বইয়ের প্রতি ভাললাগার শুরুটা কথা বলতে পারার আগে থেকেই। তবে ষষ্ঠ শ্রেণীতে ভর্তি হয়ে প্রথম কোন পাঠাগারে প্রবেশ করেন ছোট্ট শিক্ষার্থী শ্যামলী বিনতে আমজাদ। লাইব্রেরিতে অনেকগুলো বই দেখে খুব অবাক হয়েছিলেন সেদিন। শর্তগুলো জেনে নিয়ে ঝটপট সদস্য হয়ে যাওয়া। আর কার্ডের মাধ্যমে রূপকথার বই নিয়েই শুরু হলো বইপড়া। প্রথম দিনের বইটি শেষ করতে একদিনের বেশি সময় লাগেনি বইপোকা শ্যামলীর। দ্বিতীয় দিন যখন বইটি পরিবর্তন করতে গিয়ে শুনলেন, ৭ দিনের আগে বই পরিবর্তন করা যাবে না। অনুনয়-বিনয় করে বললেন, বইটি পড়া শেষ করেছি, বাকি ৬ দিন বইটি আমার কাছে রেখে লাভ কী? কোন লাভ হলো না। মুখ ভার করেই সেদিন বই নিয়ে ফিরতে হলো। তখন থেকেই ভাবনাটা শ্যামলীর ছোট্ট মস্তিষ্কের মধ্যে বাসা বুনতে লাগল, নিজের একটা পাঠাগার থাকবে। যেখানে সবগুলো ইচ্ছেমতো পড়বে। ৭ দিনের আগে বই পালটানো যাবে না এমন কোন নিয়ম থাকবে না। শ্যামলীর মতো অন্যরাও যখন ইচ্ছে হবে বই পরিবর্তন করে পড়তে পারবে।
বইপড়া কি থামে?
তবে পাঠাগারের নিয়মের কারণে থেমে যায়নি বইপড়া। স্কুলের বন্ধুদের নিয়ে পাঠাগার থেকে বই নিতে নতুন পরিকল্পনা করলেন। পাশাপাশি বন্ধুদেরকেও সদস্য করলেন স্কুলের পাঠাগারে। এরপর থেকে একসঙ্গে বই তুলে এবং নিজেদের মধ্যে বই বিনিময় করে চলতো বইপড়া। এতে করে সপ্তাহে ৩-৪টি বই পড়া হতো। পাঠাগারের নিয়ম রক্ষা হতো আবার নিজেদের ইচ্ছামতো বই বদলে পড়াও যেত।
স্বপ্ন ডানা মেলে
২০১২ সাল। শ্যামলী তখন অনার্সের শিক্ষার্থী। হাঙ্গারপ্রজেক্টের উদ্যোগে ৩ দিনব্যাপী একটি লিডারশিপ প্রশিক্ষণে অংশগ্রহণের সুযোগ মিলে। সেখান থেকেই সামাজিক দায়বদ্ধতার শিক্ষাটা অনুধাবন করতে পারা।’ সমাজ থেকে শুধু নিলেই হবে না, দিতে হবে সমাজকেও।’ কথাটা আজীবনের জন্য মনে গেঁথে রইল তার।
প্রশিক্ষণের শেষদিন বলা হলো, আগামী ১ বছরে সমাজের জন্য কে কী করবে তা একটি সাদা পাতায় লিখতে।
মনের অজান্তেই সেদিন লিখেছিলাম, গ্রামে আমি একটি পাঠাগার করতে চাই। গ্রামে ফিরে প্রাইমারি, হাইস্কুলের বন্ধুদের নিয়ে আলোচনা মোতাবেক পাঠাগারের জন্য একটি খাতা এবং ৩৫টি বই সংগ্রহ করে পাঠিয়ে দিয়েছিলাম সে সময়ে। দৈনিক খবরের কাগজ সরবরাহের বন্দোবস্ত করেও পাঠাগার স্থাপনের জায়গা আর নির্মাণের খরচ যোগাড় করার অপূর্ণতায় সে যাত্রায় সম্ভব হয়নি।
কেউ পাশে নেই যখন
প্রথমবার পাঠাগার শুরুর কাজ যে সকল বন্ধুদের নিয়ে করেছেন তাদের কেউই গ্রামে পুরোদমে থাকে না। পড়াশোনা, কাজকর্ম নানা কারণে সবাই শহরমুখী। ব্যস্ততায় ছোট্ট পাঠাগার গড়ার চিন্তাটা কারোরই মনে থাকার কথা নয়। কিন্তু মনের ভেতর লালন করা স্বাপ্নিক শ্যামলী কি ভুলে যেতে পারে? দীর্ঘদিন থেকে টিফিনের টাকা, টিউশনির টাকা দিয়ে যে বইগুলো কিনেছিলেন তার সংখ্যা খুব কম নয়। প্রায় ৩৫০টির মতো বই গ্রামে নিয়ে এসে বুকসেলফে সাজিয়ে তার মনে হলো, বই সাজিয়ে রেখে লাভ কী? বই কী শোপিচ?
