॥ চিত্তরঞ্জন সাহা ॥
কেন বই পড়ি?
মানুষের জীবনে বই প্রকৃত ও একান্ত বন্ধু। সুখ-দুঃখ উভয় অবস্থাতেই বই প্রকৃত বন্ধুর কাজ করে। বই যেমন চরিত্র গঠনে সহায়তা করে, সৎ গুণাবলীর অনুশীলনেও তেমনি বিশিষ্ট ভূমিকা পালন করে। বইয়ের সাথে ব্যক্তি ও সমাজের সম্পর্ক অবিচ্ছেদ্য।
পশুপাখি জন্মলাভের কিছুদিনের মধ্যে অতি সহজে পশুত্ব অর্জন করে। মানুষ জন্মলাভ করার পর মানব শ্রেণিভুক্ত হয় বটে, কিন্তু সঙ্গে সঙ্গে মনুষ্যত্ব লাভ করতে পারে না। মনুষ্যত্ব অর্জনের জন্যে তাকে দীর্ঘ ও কঠোর সাধনা করতে হয়। সে সাধনার অন্যতম প্রধান হাতিয়ার নিঃসন্দেহে বই।
বই মানুষের মনকে মহৎ করে, হৃদয়কে উদার করে, চরিত্রকে করে উন্নত। অনুপ্রেরণা সঞ্চারে গ্রন্থের ভূমিকা অনন্য। বই ভুল ধরিয়ে দেয়, সাহায্য করে সংশোধন করতে। কুসংস্কারমুক্ত মন সৃষ্টিতে, দেশপ্রেমে উদ্বুদ্ধ করতে, সমাজ-দরদী সৎ ও নিষ্ঠাবান চরিত্র গঠনে বইয়ের দান অপরিসীম, অপরিমেয়। তাই চক্ষুর সংখ্যা বৃদ্ধি তথা জ্ঞান অর্জনের সহজ উপায় সম্পর্কে সৈয়দ মুজতবা আলী বলেছেন : ’প্রথমত বই পড়া এবং তার জন্য দরকার বই পড়ার প্রবৃত্তি।’
বইয়ের চিরন্তন মূল্য সম্পর্কে ওমর খৈয়াম বলেছেন : ‘মদ-রুটি ফুরিয়ে যাবে, ঘোলাটে হয়ে আসবে প্রিয়ার কাজল-কালো চোখ, কিন্তু বই অনন্তযৌবনা।’
বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ বলেছেন : ‘মানুষ বই দিয়ে অতীত ও ভবিষ্যতের মধ্যে সাঁকো বেঁধে দিয়েছে।’ বর্তমান মানবসভ্যতা যে পর্যায়ে পৌঁছেছে, মানব সৃষ্টির শুরুতে তার কোনো চিহ্নই ছিল না। বিভিন্ন যুগে মনীষীরা তাঁদের চিন্তা-ভাবনা দ্বারা মানবসভ্যতাকে নানা প্রতিকূলতার মধ্যে কিভাবে ধাপে ধাপে এগিয়ে নিয়েছেন, একমাত্র বই পড়ে আমরা তা জানতে পারি।
পল্লীকবি জসীমউদ্দিনের ভাষায় : ‘বই জ্ঞানের প্রতীক, বই আনন্দের প্রতীক।’ বই পড়ে আমরা শুধু জ্ঞান লাভই করি না, গ্রন্থ পাঠের মধ্য িদেয় আমরা পরম আনন্দও লাভ করি, আনন্দ-সাগরে ডুবে থেকে আমরা আমাদের জীবনের শোক-দুঃখ, বিরহ-বেদনা ভুলে থাকতে পারি।
মনীষী টুপার বইয়ের মূল্য নির্দেশ করতে গিয়ে বলেছেন : ‘একটি ভালো বই বর্তমান ও চিরদিনের জন্য সবচেয়ে উৎকৃষ্ট বন্ধু।’ আমাদের সমাজ-জীবনে দেখা যায়, কোনো মানুষের যখন প্রচুর বিত্ত ও সম্পদ থাকে, তখন বসন্তের কোকিলের মতো তাঁর অসংখ্য বন্ধু এসে জোটে। কিন্তু তিনি দুর্ভাগ্যক্রমে বিত্তহীন ও সম্পদশূন্য হয়ে পড়লে সুসময়ের বন্ধুরা অতি দ্রুত তাঁর সংস্পর্শ ত্যাগ করে। ফলে নির্ধন ও নির্বান্ধব ব্যাক্তিটির নিঃসঙ্গ জীবন হয়ে পড়ে দুর্বিসহ ও দুঃখময়। কিন্তু বইয়ের ভূমিকা সম্পদে-বিপদে, আনন্দ-বেদনার অকৃত্রিম বন্ধুর মতো। শোকে মুহ্যমান, দুঃখে ভারাক্রান্ত মানুষ যখন মুষড়ে পড়ে, তখন