বইদেশ-এর একটি নিয়মিত আয়োজন পাঁচটি প্রশ্ন। লেখক-প্রকাশকের কাছে বই প্রকাশনাসংশ্লিষ্ট অভিজ্ঞতা নিয়ে প্রশ্নগুলো করা। আজকের পাঁচটি প্রশ্ন আয়োজনে আমরা মুখোমুখি হয়েছি তরুণ কবি – একরাম আজাদ-এর
প্রথম বই প্রকাশের অভিজ্ঞতা জানতে চাই।
দুই হাজার সতেরোর মাঝামাঝি। তখন আমি বিশ্ববিদ্যালয়ের তৃতীয় বর্ষের ড্রপ-খাওয়া শিক্ষার্থী। বছর দুয়েক হলো মোটে কবিতা লিখতে শুরু করেছি। কবিতা হোক বা না হোক তখন জেঁকে বসেছে আপাদমস্তক। হেনতেন পঞ্চাশেক কবিতা দাঁড় করিয়ে নিয়েছি; এবার বই করার তাড়া। নতুন প্রেম হলে কিশোর প্রেমিকের যা হয় আরকি! কিন্তু বিচ্ছিন্নবাদী হওয়ার কারণে তেমন কারোর সাথে যোগাযোগ নাই যে আমাকে সোনার হরিণের খবর বাতলাবে।
তারপর একদিন কোনো এক যৌথ গ্রন্থের সম্পাদকের খোঁজ পাওয়া গেল; তার লেজ ধরে একটা ভূঁইফোড় প্রকাশনীরও। তারপর ধর তক্তা মার পেরেক স্টাইলে পৌঁছে গেলাম প্রকাশকের আড়তে। টোন শুনেই বুঝে ফেললাম পকেট না কেটে এই লোক আমাকে ঘাট পার করাবে না। তবে তাই হোক।
দীর্ঘ মাস তিনেক দিনরাত প্রকাশকের আখড়ায় পড়ে থেকে টিউশনের না খেয়ে না পড়ে জমানো ৯০০০ টাকা ক্যাশ দিয়ে পেলাম থার্ডক্লাস মানের ১২০ কপি বই। সেই অদ্ভুত মুহূর্তের দিন এখনো চোখের সামনে ঘোরাফেরা করে। তার কারণ যেমন আঁধা-আঁতুড় যা হোক নিজের প্রথম সৃষ্টি, একই দিনে ১০০ কপি বই কুরিয়ারে বেচে দেওয়ার আনন্দও। এই প্রথম, আর এই শেষ এক দিনে এতগুলো বই বিক্রি হলো আমার।
লেখালেখির ইচ্ছেটা কেনো হলো?
অনেকেই মনে করে থাকেন যে বাংলা সাহিত্য নিয়ে পড়লেই বুঝি লোকজন কবিতা বা ঘোড়ার ডিম আর যা আছে লেখেটেখে। এটা পুরো ফাউ একটা গপ্পো। আসল কথা হচ্ছে আমার বন্ধুদের মধ্যে ২জনও দেখিনি যারা সাহিত্য করছে। আজকাল এমবিএ হোক আর সাহিত্য হোক বা দর্শন প্রত্যেকের এইম অই মাসকাবারি কামলা হওয়াই। যাকগে সেসব কালবিরোধী কথাবার্তা, মূল কথায় ফিরি। যখন ক্লাস নাইন, ঠেলেঠুলে ক্লাস টেনে উঠি। আমাদের বাংলা শিক্ষক হলেন পথিক দে (যিনি সিক্সে ইংরেজি ক্লাসে মোষের বেত দিয়ে পিটিয়ে পোঁদের ছাল তুলে নিতেন)।
তিনি ছিলেন নামকরা কবিয়াল, সাহিত্যে পড়াশোনা বেশ ভালোই। প্রথম ক্লাসেই বঙ্কিমচন্দ্র পড়াতে গিয়ে এক নিশ্বাসে আবৃত্তি করলেন দুর্গেশনন্দিনীর প্রথম অনুচ্ছেদ। সেটা এত সুন্দর আর মোহনীয় ছিল যে তখনই আমার সে বই পড়ে দেখার ইচ্ছে হলো। কিন্তু বলদ কিসিমের ছাত্র ছিলাম দেখে স্কুল লাইব্রেরি থেকে না করে দিল। মফসসলে বসবাস, ওসব আর কই-বা পাব। তো কেমন জানি সেই থেকে জেদ চেপে গেলে আউট বই পড়ার। ইতোমধ্যে কাজিনকে প্রেমিকের দেওয়া কাসেম বিন আবুবকরের চুদুরবুদুর কয়েকটা গিলে নিলাম, কিন্তু সেই দুর্গেশনন্দিনী পাওয়া গেল না। অবশেষে ইন্টার মিডিয়েট পড়তে শহরে এলাম। একে একে পড়ে নিলাম বঙ্কিম, শরৎ, রবীন্দ্রনাথ, মানিক…।
বিশ্ববিদ্যালয়ে গিয়ে দ্বিতীয় বর্ষে পেলাম কবি ময়ূখ চৌধুরীকে। তখন পর্যন্ত প্রিয় সাইডে গদ্যসাহিত্য, কবিতা টানে না। বলতে গেলে কবিতার প্রতি আমার প্রেমটা তৈরি করেছেন ময়ূখ বাবু—সোনালী কাবিনের সেই অসম্ভব সুন্দর আবৃত্তি। সেই প্রথম বুঝলাম সাহিত্য যদি হয় প্রেমিকা, তো কবিতা হলো প্রেম। তার কাছে শেখা অন্ত্যমিলহীন কবিতার পাঠ, পদ্য আর কবিতার ফারাক। আর তারপর প্রেমিক হয়ে উঠার; মানে কবি হওয়ার ব্যর্থ চেষ্টা করা।
লেখক জীবনের মজার কোনো অভিজ্ঞতা জানতে চাই।
