পাঁচটি প্রশ্ন

প্রকাশকদের অপেশাদার আচরণ বিস্মিত করে

শনিবার, ১১ সেপ্টেম্বর ২০২১ | ১০:০১ অপরাহ্ণ | 619 বার

প্রকাশকদের অপেশাদার আচরণ বিস্মিত করে

বইদেশ-এর একটি নিয়মিত আয়োজন পাঁচটি প্রশ্ন। লেখক-প্রকাশকের কাছে বই প্রকাশনাসংশ্লিষ্ট অভিজ্ঞতা নিয়ে প্রশ্নগুলো করা। আজকের পাঁচটি প্রশ্ন আয়োজনে আমরা মুখোমুখি হয়েছি লেখক রেজাউল করিম-এর


 

প্রথম বই প্রকাশের অভিজ্ঞতা জানতে চাই।
প্রথম বই তো ছিল দাপ্তরিক। প্রেস থেকে বই অফিসে এলে ম্যানেজার নেড়েচেড়ে দেখতেন। ওনার দেখা শেষ না হওয়া পর্যন্ত খুব চিন্তায় থাকতাম। আমার লেখা প্রথম সৃজনশীল বই ‘হিমালয়ের দেশে।’ নেপালে সাতবার ভ্রমণ করেছি। সেসব অভিজ্ঞতার ওপরে ভিত্তি করে গল্পাকারে ভ্রমণবিত্তান্ত বলা চলে বইটিকে। অভিজ্ঞতা খুব সুখকর ছিল না।

২০১৪ সালের বইমেলায় বই আসবে। প্রকাশক জানালেন ৩ ফেব্রুয়ারি বইটি মেলায় আসবে। ঐদিন মেলায় যথারীতি হাজির হলাম। সাথে দু’তিনজন শুভাকাঙ্ক্ষীও ছিলেন। বই এলো না। খুব যাতনাময় অভিজ্ঞতা। এভাবে প্রতিদিন মেলায় হাজির, বই আসছে না। অবশেষে বই এলো ৭ তারিখ, তাও সন্ধ্যার বেশ পরে। বই হাতে নিয়ে দেখলাম বাঁধাইয়ের জায়গা তখনও বেশ ভেজা। সবচেয়ে শুকনো বইটি নিয়ে অনেকটা চুপিচুপিই মেলা ত্যাগ করলাম। যাঁরা আমার পরিচিত এবং বই নিতে চেয়েছিলেন, বাসায় এসে তাদেরকে পরদিন মেলায় আসতে বললাম।

আমার লেখা দাপ্তরিক বই বেশ কিছু প্রকাশিত হয়েছে। সেগুলো বাসায় এনে পরিবারের সদস্যদের দেখানোর তাগিদ ছিল না। হিমালয়ের দেশে প্রথমেই স্ত্রীর হাতে তুলে দিয়েছিলাম। সন্তানেরাও দৌড়ে এসেছিল বইটি দেখতে। সেটি আনন্দময় অনুভূতিই ছিল। এছাড়া আমার প্রতিটি বই প্রকাশের পর আমার বাবা-মায়ের আনন্দ আমাকে আপ্লুত করেছে।

 

লেখালেখির ইচ্ছেটা কেন হলো?
অনেক কথা বলতে হয়। আমার আব্বা-আম্মা দুজনেই বই পড়তেন। বই মানেই তখন মূলত ভারতীয় বই। দেশীয় বইয়ের মধ্যে মাসুদ রানা (হাত দেয়া নিষেধ ছিল). কুয়াশা, দস্যু মোহন সিরিজের বই। দস্যু বনহুরও ছিল। তবে ওনার দুই বিবি ছিল। প্রেম-ভালোবাসা টানাটানিও ছিল প্রবল। বনহুরের বইয়ে কিশোর বয়সে আগ্রহ পাইনি। বই পড়া শুরু হয়েছিল আলিফ-লায়লা, সিন্দাবাদ, গোপাল ভাঁড় এগুলো দিয়ে। আমার নানা লেখালেখি করতেন। কবিতা, ছোটোগল্প, উপন্যাস। ওনার কবিতায় অন্তমিল ছিল অসাধারণ। ষাটের দশকে ওনার উপন্যাসও প্রকাশিত হয়েছিল। তবে সেই যুগে ভারতীয় বইয়ের আধিপত্যে ঢাকার লেখকগণ সুবিধা করে উঠতে পারতেন না, মফস্বলের লেখক তো দিল্লী দূর হনুস্ত এর মতো অবস্থা। এইট-নাইনে পড়ার সময়ে কবিতা লেখার আগ্রহ জন্মাল। নানা ছিলেন প্রেরণা। আর একটা কারণ বোধ হয় ছিল। আমার অপরাপর ভাইয়েরা ছিলেন স্বাস্থ্যবান। তারা মাঠে খেলতে আগ্রহী ছিলেন। আমি বাল্যবয়স থেকেই ইল-হেলথ।

