ওসমান গনি
অমর একুশে বইমেলা আমাদের গৌরবের অধ্যায় হয়ে উঠেছে। একদিন যে মেলা ছিল অনানুষ্ঠানিক সংক্ষিপ্ত উৎসব, আজ তা রূপান্তরিত হয়েছে জাতীয় উৎসবে। এই মেলাকে কেন্দ্র করে সামাজিক, সাংস্কৃতিক, অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড বেগবান হচ্ছে। বইমেলা কীভাবে একটি জাতির চেতনার বাতিঘর হয়ে উঠতে পারে, জাতির মহামিলন কেন্দ্রে পরিণত হতে পারে- বাংলাদেশের অমর একুশে বইমেলা বিশ্ববাসীকে তা দেখিয়ে দিয়েছে।
অমর একুশে বইমেলার সঙ্গে শুরু থেকে সংশ্লিষ্ট রয়েছি। এই সময়ে অনেক কিছু দেখেছি, অনেক কিছু করেছি। আজ একবিংশ শতাব্দীতে এসে উপলব্ধি করছি নতুন নতুন সম্ভাবনা। আমাদের আজকের প্রজন্মকে একুশ শতকের চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করতে হলে বইকে চিরদিনই গুরুত্ব দিতে হবে। আমরা যত কিছুই বলি না কেন, মুদ্রিত বইয়ের আবেদন কখনোই ফুরোবে না। একজন প্রকাশক হিসেবে এটা আমি দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করি। বই কীভাবে মানুষের কাছে দ্রুত ও নির্বিঘ্নে পৌঁছানো যায়, সেই বিষয়ে আমাদের ভাবতে হবে। পাঠক বই পড়তে চান। পাঠকের ইচ্ছেটাকে যদি আমরা সম্মান করতে পারি, তাদেরকে একটি উপযুক্ত পরিবেশ দিতে পারি, তাহলে প্রকাশনাশিল্পে যুগান্তকারী পরিবর্তন আনা সম্ভব। এক্ষেত্রে বইমেলা হতে পারে আমাদের সক্ষমতা প্রকাশের উৎকৃষ্ট জায়গা। এসব কথা মাথায় রেখেই করোনাকালীন অমর একুশে বইমেলা ২০২১ নিয়ে আমি কিছু প্রত্যাশার কথা বলব।
অমর একুশে বইমেলা আমার দৃষ্টিতে সব মেলার চেয়ে ভিন্ন হওয়া দরকার। এই মেলার পরিকল্পনা, শৃঙ্খলা, নান্দনিকতা, নিরাপত্তা ও দর্শনার্থীদের প্রবেশ-প্রস্থান ব্যবস্থা সুখকর হওয়া সময়ের দাবি বলে মনে করি।
এই মেলার মূল প্রেরণা পাঠক-লেখক-প্রকাশক। এই তিন শ্রেণির মানুষের সর্বোচ্চ সুবিধার কথা মাথায় রেখেই এ মেলার নববিন্যাস প্রয়োজন। এ জন্য আমাদের খুব বেশি বাড়তি অর্থের প্রয়োজন হবে না; শুধু আয়োজকদের একটু দৃষ্টিভঙ্গি বদলাতে হবে। নতুন দিনে নতুন ভাবনা নিয়েই এগোতে হয়। আমাদেরও নতুন করে ভাবতে হবে। যুক্ত করতে হবে নতুন নতুন মেধা ও প্রযুক্তি।
অমর একুশে বইমেলা বাংলাদেশের পাঠক, লেখক ও প্রকাশকদের স্বার্থের কথা চিন্তা করেই শুরু হয়েছিল। বাংলাদেশের প্রকাশনাশিল্প অসম্ভব সম্ভাবনাময় একটি খাত। এই খাতে যারা অর্থলগ্নি করেন, তারা শুধু ব্যবসায়িক মনোবৃত্তি থেকেই লগ্নি করেন- এমনটি ভাবা ঠিক হবে না। তারা শিল্প-সাহিত্যকে ভালোবাসেন। এ কারণেই তারা শত বিপর্যয়ের মধ্যেও টিকে আছেন।
একজন প্রকাশক হিসেবে আমি সবসময় দাবি করে এসেছি- অমর একুশে বইমেলার যে নীতিমালা রয়েছে, তা যথাযথভাবে অনুসরণ করা হোক। প্রথমেই বিদেশি, পাইরেটেড এবং নেট বই বিক্রি বন্ধ করতে হবে। কারও মুখ চেয়ে যেন মেলার শৃঙ্খলা নষ্ট করা না হয়।
এ বছর অমর একুশে গ্রন্থমেলা কয়েকটি কারণে গুরুত্বপূর্ণ। প্রথম দুটি গুরুত্বপূর্ণ কারণের একটি হলো, জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জন্মশতবর্ষ, আরেকটি বাংলাদেশের স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তী। মেলা প্রাঙ্গণে প্রবেশ করার মুহূর্ত থেকেই যেন বঙ্গবন্ধু ও মহান মুক্তিযুদ্ধ সম্পর্কে মানুষের মন আবেগতাড়িত হয়, সেই বিষয়ে নজর দিতে হবে।