শোক-দুঃখ-বেদনা থেকে পরিত্রাণ লাভের উপায় গ্রন্থপাঠ। পুস্তক পাঠে মনোবেদনা ক্রমেই লাঘব হতে থাকে, ধীরে ধীরে আনন্দের রাজ্যে প্রবেশ করা সম্ভব হয়। বই শোকে সান্ত্বনা, দুঃখে শান্তি। এই অমৃতের সমুদ্রে নিমজ্জিত হলে দুঃখ দূর হয়, মন আনন্দে পূর্ণ হয়। বই শান্তি, সান্ত্বনা, আনন্দের খনি। অলিভার গোল্ডস্মিথ তাই বলেছেন : ‘দুঃখ-দুর্দশাগ্রস্তদে রকাছে বই প্রিয় ও মধুর সঙ্গীতের মতো।’
মহামতি টমাস আলভা এডিসন বলেছেন : ‘ব্যায়ামের দ্বারা যেমন শরীরের উন্নতি হয়, তেমনি পড়াশোনার দ্বারা মনের উন্নতি হয়ে থাকে।’ শরীরের উন্নতির জন্যে ব্যায়াম অপরিহার্য। সে ব্যায়ামও যেন তেনভাবে করলে অনেক সময় লাভের চেয়ে ক্ষতি হয় বেশি। উপযুক্ত প্রশিক্ষকের কাছ থেকে ব্যায়ামের বৈজ্ঞানিক পদ্ধতি শিক্ষা করে শরীরের অবস্থা অনুসারে তা অনুশীলন করা দরকার। ঠিক তেমনি পড়াশোনার সময়ও ভালো বই নিয়ে সেগুলি পড়া দরকার। কারণ ভালো বই মনকে উন্নত করে, খারাপ বই তেমনি মনের ঘটায় অবনতি। গ্রন্থ পাঠে অসৎ চিন্তা-ভাবনা থেকে মুক্ত হয়ে মন হয় মহৎ।
লিও টলস্টয়ের বাণী : ‘জীবনে মাত্র তিনটি বিষয়ের প্রয়োজন : বই, বই আর বই।’ কিশোর ও তরুণ বয়সে জীবনাদর্শ সৃষ্টিতে এবং চরিত্র গঠনের জন্য বই যেমন অপরিহার্য, মধ্য বয়সেও কর্ম-প্রেরণা সৃষ্টি ও পোশাগত দক্ষতা বৃদ্ধির জন্যই তেমনি অবশ্য প্রয়োজনীয়। বার্ধক্যে তথা অবসর জীবনে একমাত্র বই-ই মানুষকে জরা গ্রাস ও হতাশা থেকে মুক্ত করতে পারে। বয়সে বুড়িয়ে গেলেও একমাত্র বই-ই মানুষকে মনের দিক থেকে বাঁচিয়ে রাখে, রাখে সজীব, আনন্দময়।
সমাজে উচ্চশিক্ষিত, শিক্ষিত ও অর্ধশিক্ষিত তিন শ্রেণির লেখাপড়া জানা লোক বিরাজমান। এই তিন শ্রেণির মধ্যে যিনি দেশপ্রেমিক, উদার-হৃদয়, কুসংস্কারমুক্ত, সমাজ-দরদী, সৎ ও নিষ্ঠাবান, তিনি দেশের জন্য সবচেয়ে মূল্যবান গুণে সমৃদ্ধ ব্যক্তি জাতিকে অনেক কিছু দিতে পারেন। একমাত্র সৃজনশীল সাহিত্য পাঠের মাধ্যমেই আদর্শ মানুষ সৃষ্টি হতে পারে।
সমস্যা : আমাদের দেশে বইয়ের আজ বড় দুর্দিন। যারা বইকে ভালোবাসেন, তাদের হাতে টাকা নেই। যাদের হাতে রয়েছে অজস্র অর্থ, তাদের রয়েছে বইয়ের প্রতি চরম অনীহা। আমাদের দেশের সামাজিক পরিবেশ, আর্থ-সামাজিক অবস্থা, অপসংস্কৃতির প্রভাব, বইয়ের সামাজিক অমর্যাদা, সুসাহিত্যের ক্ষেত্রে পাহাড় প্রমাণ বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছে।
