয় কোণ
শিষ্য । হে আচার্য সভা দেরি ভেল।
গালব । রাজাক থাঞো শুভাশীর্বাদ করব।।
গারব । হে দ্বারী, গালব ঋষি আএলচ্ছথি, রাজা জনাউ।
দ্বারী । সর্ব্বথা।।
ভাষা বিশ্লেষণ করে দেখা যায় এগুলো একই সাথে গীতল এবং বর্ণনাত্বক। মধ্যযুগের বাংলা নাটকের বৈশিষ্ট্যই গীতল বর্ণনাধর্মিতা। মঙ্গলকাব্য কিংবা পূর্ববঙ্গীয় গীতিকার ব্যবচ্ছেদ করলে যা স্পষ্ট হয়। দ্বিজরাম ভদ্র রচিত ‘ললিত কুবলয়াশ্ব-মদালসোপাখ্যান’ নাটকে বাংলা-মৈথিলি যৌথ ভাষায় বৃহত একটি সংলাপে পাই-
কুণ্ডলা । হে রাজ, গংধবরাজ বিশ্বাবসুক তনয়া, মদালসা নাম। অতি বিচক্ষণা, মন্ত্রিরাজ বিংধ্যবানক বেটি, কুণ্ডলা মাম মোঞে, পুষ্করমালীকে পত্নী, সম্ভাসুরে, সে মারলাহ, তাহি দিন সঞো তীর্থভ্রমণ কএল, মদালসা হমরা অত্যন্ত প্রেম একদা হমরা দুহু ব্যক্তি, বনবিহার করইচ্চলাহু, বজ্রকেতুক পুত্র, পাতালকেতু মহাদুষ্ট, তমোময় মায়া কএ কভূ হরি লএ অনলক ও পাপিষ্ঠ ঈ বিয়াহ এ উদ্যমলি, তে বিষাদে দোসরা দিন এর মর এ উদ্যমল, ওহিটা সময় আকাশবানী ভেলী পাতাল কেতু মারি তেরহদিন ভিতর তোহরা উচিত স্বামী মিলত, জে পাতালকেতু মারত, সে হো এত স্বামী ইচ্ছ তোহরা ঠাম ভেল, তে সংকা মূর্চ্ছা ভেলইক।।
সংলাপগুলো গীতল হলেও আসলে তা গদ্য। সংস্কৃত নাটকের সংলাপে গদ্য ব্যবহার হয়নি কোথাও। ফলে নেপালের ‘মৃদ্রিত-কুবলয়াশ্বের’ সংলাপে গদ্যের রীতি বাংলা প্রভাবিত এবং এই বর্ণনা গীত হতো ধারণা করাই যুক্তযুক্ত।
বাংলায় প্রচলিত গোপীচন্দ্র ও ময়নামতির কাহিনী অবলম্বনে নেপালে ‘গোপীচন্দ্র-নাটক’ রচিত হয়। যার দুটি পুথি আবিস্কৃত হয়েছে। উক্ত নাটকের পাত্রপাত্রীর নামও বাংলা ‘গোপীচন্দ্রের সন্ন্যাস’ এর অনুরূপ। সংলাপেও বাংলা ভাষা ব্যবহারের আধিক্য লক্ষণীয়। ‘গোপীচন্দ্র-নাটক’ এর সংলাপে বাংলা ভাষার ব্যবহার নিম্নরূপ-
কোটোয়াল । বঙ্গদেশের অধিপতি মহারাজার গোপীচন্দ্র তার কোটবার কলিঙ্গা নাম অমী আছে।
ভাগিখোর । ভাল কহিলেন। অহে খেতু মহাপাত্র কলিঙ্গা কোটবার আমার এক বচন অবধান করো।
খেতু । সর্ব্বথা।
ভাগিখোর । সমস্ত লোক বধিয়া দাড়িয়া লুটিয়া আনিয়া এমন কর্ম্ম করিয়া সুখভোগ করিয়া থাকিলো আমার সমান ভাগিখোর নাম না আছে।
খেতু । সত্য কহিলেন। অহে কলি্ঙ্গ কোটবার তুমার হমার রাজা গোপীচন্দ্র আছে তার দর্শন করিতে জায়বো চলো।
