।। ফাহিম ফিরোজ ।।
রমিজের কাব্যরোগের কারণ সম্পর্কে অনেক কথা প্রচলিত ছিল । সবগুলো লিখতে গেলে কাগজে টান পড়ে।
সংক্ষেপে- মা ভাবতো, ছোটবেলা থেকে বিস্তর বই পড়ে পড়ে মাথাটা সেই ছাঁচে একেবারে বিগড়ে গেছে। তখন ঐ লক্ষীছাড়ার প্রতি দ্বিগুণ স্নেহ বিস্তার করে অনুযোগের সুরে বলতেন, ‘হ্যাঁ রে রমিজ, এই যে দিন-রাত শুধু কবিতা টবিতা লিখিস, একটু চোখ খুলে ভাল মতো চারপাশের মানুষগুলোকে দেখিস না কেন রে, আমি আর কতদিন বাঁচব?’ মা চোখে আঁচল চাপা দেন।
রমিজ অম্লানবদনে ভাতের সাথে মাছের ঝোল মাখে।
বাবা ভাবে, এইসব অনাসৃষ্টির জন্য রমিজের সৃষ্টিছাড়া বন্ধুগুলোই দায়ী। কী একটা সাহিত্য ক্লাবও নাকি খুলেছে হতচ্ছাড়ারা। রোজ সন্ধ্যায় আসর বসিয়ে কবিতা পড়ে। কবিতা পড়বি ভাল কথা, তাই বলে সব ভুলে ওই ছাইপাশ লিখতে হবে কেন? এই পর্যন্ত ভেবে এককালের ঝানু ব্যবসায়ী তার কবিসুলভ পুত্রের অনুপস্থিত বন্ধুদের উদ্দেশে যেসব মধুবাক্য ছাড়েন তার স্বাদ কিছুমাত্র মিষ্টি নয়।
বাকি রইল বন্ধুরা। তারা দোষ ঢালবার মতো কাউকে না পেয়ে অগত্যা বিধাতার ওপরই দোষ চাপায়। অমন খেয়ালি করে ওকে না গড়লে কি হত না!
যাকে নিয়ে এই হট্টগোল, সেই রমিজ এ সকল যুক্তি-তর্ক চরিত্র বিশ্লেষণ সমস্ত অগ্রাহ্য করে দিনের পর দিন, মাসের পর মাস, তেমনি রয়ে গেল। খুব ভোরে উঠে সদর দরজার পাশে পুকুরপাড়ে বসে শোভা উপভোগ করে। বেলা বেড়ে যায়, রোদ অসহ্য হলে ভেতর বাড়ির ছায়ায় গিয়ে নিবিষ্ট মনে সবজি-পরোটার গতি করে। তারপর ঢাউস খাতা হাতে হেঁটে-বসে থেকে থেকে তোলে কবিতার লাইন। দশটা বাজার খানিক আগে আগে পুরনো মটরসাইকেলে রওনা দেয়। উপজেলা সদরের ঠিক মাঝখানে উলিপুর হাই স্কুলের সুবৃহৎ চত্বর। রমিজ সেখানকার বাংলার শিক্ষক।
রমিজের ঠিক কবে থেকে এমন মতিভ্রম হল বলা শক্ত। তবে ছোটোকাল থেকেই বেশ বোঝা গিয়েছিল, সরল সোজা সংসারজ্ঞানী হওয়ার দৌড়ে সে খুব খানিকটা অনাগ্রহী। জগতে উদাসীন লোকরা মাঝে মাঝেই ব্যর্থতা দারিদ্রের চোরাবালিতে বিচরণ করে। কিন্ত স্কুল কলেজে রমিজ বেশ গৌরবের সাথেই বিচরণ করে গেল। তারই বদৌলতে, আমি যখন নব নব ব্যাবসার চেষ্টায় নিত্যনতুন ফেল মারছিলাম, ঠিক তখন সে রবীন্দ্রনাথ জীবনানন্দ কপচাতো ক্লাসজোড়া ছাত্রদের সামনে। একালে অবশ্য আমি খানিকটা পশার করেছি এবং রমিজও জেলার পত্রিকায় কবি হিসেবে নাম পেয়েছে বৈকি।