বই উৎপাদনের যাবতীয় কাঁচামালের দাম বেড়ে যাওয়ায় স্বাভাবিকভাবে বইয়ের দাম ক্রমান্বয়ে বাড়ছে। এর বিপরীতে মুদ্রাস্ফীতির দরুণ পাঠকের ক্রয়ক্ষমতা দিনের পর দিন কমছে। এর প্রতিকারের একমাত্র উপায় প্রচুর সাধারণ পাঠাগারের প্রতিষ্ঠা। সবচেয়ে বিত্তশালী দেশ আমেরিকার জনগোষ্ঠীর আর্থিক অবস্থা তুলনামূলকভাবে ভালো হওয়া সত্ত্বেও সেখানে প্রকাশিত ৮০% বই সাধারণ পাঠাগারের মাধ্যমে বিক্রি হয়। কিন্তু মাত্র কয়েক শ পাঠাগার নিয়ে এগারো কোটি লোকের দেশ বাংলাদেশের বই প্রকাশনা কিভাবে তার অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখবে সেটিই চিন্তার বিষয়। এ সমস্যা নিরসনে কতিপয় প্রস্তাব নিচে পেশ করছি :-
সমাধানের প্রস্তাব : (ক) বইয়ের মূল্য যথাসম্ভব কম রাখার উদ্দেশ্যে প্রকাশনাকে শিল্প হিসেবে ঘোষণা, শিল্পের যাবতীয় সুযোগ-সুবিধা প্রদান, ব্যাংক ঋণের ব্যবস্থা এবং ভর্তুকি মূল্যে কাগজ সরবরাহের ব্যবস্থা করতে হবে।
(খ) ছাত্র-ছাত্রীদের মধ্যে পাঠাভ্যাস সৃষ্টির লক্ষ্যে প্রত্যেক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে সপ্তাহে অন্তত এক পিরিয়ড তাদের গ্রন্থাগারে নিয়ে গিয়ে পাঠাভ্যাসের ব্যবস্থা করতে হবে।
(গ) দেশের বিভিন্ন স্থানে বুক ক্লাব প্রতিষ্ঠা করে বই পড়া সম্পর্কে আলোচনার এবং সদস্যদের মধ্যে বই আদান-প্রদানের ব্যবস্থা করতে হবে।
(ঘ) সরকারি অনুদান ও বেসরকারি সহযোগিতায় প্রত্যেক উপজেলায় সাধারণ পাঠাগার স্থাপনের ব্যবস্থা করতে হবে।
(ঙ) ৫৫ হাজার বর্গমাইলে অবস্থিত পাঠেচ্ছু ব্যক্তিদের কাছে বইকে সহজপ্রাপ্য করতে হলে বইয়ের ক্ষেত্রে ডাকমাশুল হ্রাস করতে হবে।
(চ) সরকারি বা বেসরকারি উদ্যোগে যখনই যে স্থানে নতুন বাজার সৃষ্টি হবে, সেখানে মাছ, তরিতরকারি, মনোহারী দ্রব্য, কাপড় ইত্যাদির মতো বইয়ের বাজারও গড়ার সুযোগ দিতে হবে।
(ছ) বইকে সেরা উপহারের মর্যাদা দিয়ে বই অথবা বইয়ের কুপনের মাধ্যমে উপহার দেওয়ার প্রথা জনপ্রিয় করে তুলতে হবে।
(জ) মানুষের অন্যান্য হবি (HOBBY)-র মতো বই পড়াকেও হবি হিসাবে গড়ে তোলার প্রচেষ্টা চালাতে হবে।
(ঝ) বাজারে অসংখ্য সিনেমা পত্রিকা দেখা যায়, কিন্তু জাতীয় গ্রন্থকেন্দ্র প্রকাশিত ‘বই’ ভিন্ন বই সম্পর্কে এ ধরনের আর কোনো পত্রিকা নেই। বিভিন্ন পুস্তক-প্রিয় সংগঠন অথবা বাংলাদেশ পুস্তক প্রকাশক ও বিক্রেতা সমিতি, এমন কি ব্যক্তিগত প্রকাশনা প্রতিষ্ঠান থেকেও এ জাতীয় উদ্যোগ গ্রহণ করা যেতে পারে।
(ঞ) দেশের গুরুত্বপূর্ণ স্থান যেমন, বিমানবন্দর, রেলওয়ে স্টেশন, পেট্রোল পাম্প, পর্যটন কেন্দ্র এবং ডাকঘরের কাছেও বই বিপনি খোলা প্রয়োজন।
(ট) বাংলা ও খ্রীষ্টীয় নববর্ষ, অমর একুশে ফেব্রুয়ারি এবং গ্রন্থসপ্তাহে প্রত্যেক জেলা ও উপজেলায় বইমেলা অনুষ্ঠানের ব্যবস্থা করে বইকে জনপ্রিয় করে তুলতে হবে।
[ পুনর্মুদ্রণ ]
কপিরাইট © ২০১৭ - ২০২০ ।। বইদেশ-এ প্রকাশিত কোনও সংবাদ, কলাম, তথ্য, ছবি, কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না
Design & Development by: TeamWork BD