ষড়ঋতুর দেশ এই বাংলাদেশ। সুজলা, সুফলা, শস্য-শ্যামলা এই বাংলার ঋতু বৈচিত্রের ধারাবাহিকতায় প্রকৃতিতে যেমন ঘটে বিচিত্রতার সমাহার, তেমনি বাঙালি জীবনের বাঙালিয়ানায় আনে নানা বৈচিত্র। পোষাক-আশাক, চাল-চলন, খাওয়া-দাওয়া, জীবন ও জীবিকা নির্বাহ সব কিছুতেই আসে পরিবর্তনের ছোঁয়া।
গ্রীষ্মের প্রখর রৌদ্রের দুর্বিষহ তাপ-দাহতার গ্লানি, বর্ষার অবিশ্রান্ত ধারায় ধূয়ে মুছে শান্তি আর সূচিতা এনে দেয়। তেমনি, শরতের শিউলির সুবাস, কাশের শুভ্রতা, সাদা মেঘের ভেলা, সব মিলিয়ে এক পূর্ণতার প্রকাশ, পবিত্রতার ছোঁয়ায় মন ভরিয়ে দেয়। হেমন্তের সোনা ঝরা রোদ, মাঠ ভর্তি সোনালি ধান, ধানের মিষ্টি সোঁদা গন্ধ বাঙালির চিরচেনা আমেজে লোক সংস্কৃতি ও ঐতিহ্যের বাঙালিয়ানায় মন ভরিয়ে দেয়। হেমন্তের শেষ মাস অগ্রহায়ণ মাঠ ভর্তি উপহারের ডালি সাজিয়ে-বিছিয়ে দিয়ে যায় সোনালি সম্ভারে। বাংলার ঘরে ঘরে বয়ে চলে আনন্দের জোয়ার। শুরু হয় নবান্ন উৎসব। মেতে ওঠে বাংলার গ্রাম, গঞ্জ, শহর, বন্দর। ‘নতুন ধানে হবে নবান্ন উৎসব’-এই নবান্ন দিয়েই শুরু হয় বাঙালির পিঠা উৎসবের হাতেখড়ি।
দেখতে দেখতে শীত আসে। ‘আমলকির শাখায় কাঁপন ধরিয়ে’ সেই শীতের বুড়ি এসে হাজির হয় কুয়াশার চাঁদর মুড়ি দিয়ে। প্রকৃতিতে আসে ‘খেজুর রস’ নামক নতুন অতিথি। তার আগমনে আমাদের মন রসে জবজব হয়ে যায়, জীবনে আসে এক অভুতপূর্ব রসাস্বাদনের অনাবিল আনন্দ।
শীতের প্রথম মাস পৌষ। এই পৌষ মাসকে ঘিরেই বাঙালির সখ্যতা বাড়ে পিঠা-পুলির সাথে। হৃদ্যতা গড়ে ওঠে পৌষপার্বণের সাথে। এই মাসেই নতুন ধান কাটার ধুম পড়ে যায়। নতুন ধানের মৌ মৌ গন্ধে মেতে ওঠে বাংলার আনাচে কানাচে। তাইতো ‘কবিগুরু’ এই সোনালী ধান আর ধানের মিষ্টি সোঁদা গন্ধের প্রেমে অভিভূত হয়ে লিখেছিলেন-
‘পৌষ আমাদের ডাক দিয়েছে আয় রে চলে,
আয় আয় আয়,
ডালা যে তার ভরেছে আজ পাকা ফসলে
মরি হায় হায় হায়।
হাওয়ার নেশায় উঠলো মেতে দিগ্ বধুরা
ধানের ক্ষেতে
রোদের সোনা ছড়িয়ে পড়ে মাটির আঁচলে
মরি হায় হায় হায়।
…
আলোর হাসি উঠল জেগে ধানের শীষে
শিশির লেগে,
ধরার খুশি ধরে না গো ওই যে উথলে
মরি হায় হায় হায়’।
পৌষ সংক্রান্তি মুলত নতুন ফসল কাটার এবং পিঠা-পায়েসের উৎসব, যাকে বাংলায় বলে পৌষপার্বণ। নতুন ধান, খেজুরের রস, গুড় বা পাটালি দিয়ে বিভিন্ন ঐতিহ্যবাহী পিঠা তৈরি করা হয়, যার জন্য প্রয়োজন হয় চালের গুড়া, দুধ, নারিকেল আর খেজুরের রস ও গুড়।
বাঙালির খাদ্য তালিকায় এক অনন্য রসাস্বাদনের উপকরণ হলো পিঠা। পিঠা-পুলি শুধুমাত্র বাঙালিকে ভোজনানন্দে মাতিয়ে রাখে না। এই পিঠা বাঙালির লোক ইতিহাস ও ঐতিহ্যের নিদর্শন স্বরূপ এক গুরুত্বপূর্ণ ভুমিকা পালন করে আসছে। এই পিঠার মাধ্যমেই বাংলার লোকজ ও নান্দনিক সংস্কৃতির বহিঃপ্রকাশ ঘটে থাকে। বাংলা সাহিত্যে ও ঐতিহ্য প্রেমীদের লেখালেখিতেও উঠে এসেছে পৌষপার্বণের পিঠা। পিঠার মাধুর্য্য, মুগ্ধতা, মনোহারিণী রূপ, রসাস্বাদনের আনন্দ সব কিছুই বর্ণিত হয়েছে সাহিত্যের সংস্পর্শিত কাগজ কলমের বর্ণিল আলপনায়। তেমনি এক অসাধারণ শীতের পিঠা খাওয়ার শাশ্বত রূপ খুঁজে পাই কবি বেগম সুফিয়া কামাল-এর ‘পল্লী স্মৃতি’ কবিতায়-
