।। রায়হান আহমাদ ।।
‘দিদি একটা ভালো খবর আছে!’
‘কী খবর?’
‘নিমন্ত্রণপত্র এসেছে একটা। আগামী শুক্রবার বিয়ে খেতে যাচ্ছি আমরা। আহা কী আনন্দ আকাশে বাতাসে।’
‘এত লাফাচ্ছিস কেন? কার বিয়ে?’
‘ধুর! আমি এতসব জানি নাকি! আম্মু বলল শুক্রবার বিয়েতে যাচ্ছি। আমি অবশ্য কার্ডটাও দেখেছি, কিন্তু খেয়াল করিনি কার বিয়ে।’
‘তা করবি কেন। যত্তসব!’
‘আপ্পি বিয়ের কার্ডটা যে কী সুন্দর! তোকে বলে বুঝাতে পারবো না। আমি ঠিক করেছি আমার কার্ডও অমন করেই বানাবো। উঁফ! যা দেখতে!’
‘কার্ড কার কাছে?’
‘আম্মুর কাছে আছে। যা দেখে আয়।’
ছোটোবোনের আদিখ্যেতা দেখে চিত্রার গা জ্বালা করছে। এইটুকুন মেয়ে! সেদিন এসএসসি পাশ করলো। আর আজ কি না সে নিজের বিয়ের কার্ড কেমন হবে তাও ঠিক করে ফেলেছে। ‘নির্লজ্জ বেহায়া কোথাকার!’ মনে মনে বকাটা দিয়ে একরাশ বিরক্তি নিয়ে মায়ের ঘরের দিকে পা বাড়ালো সে। বিয়ের নিমন্ত্রণ খেতে যাওয়ার লোভের চেয়ে বিয়েটা কার এটা জানাই তার কাছে বেশি গুরুত্বপূর্ণ মনে হলো।
সে যে খেতে পছন্দ করে না, তা একদমই নয়। গরুর মাংস, ইলিশ মাছ আর চিংড়ি তার প্রিয় খাবার। গরুর মাংসের বিরিয়ানি, তেহারি, কাবাব, কাচ্চি থেকে শুরু করে সব রকমের খাবারের প্রতি তার খুব ঝোক। ‘ইলিশ ভাজা খেতে মজা’ থেকে শুরু করে সর্ষে ইলিশ অবধি সব আইটেম গোগ্রাসে শেষে করতে তার মোটেও আপত্তি নেই। আর চিংড়ি! ওহ! সে কথা না হয় আজ নাই বললাম, বরং ভেবে নাও নিজের মতো করে। চিকেন আইটেম যে সে পছন্দ করে না এমনটা কখনই হতে পারে না। বড়ো বড়ো সুস্বাদু মাছের প্রতিও তার আকর্ষণ দেখার মতো। দধি মিষ্টান্ন সে খুব যত্নের সাথে খায়। লুচি আলুর দম পেলে তো কোনো কথাই নেই। ‘যত পাও তত খাও’ নীতিতে তখন সে চরম বিশ্বাসী হয়ে ওঠে। এত্তসব খাবারের কথা বলতে বলতে আমারই যে এখন বড্ড খিদে পেয়ে গেছে। ইসস! আলুর দম আর লুচি, গরুর কালা ভুনা আর পরোটা, নান আর শিক কাবাব যদি হতো এখন! ইসসস!!
এক প্লেট চিকেন নুডুলস, দুই পিস স্পাইসি চিকেন, ছয় পিস ফ্রাইড চিকেন আর দুটো কিং বার্গার খেয়ে পেটটাকে একটু শান্ত করে তোমাদের কাছে আবার চলে এলাম বিয়ের নেমন্তন্ন আর চিত্রাদেবীর গল্প করতে। যদিও পুরান ঢাকার কাচ্চি, বোরহানি আর শিক কাবাব খেতে পেলাম না বলে আপসোস হচ্ছে, তবুও পেটটা যে আপাতত শান্ত হলো, এ-ই বা কম কীসে। তো যা বলছিলাম, দাঁড়াও একটু কোক খেয়ে নিই। আহ্! হ্যাঁ, এবার গল্পে ফেরা যাক। চিত্রা তার আম্মুকে জিজ্ঞেস করলো, ‘আম্মু শুক্রবার যে বিয়েতে যাচ্ছি সে বিয়েটা কার?’
একগাল পান চিবুতে চিবুতে চিত্রার আম্মু বলল, ‘তোর মামুন মামার শালার চাচাতো ভাইয়ের ছেলের বিয়ে। একবার ভাবলাম যাব না। আবার ভেবে দেখলাম বাসার পাশেই যেহেতু বিয়েটা হচ্ছে আর দাওয়াতও পেয়েছি, না যাওয়ার কোনো মানেই হয় না। তুই কী বলিস?’
‘দাওয়াত যখন পেয়েছ অবশ্যই যাবে। কাছে হোক বা দূরে সেটা তো দেখার বিষয় না।’
‘এলার্জি মা আমার, তুমি এত খুশি হচ্ছো কেন? তোমার না চিত্রা?’