বই পড়া আর লেখালেখিতে স্বাস্থ্য প্রয়োজন পড়ে না। যাই হোক, কবিতা লিখে নানাকে দেখাতাম। নানার মনোপুত হতো না। কলেজে উঠেও লেখালেখি চালিয়ে গেলাম। ছোটোগল্পও লিখতে থাকলাম। সে সময়ে কুষ্টিয়াতে দুটো দৈনিক কাগজ বের হতো। একটিতে সাপ্তাহিক সাহিত্য পাতা থাকত। স্বভাবতই গোটা শহরের বয়স্ক লেখকদের লেখাই সেখানে থাকত। আমার লেখা কে ছাপবে? কলেজ ম্যাগাজিনে লেখা দিলাম। দেখলাম শিক্ষক আর কলেজ সংসদ নির্বাচনে জয়ী ছাত্র-সংগঠনের সদস্যদের লেখা সেখানে ছাপা হয়েছে। আশির দশকে বিশ্ববিদ্যালয়ে যখন পড়ি তখন ইত্তেফাক , সংবাদ, ইনকিলাব ও সংগ্রাম ছিল দৈনিক পত্রিকা। সন্ধানী, রোববার ও বিচিত্রা ছিল সাপ্তাহিক পত্রিকা। ওগুলো ছিল পাঁচমিশালী পত্রিকা। একটি ছোটো গল্প ও কয়েকটি কবিতা ছাপা হতো বটে। সেখানে সৈয়দ শামসুল হক, শামসুর রাহমান, আল মাহমুদ, নির্মলেন্দু গুণ এদের কবিতা ছাপা হতো। তখন ইন্টারনেট কেন কম্পিউটারই তো ছিল না। জাতীয় দৈনিকে আমার কোনো গল্প, কবিতা কোথাও ছাপা হয়নি। তবে স্মরণিকা, লিটল ম্যাগাজিনে ছাপা হয়েছে। তার কিছু এখনও আছে।

নব্বই-এর দশক। চাকরি নিলাম এনজিও-তে। ১১ বছর চাকরি করলাম কুমিল্লা, চট্টগ্রাম, সিলেট ও ফরিদপুরে। এ সময়ে গ্রামে ঘুরে ফিচার লিখতাম জেলা ও জাতীয় পত্রিকায়। ছাপা হতো। ওটাই নেশা ছিল। সে সময়ে ঢাকা ডাইজেস্ট নামে বই সাইজের একটা মাসিক সাহিত্য পত্রিকা বের হতো। সেখানে কবিতা ও গল্প দিতাম, প্রকাশও হতো। এতেই সন্তুষ্ট ছিলাম।
২০০০ সালে ঢাকায় চলে এলাম। এ সময়ে আমার লেখা উন্নয়নবিষয়ক কিছু বই মূলত এনজিও থেকে প্রকাশিত হয়েছে। নেপাল ও মায়ানমার থেকেও ইংলিশ ভাষায় আমার লেখা প্রশিক্ষণ ম্যানুয়েল প্রকাশিত হয়েছে। বেশ খুশি ছিলাম। এগুলো আন্তর্জাতিক ওয়েবসাইটেও পাওয়া যায়। ২০১২-১৩ সালে আমার মোট ৬টি অপারেশন হয়। তার মধ্যে ৩টি-ই ছিল খুব জটিল। বোন ম্যারো অপারেশন। অপারেশনের পরে ২/৩ মাস ছুটিতে থাকতে হতো। অনেক টাকার চাকরি ছেড়ে দিলাম। এ সময়ে আবার সৃজনশীল লেখালেখি শুরু করেছি।

 

লেখক জীবনের মজার কোনো অভিজ্ঞতা জানতে চাই।
তেমন কোনো মজার অভিজ্ঞতা নেই। তিক্ত অভিজ্ঞতা আছে বেশ। বিশেষ করে প্রকাশকদের অপেশাদার আচরণ বিস্মিত করে। আনন্দানুভূতি আছে। জলধি অনূর্ধ্ব ৩০ গল্পলিখন প্রতিযোগিতায় বিচারক হিসেবে কাজ করাটা ছিল আনন্দের। একটি সাধারণ ঘটনা বলা যেতে পারে। আমার প্রথম উপন্যাসের নাম ‘আমার বান্ধবীগণ’। সেদিন আমি স্টলে ছিলাম। এক দম্পতি এলেন। ভদ্রলোক বইটির ভূমিকা পড়লেন। স্টলের কর্মীকে মূল্য জিজ্ঞাসা করলেন। ততক্ষণে স্ত্রী বইটি হাতে নিয়ে এর নাম দেখে ফেলেছেন। তিনি স্বামীর দিকে এমন অগ্নিদৃষ্টিতে তাকালেন যে, স্বামী কালবিলম্ব না করে স্টল ত্যাগ করলেন। সেটি বেশ মজা দিয়েছে আমাকে। বইটির মুদ্রিত সব কপি শেষ। প্রকাশক আবার ছাপতে চান, তবে প্রকাশকের কর্মীগণ বইটির নাম পাল্টানোর কথা বলে মিটিমিটি হাসেন- এটাও উপভোগ করি।