আবার শুরুর চিন্তা করলেন। এবার এগিয়ে এলেন বাবা। বুড়ো বয়সেও বাবার বই পড়ার প্রতি আগ্রহ দেখে মেয়ে রীতিমতো অবাক হন। বাবার বই পড়ার আগ্রহ থেকেই শ্যামলীর বইপোকা হওয়া। বাবার সাহায্যেই শুরু করলেন গ্রামের নিজ বাড়িতে পাঠাগারের যাত্রা।
এবার পেল পূর্ণতা
অবশেষে দীর্ঘদিনের লালিত স্বপ্নের পূর্ণতা পেল ২০১৯ এ।
‘বইয়ের সঙ্গে, সন্ধ্যা প্রাতে’ স্লোগানকে সামনে রেখে রংপুর জেলার গংগাচড়া উপজেলার জয়দেব মধ্যপাড়া গ্রামের নিজ বাড়িতে শুরু হলো ‘আলহাজ আমাজাদ হোসেন জ্ঞানদ্বীপ পাঠাগার’এর পথচলা।
পাঠাগারের দায়িত্ব তুলে দেন মায়ের হাতে। নতুন সদস্যের রেজিস্ট্রেশন (বিনামূল্যে) সদস্যদের বই পরিবর্তন সবগুলো কাজই মা বাড়ির কাজ করার পাশাপাশি করবেন।
আগামীর দিনগুলোতে
ভাবতেই অবাক লাগতো আমাদের এত বড় গ্রামে একটিও পাঠাগার নেই। পাঠ্য বইয়ের বাইরে অন্যান্য বইয়ের সঙ্গে গ্রামের বাচ্চাদের খুব কম পরিচয়। গ্রামে-গঞ্জে দিন-দিন নানা সুযোগ সুবিধা তৈরি হলেও নেই ভাল কোন পাঠাগার কিংবা লাইব্রেরির। সেই শূন্যতা একটু হলেও কমেছে। এখন সদস্য বাড়ানোর পাশাপাশি পাঠাগারের পরিসর বাড়ানোর ইচ্ছে আছে। দৈনিক সংবাদপত্র, সাপ্তাহিক, পাক্ষিক, মাসিক ম্যাগাজিনগুলো থেকে ছেলেমেয়েরা যেন বঞ্চিত না হয়, তাই সেগুলো রাখার চিন্তা রয়েছে। পাঠাগারে থাকছে প্রথম থেকে দ্বাদশ শ্রেণী পর্যন্ত একাডেমিক বোর্ড বই এবং গাইড বই। আশার কথা হলো, ইতোমধ্যে পরিচিত অনেকেই পাঠাগারের সহায়তায় এগিয়ে আসছেন।
বাবার জন্য উপহার
বাবা আলহাজ আমাজাদ হোসেন একজন আলো ছড়ানোর কারিগর। সরকারী একটি ফাজিল মাদ্রাসার প্রিন্সিপালের দায়িত্ব পালন করেছেন কয়েক দশক। নিজের জন্য নয়, দেশ, মা মাটি মানুষের জন্য কিছু করার চেষ্টা সবসময় দেখেছেন বাবার মাঝে। নিঃস্বার্থভাবে কাজ করে যাওয়ার অনুপ্রেরণা বাবার থেকেই লাভ করেন শ্যামলী। তাই পাঠাগার করে বাবাকে তাঁর জীবনের শ্রেষ্ঠ উপহারটি দেয়ার চিন্তা। অবশেষে পাঠাগার স্থাপনের স্বপ্ন বাস্তবায়িত হলো। সে কারণেই বাবার নামেই পাঠাগারের নামকরণ। সর্বোপরি বাবার সহায়তায় তাঁর হাতে তুলে দেয়া শ্রেষ্ঠ উপহারটি। ব্যক্তিগত উদ্যোগে এতটুকু করার চেষ্টা।
গ্রামের অবহেলিত, হতদরিদ্র কৃষক পরিবারের সন্তানগুলো ছাড়াও অন্য সবাই যেখানে রোজ বই পড়ে আলোকিত মানুষ হবে। আলো ছড়াবে দেশের সীমানা পেরিয়ে গোটা বিশ্বে, সেই স্বপ্ন দেখি।
কপিরাইট © ২০১৭ - ২০২০ ।। বইদেশ-এ প্রকাশিত কোনও সংবাদ, কলাম, তথ্য, ছবি, কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না
Design & Development by: TeamWork BD