দেশের বইয়ের একটি নিয়মিত আয়োজন পাঁচটি প্রশ্ন। লেখক-প্রকাশকের কাছে বই প্রকাশনাসংশ্লিষ্ট অভিজ্ঞতা নিয়ে প্রশ্নগুলো করা। আজকের পাঁচটি প্রশ্ন আয়োজনে আমরা মুখোমুখি হয়েছি তরুণ লেখক সুমন কুমার-এর
প্রথম বই প্রকাশের অভিজ্ঞতা জানতে চাই।
উত্তর : আমার প্রথম বই প্রকাশের অভিজ্ঞতা আর নারীদের মা হওয়ার অভিজ্ঞতা প্রায় সমান। প্রথম বইটি প্রকাশের জন্য আমি প্রস্তুতি নিচ্ছিলাম ২০১৬ সাল থেকে। বিষয়টা ফ্যামিলি প্ল্যানিংয়ের মতাে। শেষাবধি ২০১৯ সালে এসে যেন গর্ভে একটি জীবন ধারণের আনন্দ পেলাম। কোনাে প্রকাশকের সঙ্গেই ব্যক্তিগত পরিচয় ছিল না। গবেষক বন্ধু শাহাদৎ রুমন ছিলেন ভাষাচিত্রের প্রকাশক খন্দকার সোহেল ভাইয়ের খুব ঘনিষ্ঠ। এই ব্যক্তিকে আমি আজিজ সুপার মার্কেটে টিমওয়ার্ক নামে একটি অফিসে দেখতাম। কিংবা শাহাদৎ রুমন বা ভাষাচিত্র থেকে প্রকাশিত পরিচিতজনের বই সংগ্রহকালেও দেখতাম বইমেলার হলুদ কালো ভাষাচিত্রের স্টলে। কিন্তু কখনও আলাপ হয়নি। রুমন আমাকে বাংলা বাজারের মান্নান মার্কেটে সোহেল ভাইয়ের সাথে দেখা করাতে নিয়ে গেলেন। তার আগেই অবশ্য বইটি প্রকাশের ব্যাপারে কিছুটা ইঙ্গিত দিয়েছিলেন। অনেকক্ষণ বসে থাকার পর সোহেল ভাই এলেন। আমার একটি ইন্টারভিউ হলো যেন। পাশ নাকি ফেল করেছিলাম সে কথা কখনও জানা হয়নি। তবে ভাষাচিত্র আমার বইটি ২০১৯ সালে অমর একুশে গ্রন্থমেলার প্রথমদিনেই স্টলে এনেছিল, এমন কী বইটা তারও ১০দিন আগে কলকাতা আন্তর্জাতিক বইমেলায় ভাষাচিত্রের স্টলেও উঠেছিল। সে এক তুমুল উত্তেজনা।
আমার বন্ধু আলতাফ শাহনেওয়াজ তাঁর শত ব্যস্ততার মধ্যেও সময় দিত পাণ্ডুলিপি প্রস্তুত এবং সম্পাদনার ব্যাপারে। সময়টুকু পাওয়ার জন্য আমি ময়মনসিংহ থেকে ঢাকায় গিয়ে তাঁর অফিসের নীচে রাত দুইটা পর্যন্তও বসে থাকতাম। কারওয়ান বাজারের সাধারণ ব্যস্ত রাতকে অসাধারণ ব্যস্ততার প্রান্তর হয়ে যেতে দেখতাম তখন। অত রাতে বের হয়েও সে বাসায় গিয়ে আমার কাজটি নিয়ে বসতো সানন্দচিত্তে।
প্রুফ দেখা, প্রচ্ছদ, গ্রাফিক্সের অন্যান্য কাজ, ট্রেসিং, প্রিন্ট, বাঁধাই ইত্যাদি হচ্ছিল আর প্রসব বেদনার এক একটি পর্যায় যেন পেরিয়ে যাচ্ছিলাম। অবশেষে আমার প্রথম বই, গল্পের বই ‘স্বপ্নে পাওয়া হাত’ পৃথিবীর আলো দেখে খন্দকার সোহেল ভাইয়ের মতাে দক্ষ ধাত্রীর সহায়তায়। আর ২০২০ অমর একুশে গ্রন্থমেলায় উপন্যাস ‘নারীজনম’ প্রকাশের সময়কে পিতা হওয়ার আনন্দের সাথে তুলনা করতে পারি। সেখানে বেদনা ছিল না, আশংকা আর আনন্দ ছিল।
লেখালেখির ইচ্ছেটা কেন হলো?