 

বাংলাদেশের সৃজনশীল লেখালেখির ভবিষ্যৎ সম্পর্কে আপনার মতামত জানতে চাই।
হুমায়ন আহমেদই এদেশের সর্বাধিক জনপ্রিয় লেখক। তিনি এদেশের ব্যাপক-সংখ্যক তরুণকে তাঁর লেখায় আকৃষ্ট করতে সক্ষম হন। এর মধ্যদিয়ে এদেশে ভারতীয় বইয়ের রমরমা বাজার বিলুপ্ত হয়। বিপুল সংখ্যক তরুণ তাঁর বই পড়ে বই পড়ুয়াতে রূপান্তরিত হয়। পরবর্তীতে এদের মধ্যেই অনেকে এদেশের মেধাবী লেখকদের বই পড়তে আগ্রহী হয়ে ওঠে। আখতারুজ্জামান ইলিয়াস, শওকত আলী, আহমদ ছফার মতো লেখকের লেখার প্রতি আকৃষ্ট হয়। এখন অনেক প্রতিভাবান লেখক তাঁদের শিল্পোত্তীর্ণ লেখার মধ্যদিয়ে আমাদের দেশের সাহিত্যকে সমৃদ্ধ করছেন। প্রবীণ লেখকদের মধ্যে সেলিনা হোসেন, নাসরিন জাহান, জাকির তালুকদার, পাপড়ি রহমান, ইমতিয়ার শামীম অত্যন্ত মানসম্মত শিল্পোত্তীর্ণ কথাসাহিত্য রচনা করছেন। এদেশে সাম্প্রতিককালে বহুসংখ্যক তরুণ লেখক উপন্যাস রচনায় ব্রতী হয়েছেন। এঁদের অনেকেই হুমায়নীয় প্রভাব কাটিয়ে উঠতে সক্ষম নন। তবুও কিছু প্রতিশ্রুতিশীল লেখক বাংলাদেশের উপন্যাস সাহিত্যে সমৃদ্ধি আনবে বলে আমার দৃঢ বিশ্বাস।

 

লেখালেখি নিয়ে আপনার ভবিষ্যৎ স্বপ্ন
আমার প্রকাশিত শিশু-কিশোরদের ৪টি গল্পগ্রন্থ রয়েছে। ভ্রমণবৃত্তান্ত রয়েছে ২টি। মননশীল গ্রন্থের সংখ্যাও ৪টি, উপন্যাস ৪টি। প্রকাশকের অনুরোধে এবং লেখা চুরি রোধে ১টি কবিতার বইও প্রকাশ করতে হয়েছে। এ বছরে একটি ইতিহাস-ঐতিহ্যের বই প্রকাশিত হবে, বইটির নাম কুষ্টিয়ার প্রত্ন-নিদর্শন। এই বইটি লেখার জন্য প্রায় চার বছর কাজ করছি। কুষ্টিয়া একশত বছর প্রাচীন মসজিদ, মঠ, মন্দির, জমিদার বাড়ি ও অন্যান্য স্থাপনার ইতিহাস ও স্থাপত্যকৌশলের বর্ণনা সমৃদ্ধ বইটি চার রঙে মুদ্রিত হবে। এছাড়া একুশে পদকপ্রাপ্ত আমার জন্মজেলা কুষ্টিয়ার কবি আজিজুর রহমানের সাহিত্যকর্ম নিয়ে কাজ করছি। বইটির নাম হতে পারে কবি আজিজুর রহমানের জীবন ও সাহিত্যকর্ম। ছোটোগল্পগুলো সম্পাদনা করছি। একাধিক প্রকাশকের সাথে কথা হয়েছে। হয়তো কোনো প্রকাশক এ-বছরেই ছাপতে পারেন।

 


[ বই-পুস্তক-প্রকাশনা এবং বাংলাদেশের প্রকাশনা জগতের যে কোনো সংবাদ প্রকাশের জন্য আমাদের ই-মেইল করতে পারেন : boideshnews@gmail.com ]

Facebook Comments Box

কপিরাইট © ২০১৭ - ২০২০ ।। বইদেশ-এ প্রকাশিত কোনও সংবাদ, কলাম, তথ্য, ছবি, কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না

Design & Development by: TeamWork BD