‘মা আমি চিত্রা আর আমার এলার্জি আছে। আমি এলার্জি নই।’
‘মন খারাপ করিস না মা। বয়স হয়েছে কী বলতে কী বলে ফেলি বুঝতেও পারি না। তুই কি বাসাতেই থাকবি? গিয়েও তো লাভ নাই, খেতে পারবি না কিছুই।’
মায়ের মুখে এ কথা শুনে মনটা ভীষণ খারাপ করে ঘরে চলে গেল চিত্রা। যেতে যেতে এলার্জির চৌদ্দগুষ্টি উদ্ধার করে পানিতে ডুবিয়ে দিয়ে আবার তুলে এনে কতক্ষণ পিটিয়ে ছেড়ে দিলো সে। এদিকে এলার্জিটা একটু শান্ত আছে, শুক্রবার অবধি অমন ভদ্র সেজে থাকলে গরুর মাংসের চার পাঁচটা পদের তিনটাই মিস করবে না সে। বাকি দুটো এলার্জির নাম ধরে কষ্ট করে বাদ দিতে হবে। এদিকে বিয়ের আয়োজন দেখার মতো ব্যাপার। পাঁচ পদ গরু থাকতেও মুরগি থাকবে দুই পদ, মাছ ডিম তো থাকবেই। কয়েক পদ ডেজার্ট আইটেমের কথা আবার বলতে হয় নাকি। চিত্রা ওগুলোর কিচ্ছুটি মিস করবে না। ভালোয় ভালোয় এলার্জি ব্যাটা শান্তশিষ্ট থাকলেই হলো।
ঈশ্বরের নাম জপতে জপতে কাহিল হয়ে পড়লো চিত্রা এবং ঈশ্বরের কৃপায় বৃহস্পতিবার রাত অবধি তার প্রেমিক মিস্টার এলার্জি খুব শান্তশিষ্টই ছিল। এ কয়দিন তাকে একবারও জ্বালাতে আসেনি। রাত দশটায় রাতের খাবার খেয়ে শুয়ে পড়লো চিত্রা। ঘুম আসছে না বলে ফোনটা পাশ থেকে তুলে নিয়ে ফেসবুকে ঘোরাঘুরি করতে লাগলো। রাত বারোটার দিকে যখন তার চোখ লেগে আসতে চাইছে ঠিক তখনই সে তার প্রেমিকের উপস্থিতি টের পেতে শুরু করলো। তবুও ঘুম আসার কারণে সে কিছুটা স্বস্তি পেলো।
বিয়ের নেমন্তন্ন খেতে যাওয়ার জন্য যখন সবাই প্রস্তুত হচ্ছে তখন চিত্রার মনটা ভীষণ খারাপ। তার প্রেমিক মিস্টার এলার্জি তাকে খুব ভালোভাবেই জড়িয়ে ধরেছে। বিয়ে বাড়িতে গিয়েও কোনো লাভ হবে না তার। খেতে পারবে না কিছুই। সে একবার মনে মনে ভাবলো যাবে না। কিন্তু এত বড় ফ্ল্যাটে একলা থাকার মতো যথেষ্ট সাহসী সে নয় এবং আম্মাজানও তাকে একলা রেখে যেতে নারাজ। বাধ্য হয়েই বিয়ে বাড়িতে যেতে হবে এবং তাকে জাপটে ধরে সাথে সাথে ছুটবে উটকো প্রেমিক শালা এলার্জি। কিছু ভালো-মন্দ খেতে গেলেই শরীরে তার উপস্থিতি জানান দেবে লাল মুখো মটকো বানরের মতো। হায়রে কপাল!
আজকের সাজটা বেশ ভালো হয়েছে চিত্রার। নীলশাড়ি আর কালো টিপে তাকে খুব সুন্দর দেখাচ্ছে! আমি এক কথায় ফিদা হয়ে গেছি। সে যাক! চলো আমরা একটু ঘুরে আসি খাবারের টেবিল থেকে। হ্যাঁ, ঠিক ধরেছো। দক্ষিণ দিকের বাম টেবিলটাতেই চিত্রার পরিবার বসে আছে। প্রথমেই খাবার টেবিলে এলো ফ্রাইড রাইস আর তার সাথে গরুর মাংসের টিক্কা কাবাব। গন্ধ শুকেই আম্মাজান চিত্রার প্লেট থেকে কাবাবটা তুলে নিলেন। তারপর এলো মুরগির ডিম আর চিংড়ি। কত্ত বড়ো বড়ো চিংড়ি! দেখলেই জিভে জল চলে আসে। কিন্তু সেটা তার ছোটোবোনের প্লেটে আপনা থেকেই চলে গেল তার প্লেট থেকে। সর্ষে ইলিশটা সে নিজের হাতেই তুলে দিলো ছোট ভাইয়ের প্লেটে।
তারপর একে একে এলো গরুর মাংসের ঝাল ফ্রাই, রেজালা, কালাভুনা, চুইঝালের গরুর মাংস। এ সবই তার প্রিয় খাবার। কিন্তু সেদিকে নজর দেওয়া তার আজন্ম পাপ না শুধু, মহাপাপ। কারণ তার শরীরে ভর করে বসে থাকা প্রেমিক মিস্টার এলার্জি এসব খাবার একদমই পছন্দ করে না। মেয়ের দিকে তাকিয়ে লোকটাকে বলে আম্মাজান চিত্রার জন্য মুরগির রোস্ট আনিয়ে দিলেন দুই পিস। একটার আধখান খাওয়ার পর আবিষ্কার করলো তাতে ধনে পাতা দেয়া। কোনো এক আশ্চর্য কারণে সে ধনে পাতা সহ্য করতে পারে না। রোস্ট দেড়টাও উঠে গেল ভাই আর বোনের প্লেটে। হাফগ্লাস বোরহানি আর দু কাপ দই খেয়ে যখন বিয়ে বাড়ি থেকে বেরিয়ে এলো চিত্রা তখন তার চেহারার দিকে তাকিয়ে তার সব রূপ ছাড়িয়ে আমার বারবার শুধু একটা গানই মনে পড়ছিল, ‘ছল ছল নয়নে, হাসি মাখা বদনে…’
কপিরাইট © ২০১৭ - ২০২০ ।। বইদেশ-এ প্রকাশিত কোনও সংবাদ, কলাম, তথ্য, ছবি, কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না
Design & Development by: TeamWork BD