উত্তর : সঠিক জবাবটা আমার জানা নেই। প্রতিটি পর্যায় ধরে বলতে পারি। তাতে পাঠক হয়তাে ইচ্ছেটা আবিষ্কার করতে পারবেন। যখন দ্বিতীয় শ্রেণিতে পড়ি তখন ব্র্যাক শিক্ষা কার্যক্রমের আইইসি ম্যাটেরিয়াল হিসেবে প্রকাশিত ‘আলো’ নামের একটি ম্যাগাজিনে আমার দুটি ছড়া ছাপার অক্ষরে দেখি প্রথম। সেই বাল্য বয়সের আনন্দ বলে বোঝানো দুষ্কর। ওই ছড়া-কবিতা দিয়ে বাঙালির সাহিত্য চর্চা শুরু হয়। অন্যান্য ভাষাভাষি জাতিরও হয়তাে এমনই হয়। যখন উচ্চমাধ্যমিক শ্রেণির ছাত্র তখন ‘অরুণোদয়’ নামের একটি দেয়াল পত্রিকা সম্পাদনা করেছিলাম। আর বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াকালে ‘স্বগতোক্তি’ নামের একটা অনিয়মিত ভাঁজপত্র প্রকাশ করতাম। ওই সময় এমন অসংখ্য বন্ধু-সিনিয়র-জুনিয়রদের পেলাম যারা তখনই কবি-লেখক হিসেবে পরিচিত। বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বেশকিছু লিটলম্যাগ প্রকাশিত হতো, সেখানে লেখা পাঠাতাম, প্রকাশও হতো। সে সব দিতো নিখাদ আনন্দ। ওই বয়সে দুই একটি নাটকও লিখেছিলাম। স্নাতকোত্তর পাশ করার পর মূলত গদ্য লিখতে শুরু করি। তখনই বুঝি কবিতার চেয়ে গদ্যের বোঝাবুঝিটা আমার তুলনামূলক ভালো। তাই সেদিকে মনোযোগ দিই।
নিজের মতামত অন্যের কাছে এমনকি ভবিষ্যত মানুষের নিকট পৌঁছানোর একটা প্রবল ইচ্ছে শুরু থেকেই ছিল। ফলে এইভাবে উপসংহার টানতে পারি যে, আমার ধারণা মানুষের কাছে পৌঁছানোর জন্যই লেখার ইচ্ছেটা হয়েছিল।
লেখক জীবনের মজার কোনো অভিজ্ঞতা জানতে চাই।
উত্তর : লেখক হিসেবে আমি সদ্যপ্রসূত। ফলে মজার ঘটনা নেই বললেই চলে। তবে স্মরণ করতে পারি বই প্রকাশের পূর্বের দুই একটি ঘটনা। বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াকালে একটি ডায়েরিতে আমার কবিতা এবং গানগুলো তুলে রাখতাম। তো একবার সাতক্ষীরা থেকে ফেরার পথে ওটা বাসের মধ্যে হারিয়ে ফেলি। কয়েকমাস পর একজন খবর পাঠায় আমার ডায়েরিটি তাঁর কাছে আছে। আমি ফোন করি ওটা কোনােভাবে আমার নিকট পাঠানোর। তিনি জানান আমাকে না দেখা অব্দি তিনি সেটা দেবেন না। কখনও যাওয়া হয়নি আর ওটা ফেরতও পাওয়া হয়নি। মজার ব্যাপার হলো ওই ডায়েরিতে লেখা কয়েকটি কবিতা যাকে কবিবন্ধুরা বলতো এই চারটি লাইন ভালো, ওই দুইটি লাইন মন্দ-তারা পরে ঘটনাটা জেনে বলেছিল আহা ওই কবিতাটা কত ভালো ছিল। ওই গানের কথাগুলো ছিল অসাধারণ।
কিছু কবিতা লিখে ফেলে দিতাম পছন্দ হতো না বলে। একবার এক ছোটোভাই রুমে এলে তাকে গান গাইতে অনুরোধ করি। সেটা হলে আবাসিক থাকার সময়ের ঘটনা। তো ছোটোভাই একটা কাগজ বের করে কিছুক্ষণ দেখে গাওয়া শুরু করে। কাগজটি কোথা থেকে বের করেছিল দেখিনি। কিন্তু চমৎকার কথার গান যতটা এগোয় ততই মনে হয় এই কথাগুলো আমার খুব পরিচিত। পরে কাগজটি হাতে নিয়ে অবাক হই, নীচে আমারই সাক্ষর আর তারিখ। প্রায় এক বছর আগে সেটা ফেলে দিয়েছিলাম।
তখন আমি সুমন আদিবাসী নামে লিখতাম। ৩য় বা চতুর্থ বর্ষের ছাত্র সে সময়। একদিন এক দুপুরে অপরিচিত নম্বর থেকে ফোন এলো, ‘সুমন আদিবাসী বলছেন? আপনার একটি কবিতা পড়েছি।’ আমি অবাক হলাম, আনন্দিত হলাম, আহা এক নারী আমার কবিতা পড়ে ফোন করেছেন, এ যে পরম আরাধ্য ব্যাপার একজন পুরুষ কবির নিকট। আলাপ হবে কবিতা নিয়ে সেই আশা করছি। তো আমাকে আরও অবাক করে নেই নারী বললেন, ‘কবিতা নিয়ে কিছু বলার নেই, শুধু জানতে চাই আপনার নাম সুমন আদিবাসী কেন?’ ঘটনাটিতে পরে এতই আনন্দ পেয়েছি যে নারীর সংলাপে বলা কথাগুলো হুবহু ওরকমই ছিল সেটার নিশ্চয়তা দিতে পারি।
