দেশের বইয়ের একটি নিয়মিত আয়োজন পাঁচটি প্রশ্ন। লেখক-প্রকাশকের কাছে বই প্রকাশনাসংশ্লিষ্ট অভিজ্ঞতা নিয়ে প্রশ্নগুলো করা। আজকের পাঁচটি প্রশ্ন আয়োজনে আমরা মুখোমুখি হয়েছি কবি, লেখক ও কাউন্সেলর শিল্পী রহমান-এর
প্রথম বই প্রকাশের অভিজ্ঞতা জানতে চাই।
উত্তর : প্রথম বই প্রকাশের অভিজ্ঞতা খুব ভালো। আমি দেশের বাইরে থাকি বলে, কোনাে প্রকাশককেই চিনতাম না। সত্যি বলতে কি, বই প্রকাশনা সম্পর্কে কোনাে ধারণাই ছিল না আমার। তাই আমার এক পুরনো বন্ধু এবং ছোটভাই লেখক সাদাত হোসাইনকে জিজ্ঞেস করলাম। সাদাতই আমাকে ভাষাচিত্র প্রকাশনীর কথা বলল এবং ফোন নাম্বার দিলো। অস্ট্রেলিয়া থেকে কথা হলো প্রকাশক খন্দকার সোহেল ভাইয়ের সঙ্গে। উনি অত্যন্ত উদারতার সঙ্গে আমার বইয়ের দায়িত্ব নিলেন। প্রথম বই, কিন্তু আমি নিজে দেশে নেই বলে একটু টেনশন হচ্ছিল। কিন্তু ভাষাচিত্র প্রকাশনী খুব সুন্দরভাবে সবকিছু ম্যানেজ করে নিয়েছিল। সেই বছর বইমেলার শুরু থেকেই আমি দেশে ছিলাম না, আমার মা নিজে বইমেলা গিয়ে স্টল থেকে বই কিনে আমাকে ছবি পাঠিয়ে সারপ্রাইজ দিয়েছিলেন। আমি সেই দৃশ্য দেখে না কেঁদে পারিনি।
মায়ের চোখে মুখে গর্বের হাসি দেখলে কার না ভালো লাগে! তারপর বাংলাদেশে গিয়ে বইটি যখন প্রথম স্পর্শ করলাম তখন ভীষণ জোরে প্রাণ খুলে চিৎকার করেছি, গন্ধ নিয়েছি। সবকিছু খুব সুখের ছিল। আরেকটা বিষয় না বললেই নয়, আমি বই প্রকাশ করছি শুনে আমার ছোটবেলার বন্ধু বাংলাদেশের প্রখ্যাত সংগীতশিল্পী ফাহমিদা নবী এতটাই খুশী হলো যে আমাকে সেই বই থেকে কবিতা আবৃত্তি করে ওর নিজস্ব প্রোডাকশন “আনমল প্রেজেন্টস” থেকে একটা সিডি বের করে ফেলল! তারপর সবাই মিলে বাংলা একাডেমিতে গিয়ে সেই বই এবং সিডির মোড়ক উন্মোচন হলো, সবকিছু মিলে অসাধারণ অনুভূতি ছিল।
লেখালেখির ইচ্ছেটা কেন হলো?
উত্তর : আমি ছোটবেলা থেকে চিঠি লেখা ছাড়া তেমন একটা লেখালেখি করিনি। তবে আমার চিঠির প্রশংসা করতো সবাই। একদম ছোটবেলায় হয়তো দুয়েকটা ছড়া লিখেছিলাম, ওই অতটুকুই।
মানুষ বলে একাকীত্ব বা কষ্টের সময়টা নাকি কবিতা লেখার জন্য উত্তম। আমিও ঠিক ওই ক্যাটাগরিতে পরে দুয়েকটা কবিতা লিখতে শুরু করেছিলাম। লিখতে লিখতে যখন বেশ কিছু কবিতা হয়ে গেল, তখন আমার হাজবেন্ড পরামর্শ দিলেন কবিতাগুলোকে বইয়ে তুলে রাখতে। সেই থেকে বই প্রকাশের ইচ্ছে মাথায় এলো। তাছাড়া তখন থেকেই লেখালেখিটা একদম নেশা হয়ে গেছে। হয়তো আমার অনেক বলবার আছে বলেই লিখতে ভালোবাসি। তাছাড়া এখন বাংলাদেশে কাউন্সেলিং এবং কাউন্সেলিং-এর প্রয়োজনীয়তাকে প্রমোট করবার আপ্রাণ চেষ্টা করছি। তাই এই প্রসঙ্গে বই লিখে মানুষের কাছে পৌঁছে দিতে চাই এই জরুরি বার্তা। সেই কারণেই এই বিষয়ে লেখালেখির ইচ্ছের কোনাে শেষ নেই। যেটুকু জানি সেটুকুই মানুষের কাছে পৌঁছে দিতে চাই, যেন সবাই মানসিকভাবে সুস্থ থাকে, শান্তিতে থাকে।
লেখক জীবনের মজার কোনো অভিজ্ঞতা জানতে চাই।