একে তো রমিজের বাপ এবং আমার বাপ উভয়ে খুব নিকট সম্পর্কের ভাই, তার ওপর রমিজের বন্ধু সকলের মধ্যে আমিই সবচেয়ে কাছের, এ বললে মিথ্যাচার হয় না। অপরাপর বন্ধুদের দু’চক্ষে দেখতে না পারা ওর বদরাগী বাবা অব্দি আমাকে যথেষ্ট নির্ভর করেন বলেই বিশ্বাস। এর কারণ হিসেবে সাতপাঁচ কোন ঝুট ঝামেলায় না থাকার অত্যন্ত সাধারণ বৈশিষ্ট্য ছাড়া নিজের আর কোন গুণ খুঁজে পাই না।
যা হোক, এ তো গেল ভূমিকা। যথেষ্ট বড় হয়েছে নিঃসন্দেহে। তবে ভীত হবেন না, মূল কাহিনীটি ভারি ছোটো এবং দুই নিঃশ্বাসে ফুরিয়ে যায়।
সেবার বর্ষার কী ধুম! দিনরাত আকাশের গা বেয়ে জল পড়ছে তো পড়ছেই। আমাদের সান্ধ্য আড্ডা বসছে না কদিন ধরেই। মনটাও বড় আঁইচাঁই করে। এমন একদিন চাচিজান খবর দিয়ে ডেকে পাঠিয়ে বলেন, ‘দেখো তো বাবা, কী অনাছিষ্টি কাণ্ড। আমি এদিকে মেয়ের বাড়িতে দেখতে যাবার কথা বলে দিয়েছি। রমিজ গোঁ ধরে বসে আছে বিয়ে-শাদিতে ও নাই। মেয়ে দেখতে যেতে পারবে না।’
রমিজের জন্য মেয়ে দেখা হচ্ছে তবে! বড় চমৎকৃত হওয়া গেল। বিয়ে সম্বন্ধে রমিজের মত হচ্ছে- এ জিনিসটা বৃহৎ এবং মহৎ হবার পথে অন্যতম প্রধান প্রতিবন্ধক। তার এমন আদর্শের সাথে পিতামাতার ইচ্ছার ইতোপূর্বেই কয়েকবার বিরোধ দেখা দিয়েছে এবং রমিজকে কোনভাবেই রাজি করানো যায়নি।
আমি বললাম, ‘চাচীজান, এবার ওকে ছাই দিয়ে ধরবো, আপনি চিন্তা করবেন না।’
ছাই অবশ্য বড় কম লাগল না। প্রচুর অনুরোধ, উপদেশ, তিরষ্কার এবং রাগারাগি সহ্য করার পর এবং কোন দিক থেকেই নিজ আদর্শের কোন সমর্থন পেলো না। অনন্যোপায় রমিজ অবশেষে মেয়ে দেখতে যেতে রাজি হলো।
এক ছুটির দিন বিকেলে দুই বন্ধু আর দুই জেঠা সম্পর্কের মুরুব্বি মিলে মেয়ের বাড়িতে উপস্থিত হওয়া গেল। রমিজ দেখতে বরাবরই সুশ্রী। হালকা ধূসর পাঞ্জাবিতে তাকে আরও সুদর্শন লাগছিল। এদিকে আমার চেহারাটা ‘কোনমতে চলে’ বললেও বেশি বলা হয়। তবু কনে দেখা বলে কথা। কায়দা করে খানিক ঝেড়ে মুছে এসেছি। মুরুব্বি দুজনের পোশাক পরিচ্ছদ নিয়ে কোন মাথা ব্যথা ছিল না। সন্ধ্যার আগে আবার বৃষ্টি না এসে যায়, এই নিয়ে তারা বেশি চিন্তিত।
যথাসময়ে সম্ভাব্য কনে এসে হাজির হয়। খানিকটা নতুন ঠেকল। ঠিক জড়সড় ভাবটি নেই, হেঁটে এসে বসবার ভঙ্গিতে স্নিগ্ধ সাবলীল ভাব। এমন তো সচরাচর দেখা যায় না। যদিও চোখজোড়া নত আর আকাশি রঙের শাড়ির মিহি পাড়ে কপালের অনেকটা ঢাকা। তবু বেশ বোঝা যায়, এই বর্ষা বিকেলের কাঁচা হলুদ আলোয় দেখার মতো একটা মুখই বটে। সৌন্দর্য? না, সৌন্দর্য সে মুখে হার মেনেছে, লাবণ্য আর মায়ারই হয়েছে জয়।