নেপালের দরবারে অভিনীত ‘ভাষা নাটকে’ বাংলা-মৈথিলি যৌথ ভাষায় ‘মে’ বা গানও ব্যবহৃত হয়েছে। মধ্যযুগে বাংলায় চর্চিত পাঁচালির গানে দোহার ব্যবহার গুরুত্বপূর্ণ। দ্বিজরাম ভদ্র রচিত ‘ললিত কুবলয়াশ্ব- মদালসোপাখ্যান’ নাটকে বাংলা-মৈথিলি যৌথ ভাষার একটি গানে ধ্রুব পদের ব্যবহার দেখা যায়-
।।ম।। গৌরী।। প্র।।
মন চিন্তা না কর চিন্তা না
হরিপদপংকজ বদং না।।
যে মাগব সে সফল করনা
ভবদুখসাগর সংতরনা।। ধ্রু।।
বাংলায় ধ্রুবপদ সাধারণত দোহারদের দ্বারা গীত হয়। গানটি বিশ্লেষণ করে দেখা যায় এটা কোন চরিত্রের সংলাপাত্বক নয়, সূত্রধার কিংবা নটীরও নয়। অন্য একটি পদে তিনটি ধুয়া বা দিশা দেখে একথা মনে করাই সঙ্গত যে পদটি মূলত দোহারের। ফলে এগুলো যে বাংলা লীলানাট্যের প্রভাবজাত এ ধারণা অমূলক নয়।
নেপালে রচিত ‘বিদ্যাবিলাপ’, ‘মহাভারত’ এবং ‘মাধবানল’ এই তিনটি নাটক বাঙালি নাট্যকারের লেখা বলে অনুমিত হয়েছে। বিশেষজ্ঞদের মতে এগুলোর ভাষা পুরোনো হলেও তা কবি কৃষ্ণরামদাস, ভারতচন্দ্র ও রামপ্রসাদের ভাষার কাছাকাছি। কৃষ্ণদেব কৃত ‘মহাভারত’ নাটকে বাংলা ও মৈথিলি নাট্য আঙ্গিকের পূর্ণাঙ্গ বিকাশ ঘটেছে বলে মনে করা যায়। ভারতচন্দ্রের বিদ্যাসুন্দরে গানে শেষে নৃত্য সংকেত হিসেবে মৃদঙ্গের বোল উল্লেখ পাই, কৃষ্ণদেবের মহাভারতেও যা অনুসৃত হয়েছে। কিছু গান রাগ সংবলিত এবং ধ্রুবপদ বিশিষ্ট। কাশীনাথকৃত ‘বিদ্যাবিলাপ’ নাটকে পাওয়া যায়-
পহড়িয়া।। প।।
ঘোর কানন মাঝ জোহ বজায়।
পেট ভরব দুহু বনচর খায়।।
ঘোরদশন রাক্ষসীন অহল যায়।।
মল্লারি।। রঘু।।
ঘোরমুখি সিকার করব মাঝে।। ধ্রু।।
মুদঘোস মৃগ খগ, শূকর মারি কহু,
খায়ব তোহ হম সংগে।
ঘোর বিপিন রহি, উদর পুরীত কয়,
খেলায়ব দুহু মিলি রংগে।।
এমন রাগ বিশিষ্ট গান নর্তকীর পক্ষে নৃত্যের মতো কঠিন কাজের সাথে সম্পন্ন করা দুরুহ কাজ। ফলে মনে করা যায় এগুলো দোহার দ্বারাই গীত হতো যাতে অভিনেত্রী কণ্ঠ বিশ্রামের সুযোগ পায়। চরিত্রাভিনয়ে গায়েন-দোহার রীতি বাংলার নিজস্ব উদ্ভাবন। নেপালের রাজদরবারে অভিনীত সকল নাটকে ধ্রুপদী সংস্কৃত নাটকের বৈশিষ্ট্য বিদ্যমান থাকলেও প্রকৃতপক্ষে এগুলো গীতি-নৃত্যাশ্রয়ী বাংলা নাটগীত এবং লীলানাট্যের প্রভাবজাত এবং অনুপ্রাণিত এ ধারণা যুক্তিসিদ্ধ।
(ইন্টারনেট থেকে প্রাপ্ত তথ্য এবং সেলিম আল দীন কৃত ‘মধ্যযুগের বাঙলা নাট্য’ অবলম্বনে লেখা।)
কপিরাইট © ২০১৭ - ২০২০ ।। বইদেশ-এ প্রকাশিত কোনও সংবাদ, কলাম, তথ্য, ছবি, কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না
Design & Development by: TeamWork BD