করোনা পরিস্থিতির কারণে শুধু আগামী বইমেলার মূল আয়োজন বাংলা একাডেমির ভেতরে হলেই ভালো হয়। তাহলে পেশাদার প্রকাশকরা উপকৃত হবেন। এমনিতেই করোনাভাইরাসের প্রভাবে প্রকাশনাশিল্প ব্যাপক ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। পেশাদার প্রকাশকদের বাইরে যেন কোনো অপেশাদার প্রকাশক মেলায় স্টল বরাদ্দ না পান, সে বিষয়ে দৃষ্টি দিতে হবে। আগামী বইমেলায় মেলা কর্তৃপক্ষ স্টলের জন্য নামমাত্র ভাড়া রাখতে পারেন। কারণ, সব শ্রেণির ব্যবসায়ী প্রণোদনা পেলেও প্রকাশকরা কোনো প্রণোদনা পাননি। স্টলের আকারের ক্ষেত্রেও নতুন বিবেচনা করা যেতে পারে। প্যাভিলিয়ন পদ্ধতি গ্রহণ না করে একাডেমির অর্থায়নে সবার জন্য একই ডিজাইনের স্টলও তৈরি হতে পারে। এ বিষয়ে আমি জোর দাবি জানাতে চাই।
এ বছর অমর একুশে গ্রন্থমেলায় লেখক প্রমোশনের জন্য ছোট অডিটোরিয়াম বরাদ্দ দেয়ার ব্যবস্থা রাখা দরকার। একজন প্রকাশক যেন চাইলেই তার প্রকাশিত গ্রন্থ ও নতুন লেখককে পাঠকের সামনে পরিচিত করাতে পারেন, সেই বিষয়টি মাথায় রাখতে হবে। পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে এ ব্যবস্থা রয়েছে।
গত বছর সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে বৃহৎ পরিসরে যে বইমেলা হয়েছে, সে জন্য বাংলা একাডেমি প্রস্তুত ছিল বলে আমি মনে করি না। অত বড় মাঠে প্রবেশের জন্য দুইটি মাত্র গেট কখনোই যথেষ্ট হতে পারে না। এ বছর যদি সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে মেলা করতেই হয়, তাহলে প্রকাশকদের সর্বোচ্চ চার ইউনিটের স্টল বরাদ্দ করে এমনভাবে বিন্যাস করতে হবে, যাতে সব স্টল চারদিকে খোলা থাকে। এতে সব প্রকাশক প্যাভিলিয়নের সুবিধা যেমন পাবেন, তেমনি স্বাস্থ্যবিধি পালনেও সহায়ক হবে।
এ ছাড়া স্বাস্থ্যবিধি মেনে শাহবাগ, টিএসসি, দোয়েল চত্বর ও ইঞ্জিনিয়ার্স ইনস্টিটিউট দিয়ে যেন নির্বিঘ্নে মেলায় প্রবেশ করা যায়, সেটা নিশ্চিত করতে হবে। পার্কিংয়ের বিষয়টি নিয়ে আমরা শুরু থেকেই কথা বলে আসছি; কিন্তু এখন পর্যন্ত পার্কিং ইস্যু মীমাংসিত হয়নি। ইচ্ছে করলেই মেলার মাঠে পার্কিং জোন করা সম্ভব- কেন সেটা আয়োজকদের দৃষ্টিগোচর হয় না, জানি না। এ বছর বইমেলায় অবশ্যই একটি বৃহৎ ও দৃষ্টিনন্দন পার্কিং জোন চাই।
খাবারের স্টলগুলো গত বইমেলায় যেভাবে বরাদ্দ ছিল, মনে হয়েছে এটা বইমেলা নয়, খাবারের মেলা। খাবারের স্টল থাকবে বটে; তবে এমনভাবে রাখতে হবে, যেন সবদিকেই সেগুলো নির্দিষ্ট পরিসরে থাকে।
নতুন বইয়ের মোড়ক উন্মোচনের জন্য যে জায়গা বরাদ্দ থাকে, সেটি আরও আধুনিকায়ন করা দরকার। ওখানে যেভাবে ধাক্কাধাক্কি শুরু হয়, তা ভদ্রশ্রেণির জন্য খুবই বিরক্তিকর। মোড়ক উন্মোচন মঞ্চ আরও আকর্ষণীয় হওয়া দরকার। এ ব্যাপারে স্থাপত্যকলাবিদদেরও পরামর্শ গ্রহণ করা যেতে পারে।
মেলার শৃঙ্খলা ও নিরাপত্তাব্যবস্থা আরো জোরদার করতে হবে। আমরা বইমেলা লেখকের রক্তে রঞ্জিত হতে দেখেছি। এটা যে ভবিষ্যতে ঘটবে না, তার কোনো নিশ্চয়তা নেই। এ জন্য নিরাপত্তার বিষয়টি অবশ্যই গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচনা করতে হবে। তবে অতিরিক্ত নিরাপত্তার অজুহাতে মানুষ যেন হয়রানির শিকার না হন, সেটাও ভাবতে হবে। মেলার চারপাশ হকারমুক্ত থাকাও বাঞ্ছনীয়।
অনেকের মনেই শঙ্কা ছিল ২০২১-এর গ্রন্থমেলা নিয়ে। অবশেষে স্বাস্থ্যবিধি মেনে এই মেলা হতে যাচ্ছে জেনে আমরা সবাই খুশি হয়েছি। আশা করি, করোনা মহামারি কেটে গিয়ে খুব শিগগির আবার সুদিন আসবে। আমরা এবার একটি সুন্দর মেলা উপভোগ করতে চাই। অমর একুশে গ্রন্থমেলা ২০২১ হবে আগামী অন্য সব মেলার উদাহরণ- এমনটাই প্রত্যাশা করি আমি। অতীতে যা হওয়ার হয়েছে। আমাদের আগামীগুলো সুন্দর হোক, আনন্দময় হোক।
লেখক : প্রকাশক, আগামী প্রকাশনী ও সাবেক সভাপতি, বাংলাদেশ জ্ঞান ও সৃজনশীল প্রকাশক সমিতি
কপিরাইট © ২০১৭ - ২০২০ ।। বইদেশ-এ প্রকাশিত কোনও সংবাদ, কলাম, তথ্য, ছবি, কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না
Design & Development by: TeamWork BD