বাংলাদেশে সৃজনশীল লেখালেখির ভবিষ্যৎ সম্পর্কে আপনার মতামত জানতে চাই।
উত্তর : আমি আশাবাদী মানুষ। কিছু কষ্ট পাই যখন পরিসংখ্যান জানি যে বাংলাদেশ থেকে প্রতিবছর কমবেশি ছয় হাজার বই প্রকাশ হয় যার পাঁচ হাজারই অমর একুশের গ্রন্থমেলায়। আমার ধারণা মোট সংখ্যাটি কুড়ি হাজারের ওপর হলে প্রায় কুড়ি কোটি মানুষের দেশের জন্য সংখ্যাটা উপযুক্ত হতাে। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে মানুষ অগাধ সময় অপব্যয় করছে বলে বিভিন্ন গবেষণা বলছে। কিন্তু যারা পড়তে বা লিখতে ভালোবাসে তারা সঠিক কাজে এখানে সময় ব্যয় করছে বলেই মনে করি।
বাংলাদেশে পাঠক ও বই সংশ্লিষ্ট কয়েকটি গ্রুপের সদস্য সংখ্যা অনেক আগেই লক্ষ পেরিয়ে গেছে। সেখানে মানুষ মতামত বিনিময়ের সুযোগ পায়। ফলে বাড়ছে পাঠক, বাড়ছে লেখক। পাঠক বৃদ্ধি মানেই সৃজনশীল লেখার বৃহৎ বাজার তৈরি হওয়া। ফলে আমার ধারণা সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে যাই ঘটুক না কেন এইসব মাধ্যমের হাত ধরেই সৃজনশীল লেখালেখির ক্ষেত্র এবং বাজার বিকশিত হবে। আমাদের জন্য একটি চমৎকার ভবিষ্যত অপেক্ষা করছে।
লেখালেখি নিয়ে আপনার ভবিষ্যৎ স্বপ্ন?
উত্তর : প্রত্যেক কবি ও লেখকের লেখালেখির একটি উদ্দেশ্য আছে। এর সরল উত্তর অনেকে দিয়ে থাকেন যে, আনন্দ পাই তাই লিখি। কিন্তু আমি একমত নই। তাহলে তো লিখে প্রকাশ না করে ফেলে দিলেও আনন্দ পেতেন তিনি। তা তো করেন না। অর্থাৎ আনন্দটা আসে কেউ পাঠ করার পর। এখন পাঠ করে কেউ ভালো বললে আনন্দ লাগে কোনাে লেখকের, কোনাে কবির বইটি বেশি সংখ্যক বিক্রি হলে তিনি আনন্দ পান আবার কেউ বিক্রির চেয়ে বোদ্ধা পাঠকরা কী বলল তা জেনে আনন্দ বা দুঃখ পেয়ে থাকেন। অর্থাৎ পাঠক তাকে কীভাবে প্রতিক্রিয়া দিচ্ছে তার ওপর নির্ভর করে লেখক-কবি-গবেষকের আনন্দ। ফলে আমি বলতে চাই ওই প্রতিক্রিয়াটির জন্যই মানুষ লেখে।
আমি সুদীর্ঘকাল বাঁচতে চাই। তবে মরণশীল মানুষ সে আর দশজনের চেয়ে দশ বছর বেশি বাঁচতে পারে কিন্তু অনন্তকাল নয়। ভরতমুনি, কালিদাস, প্লেটো, অ্যারিস্টটল প্রমূখসহ কতশত প্রাচীন মানুষকে আমরা এখনও জানি। মহৎ কর্মের মধ্য দিয়েই তারা বেঁছে আছেন। মহৎ কর্মগুলোর মধ্যে অন্যতম একটি হচ্ছে লেখা। নিজের ধারণাগুলো সহজেই এই মাধ্যমে অন্যের কাছে পৌঁছানে সম্ভব। ফলে এখানে কিছুটা দক্ষতা থাকায় আমি লিখে যাচ্ছি। এই আশায় বুক বেঁধে আছি অন্তত একটি গ্রন্থও যদি ভবিষ্যতের মানুষদের হাতে গিয়ে পৌঁছায় তারা যেন আমাদের সময় সম্পর্কে হতাশ না হয়। বর্তমান সময়ে একটি লেখক-সমাজ গড়ে তোলায় কিছুটা ভূমিকা রাখতে চাই যাতে আমাদের সময়টির সারসংক্ষেপ ভবিষ্যতের মানুষের হাতে পৌছানোর সম্ভবনাটা বাড়ে। লেখক যত বেশি হবে সম্ভাবনা ততই বাড়বে।
অনুলিখন : তাসলিমা তনু
[ বই-পুস্তক-প্রকাশনা এবং বাংলাদেশের প্রকাশনা জগতের যে কোনো সংবাদ প্রকাশের জন্য আমাদের ই-মেইল করতে পারেন : boideshnews@gmail.com ]
কপিরাইট © ২০১৭ - ২০২০ ।। বইদেশ-এ প্রকাশিত কোনও সংবাদ, কলাম, তথ্য, ছবি, কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না
Design & Development by: TeamWork BD