‘পৌষ পার্বণে পিঠা খেতে বসি খুশিতে বিষম খেয়ে,
আরো উল্লাস বাড়িয়াছে মনে মায়ের বকুনি পেয়ে।’
এ যেন চিরাচরিত আবহমান বাংলার অন্য আরেক রূপ। শীতের কুয়াশাচ্ছন্ন কাক ডাকা ভোরে খেজুরের রস বা গুড় দিয়ে তৈরি নানাবিধ পৌষালি পিঠা খাওয়ার স্বাদই আলাদা। কত ধরনের পিঠা যে তৈরি হয় এই পৌষ পার্বণকে ঘিরে। পৌষ পার্বণের দিনে চারিদিকে কেমন একটা মিষ্টি মধুর সুবাস ছড়িয়ে থাকে। নতুন ধানের মিষ্টি সোঁদা গন্ধে ভরপুর থাকে মাঠ-ঘাট আর কৃষকের উঠোন।
গৃহস্হ বাড়িতে পিঠা-পুলি তৈরির আবেশ আর খেঁজুরের রসের মিষ্টি গন্ধ মন ভরিয়ে দেয়। বাড়ির মেয়ে-বৌয়েরা সারারাত জেগে জেগে কত পিঠা-পায়েস যে তৈরি করে তার কোনো হিসেব থাকে না। চন্দ্রপুলি, দুধপুলি, ক্ষীরপুলি, মুগপুলি, নারকেল পুলি কত ধরণের পুলি যে হয় এই সংক্রান্তিতে! শুধু কি পুলি? পাটিসাপটা, ভাঁপা পিঠা, চুসি পিঠা বা ছড়া পিঠা, চন্দন কাঠ পিঠা, গোকুল পিঠা, বকুল পিঠা, মন মাতানো আরো যে কত পিঠা! যার নাম শুনলেই জিভে জল চলে আসে। চিতুই পিঠা যাকে গ্রাম্য ভাষায় বলে কাঁচি খোঁচা পিঠা, যখন দুধ রসে ভিজিয়ে রাখে তখন এক অনবদ্য স্বাদের হয়। শীতের সকালে তীব্র কুয়াশার চাদর সরিয়ে যখন সূর্যের সোনালি আলোর ঝলকানি এসে পড়ে উঠোনে, বারান্দায়। তখন সেই আলো মাখা রোদে পিঠ ঠেকিয়ে বসে রসে ভেজা চিতুইয়ের রস আস্বাদনে মন হয়ে ওঠে দিশেহারা।
বাঙালির এই পিঠার বাঙালিয়ানাও আবার সময়, স্হান, কাল ভেদে আলাদা আলাদা হয়ে থাকে। ভিন্ন ভিন্ন অঞ্চলে বিভিন্ন ধরণের পিঠার প্রচলন দেখা যায়। বিভিন্ন লোকজ সংস্কৃতি ও সামাজিক অনুষ্ঠানেও পিঠার প্রচলন দেখা যায়। নবান্ন উৎসব ছাড়াও মুসলিম সমাজে বিয়ের অনুষ্ঠানে পিঠার প্রচলন আছে। বিভিন্ন ধরণের মনোহারিণী পিঠা যেমন নকশী পিঠা, পাকোন পিঠা, আন্দেশা বা তেলেভাজা পিঠা, ফুলঝুরি পিঠা, বরফি পিঠা, বড়া পিঠা, পানতোয়া পিঠা, ঝিনুক পিঠা, বিবিয়ান পিঠা, তালের পিঠা, মুগ পাকোন পিঠা, দুধরাজ পিঠা, পুলি পিঠা এসব অনুষ্ঠানে দেখা যায়। এই পিঠা মেয়ে বা ছেলের শ্বশুরবাড়িতে উপঢৌকন হিসাবে আলপনা আঁকা মাটির হাঁড়িতে করে পাঠানোর রীতি এখনো রয়েছে।
ছেলে বা মেয়ের বিয়ের পরে প্রথম যখন শ্বশুর বাড়িতে আসে তখন বিভিন্ন রকম পিঠে পায়েস করে খাওয়ানো হয় নতুন জামাই বা নতুন বৌকে। বিভিন্ন ধরনের পুলি পিঠা, চুসি পিঠা বা ছড়ার ক্ষীর, দুধ লাউ, পাটিসাপটা, দুধ চিতুই, জামাই ভোগ, লবঙ্গ লতিকা, গোকুল পিঠা আরো কত ধরনের পিঠা যে তৈরি হয় এই অনুষ্ঠানে। (সংক্ষিপ্ত)
কপিরাইট © ২০১৭ - ২০২০ ।। বইদেশ-এ প্রকাশিত কোনও সংবাদ, কলাম, তথ্য, ছবি, কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না
Design & Development by: TeamWork BD