লেখক হিসেবে এখনো বলতে গেলে কোনো সাফল্যই তো পাইনি; পাওয়ার মধ্যে অই গাঁটের পয়সা খরচ করে অন্তত বইটা করতে হয় না আজকাল, এটুকুই। ফলে মজার অভিজ্ঞতাও তেমন নাই-ই। তবে একটা সামান্য সুখস্মৃতি আছে, সেটাই বলি।
আমার বাবা যতটা আমার বাংলা নিয়ে পড়াতে অসন্তুষ্ট, তারচেয়ে বেশি ত্রস্ত আমার কবিতা লেখা নিয়ে। তিনি আমাকে নিয়ে একপ্রকার লজ্জাবোধই করতেন। তো একদিন কবি খালেদ মাহবুব মোর্শেদের সাথে যাত্রাপথে তার সাক্ষাৎ হয়। তিনি তার প্রাক্তন বসতি এলাকার স্কুল শিক্ষকের ছাত্র, এদিকে আমাদের উপজেলার প্রাক্তন এমপি সাহেবের পিএস। ফলে বাবার কাছে তিনি খুব গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি। কথায় কথায় নাকি তিনি তার পরিচয় দিচ্ছিলেন, কিন্তু খালেদ সাহেব তাকে চিনতে পারছেন না।
শেষমেশ কবি নাকি তাকে চিনলেন কবি একরাম আজাদের বাবা বলাতে। সেদিন বাবা বাড়িতে আসার পর আমার প্রতি কেমন একটা মুগ্ধতা নিয়ে তাকিয়েছিলেন, এ জন্য যে আমার পরিচয়ে লোকজন তাকে চিনে। আপাতত বাবার অস্বীকারের চোখের সেই মুগ্ধতাটুকুই আমার সুন্দর স্মৃতি।
বাংলাদেশে সৃজনশীল লেখালেখির ভবিষ্যৎ সম্পর্কে আপনার মতামত জানতে চাই।
এই প্রশ্নটা আমার জন্য কিছুটা অস্বস্তিকর; কেননা এটি বোদ্ধাদের দার্শনিক আলাপের বস্তু। আমি নস্যি-গোত্রীয় লোক, ফলে দায়সারা গোছের কিছু বলে পার পেলেই বাঁচি।
আমি মনে করি আমি যে সময়টাতে লিখতে আসছি সেটা সাহিত্যের পোস্ট মর্ডানিজমের কাল, ফলে এখকার সাহিত্যও নতুন ঘরানার। আমি আপাতত কবিতার মানুষ, কবিতার কথাই বলি। আমরা চেষ্টা করেও যেখানে চিরাচরিত নিয়মে ফেইল মেরে যাচ্ছি সেখানে যারা সদম্ভে ঝাণ্ডা উড়াচ্ছেন তাদের মধ্যে ইমতিয়াজ মাহমুদ, মার্জুক রাসেল, ব্রাত্য রাইসু, হাসনাত সোয়েব (আমার পাঠের মধ্যে) প্রমুখ বেশ ভালো করছেন। তাদের বিষয়বস্তু, ভাষা, টোন আলাদা/নতুন মনে হয় আমার কাছে। এরপর আমরা যারা হয়ে উঠার চেষ্টা করছি কিন্তু পারছি না এদের মধ্যে বেশকিছু সম্ভাবনাময় মুখ চোখে ভাসছে; সঙ্গত কারণে নামগুলো এড়িয়ে যাচ্ছি। সব কথার শেষ কথা হচ্ছে ইদানীং চেষ্টাটা খুব ভালোই হচ্ছে; সেটা পুরানোকে ভাঙার বলুন বা নতুন কিছু করার। এটা সুন্দর।
লেখালেখি নিয়ে আপনার ভবিষ্যৎ স্বপ্ন?
আমি আপাতত আমাকে নিয়ে হতাশ। আমার লেখা নিয়ে আমি সন্তুষ্ট নই, ফলে স্বপ্নও নাই। আর পাঁচজনের মতো লিখে আমিও একটা বই করব এমন বেহায়াপনা করতে আর রাজি নই; ফলে যখনই মনে হবে আমি নতুন কিছু লিখতে পারছি তখনই আবার নামব। সুতরাং আমার আপাতত স্বপ্ন নতুন কিছু লিখতে পারা।
তবে গদ্যে যাওয়ার ইচ্ছা আছে। গল্প লিখছি কিছু। চেষ্টা করছি আলাদা কিছু করার, গল্পে সে সুযোগটা আছে বলে মনে হয়। কিন্তু তাতেও যদি দেখি যে নতুন কিছু লিখতে পারছি তবে তা থেকেও সরে আসব। প্রুফরিডিংকে আমি সাহিত্যের অংশই মনে করি, কারণ এখানে প্রচুর পড়ার একটা সুযোগ আছে, বিশেষত আমার সময়ে যারা লিখছে তাদের। এই পড়া নিয়েই আপাতত সাহিত্যপাড়ায় থাকতে চাইছি।
[ বই-পুস্তক-প্রকাশনা এবং বাংলাদেশের প্রকাশনা জগতের যে কোনো সংবাদ প্রকাশের জন্য আমাদের ই-মেইল করতে পারেন : boideshnews@gmail.com ]
কপিরাইট © ২০১৭ - ২০২০ ।। বইদেশ-এ প্রকাশিত কোনও সংবাদ, কলাম, তথ্য, ছবি, কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না
Design & Development by: TeamWork BD