উত্তর : একবার একটা লেখা মেসেঞ্জারে আমার এক বন্ধুকে পাঠাতে গিয়ে ভুল করে একই নামে একজন সম্পূর্ণ অপরিচিত মানুষের কাছে পাঠিয়ে দিয়েছিলাম। যখন বুঝতে পারলাম তখন সেই অপরিচিত মানুষটির কাছে ক্ষমা চাইলাম। উনি অত্যন্ত ভদ্রতার সাথে তার উত্তর দিলেন এবং লেখাটা সম্পর্কে খুব ভালো রিভিউ দিলেন। অত্যন্ত শিক্ষিত, রুচিশীল একজন মানুষের কাছে লেখার প্রশংসা জেনে ভালোই লাগল। এরপর কয়েক বছর পেরিয়ে গেছে। আমরা খুব ভালো বন্ধুতে পরিণত হয়েছি। সত্যি বলতে কি উনি এখন আমার অনেক কাছের একজন বন্ধু। যদিও কখনো দেখা হয়নি আমাদের। এই ঘটনাটা মজার কিনা জানি না, তবে আমার কাছে খুব গুরুত্বপুর্ণ।
বাংলাদেশে সৃজনশীল লেখালেখির ভবিষ্যৎ সম্পর্কে আপনার মতামত জানতে চাই।
উত্তর : আমি খুব সামান্য একজন মানুষ, তার চেয়েও অতি সামান্য একজন লেখক, ৭টা বই বের করবার পরেও নিজেকে লেখক বলতে ভয় পাই। অনেক কম জানি আমি। তাই এই বিষয়ে কিছু বলাটা ঠিক হবে কি না জানি না।
তবুও নিজের জায়গা থেকে বলছি, আমি অনেক বড় বড় লেখক বা প্রকাশককে দেখেছি অন্য লেখক বা লেখালেখির মান নিয়ে খুব তুচ্ছ তাচ্ছিল্য করে কথা বলেন। এটা আমার কাছে অপ্রয়োজনীয় মনে হয়।
একটা উদাহরণ দেই। এবার আমার প্যাভিলিয়নের পাশেই একটা খুব ছোট স্টলে অনেক ভিড় দেখে জিজ্ঞেস করেছিলাম ওখানে কী হচ্ছে? শুনলাম একজন খুব বিখ্যাত মানুষ (সেলিব্রিটি) একটি বই প্রকাশ করেছেন। তার বই কিনতেই মানুষের এত ভিড়। শুনলাম উনি এর আগেও বই প্রকাশ করেছেন।
আমার নিজেরও ইচ্ছে হয়েছিল বইটি কিনতে। কিন্তু যেই কয়বারই চেষ্টা করেছি ভিড় ঠেলে যেতেই পারিনি। সেদিন হঠাৎনেটে ওনার একটা কবিতা পড়লাম। পড়ে মনে হলো এটা আমার পোষাবে না। আমার কাছে ব্যাপারটা এমনই। একজন মানুষ লিখতেই পারে। বই প্রকাশ করতেই পারে। মানুষ হিসেবে এটা তাঁর ন্যায্য অধিকার। কিন্তু আমার সেটা ভালো লাগবে কিনা সেটা আমার পছন্দ অপছন্দের ওপরে নির্ভর করে। আমি একজন মানুষের সদিচ্ছাকে ছোট করে দেখতে পারি না, অভ্যাস নেই। সত্যি বলতে কি, এসবের মধ্যে দিয়েও দুয়েকটা ভালো বই যে বের হচ্ছে না তা কিন্তু নয়। অবশ্যই হচ্ছে। সেটা নিয়েই তো কথা বলতে পারি আমরা। যতবেশি ভালো কিছু নিয়ে কথা বলবো, ততবেশি ভালো জিনিসের কদর বাড়বে, মানুষ জানবে, শিখবে এবং ভালো কাজ করবে। এটাই হওয়া উচিত। যারা লিখবে তারাও শেখার আগ্রহ পাবে। তিরস্কার মানুষকে কখনো ভালো কিছু শিখতে সাহায্য করে না। উল্টো পেছন দিকে ঠেলে দেয়। আমরা খারাপ কিছু নিয়ে এত বেশি কথা বলি যে খারাপটাই তখন বেশি জনপ্রিয়তা পেয়ে যায়, ওটা নিয়েই মানুষ কথা বলে, যদিও উদ্দেশ্যটা নেতিবাচক তারপরেও ওটারই চর্চা চলতে থাকে অনবরত।
লেখালেখি নিয়ে আপনার ভবিষ্যৎ স্বপ্ন?
উত্তর : অনেক কিছুই তো লিখতে ইচ্ছে করে, কাজের ফাঁকে সময় করে উঠতে পারি না। যদি বেঁচে থাকি, মানসিক স্বাস্থ্য নিয়ে আরও কয়েকটা বই লিখবার ইচ্ছে আছে, সেই সাথে ভ্রমণকাহিনি, ছোটগল্প এবং হয়তো আরেকটা কবিতার বই। এইতো… এগুলো করতে পারলেই খুশি থাকবো।
অনুলিখন : তাসলিমা তনু
[ বই-পুস্তক-প্রকাশনা এবং বাংলাদেশের প্রকাশনা জগতের যে কোনো সংবাদ প্রকাশের জন্য আমাদের ই-মেইল করতে পারেন : boideshnews@gmail.com ]
কপিরাইট © ২০১৭ - ২০২০ ।। বইদেশ-এ প্রকাশিত কোনও সংবাদ, কলাম, তথ্য, ছবি, কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না
Design & Development by: TeamWork BD