রমিজ এতক্ষণ চোখ-মুখ কুঁচকে শক্ত হয়ে বসে ছিল। এই যে এক বিশেষ ব্যক্তির আবির্ভাব হলো, চেয়েও দেখেনি । চুপি চুপি ওকে বলি, ‘তোর ভারী ভারী তত্ত্ব আর রাশি রাশি কাব্যগুলোকে আপাতত ছুটি দিয়ে একবার তাকা তো ওদিকে।’
অনিচ্ছাভরে রমিজ তাকায়। আধো আলো আধো অন্ধকার মুখের দিকে তাকিয়ে রমিজের চির উদাসীন চোখের স্থির তারা এক মুহুর্তের জন্য কেঁপে ওঠে। ফেরার পথে রমিজ তেমন একটা কথা বলে না। সন্ধ্যা হয় হয়। চারপাশে আঁধার নেমে আসছে। মুরুব্বিরা ভাবেন, মেয়ে পছন্দ হয়নি বোধহয়। কিন্তু বন্ধুর মনের ভাব আমার অগোচর রইল না। সেই সন্ধ্যাকালে রমিজের চিন্তিত মুখের দিকে তাকিয়ে বেশ বুঝতে পারলাম, বন্ধুবরের বৃহৎ ও মহৎ হওয়ার ভারি ভারি তত্ত্ব এবার দেশছাড়া হল বলে।
চাচীজান বৃত্তান্ত শুনে আনন্দিত হলেন। চাচাজান তামাক হাতে বলেন, ‘বেশ তো, রমিজের যখন পছন্দ হয়েই গেছে, আর বাবা দেরি নয়।’
চাচাজান বাস্তবিকই দেরি করলেন না। দ্রুতই দিন তারিখ ঠিক হয়ে গেল। শ্রাবণ মাসের চব্বিশ তারিখ আমাদের পরমগম্ভীর মাস্টারসাহেব পিঁড়িতে বসবেন। সব রকম বন্দোবস্ত হল। চাচাজানও আয়োজনের চুড়ান্ত করলেন। রমিজদের বড়ো বাড়ির চারধারে দশদিন আগে থেকে রঙ্গিন বিদ্যুতবাতি ঝকমক করতে থাকলো আর এধারে ওধারে বিয়ের আমন্ত্রণ করতে যেতে যেতে প্রতিরাতেই আমার পা ফুলে উঠতে লাগল।
রমিজ আজকাল বেশ উন্মনা হয়ে উঠেছে। দিনভর চঞ্চল হৃদয়ে ঘুরে বেড়ায়। বুকে তার নববসন্তের উথাল হাওয়া। কনে নিয়ে কোন কথা উঠলেই আগ্রহে কান খাড়া করে রাখে। তারপর সবাই মুখ টিপে হাসছে বুঝে হঠাৎ সম্বিত পেয়ে মুখে আলগা অমনোযোগিতার ভান ফোটায়। যেন জগতে কোনকালে রেনু নামে কোন মেয়ের কথা সে শোনেনি এবং কোন রেনু নামের মেয়ের চুল লম্বা কী ঘন সে ব্যাপারে তার বিন্দুমাত্র আগ্রহ নেই।
আমি আশ্চর্য হই। নারী হৃদয়ের কী আশ্চর্য শক্তি। এহেন অভ্রভেদী গাম্ভীর্যকে ধুলিস্যাৎ করে প্রেমের জয়পতাকা উড়ালো এক পলকে। হ্যাঁ, যুবক শুধুমাত্র মুখটি দেখেছে এবং হৃদয়ের পরিচয় নেওয়ার সুযোগ পায়নি তা হয়ত সত্য। কিন্ত এও সত্য যে কেবল একটি নারীমুখ চির উদাসীন এই যুবাকে নাড়া দেয়নি। সেই মুখের ওপর তরুণীর হৃদয়ের সমস্ত সংগীত এক লহমায় ঝংকার তুলে গেছে। কাব্যপ্রেমিক যুবক তা চিনতে ভুল করেনি।
এ অঞ্চলে বিয়ের তিন চারদিন পূর্বে কনেবাড়িতে কিছু লোক যেতে হয়। চাচাজান আমাকেসহ আরও দু’চারজনকে দুদিন আগেই ঠিক করে দিলেন, বিয়ের আগের এই লৌকিকতাটুকু সেরে আসতে।
যাত্রার আগের দিন বিকেলে রমিজ গোপনে দেখা করে একটা কাগজে মোড়ানো বহুযত্ন কিছু একটা হাতে দিয়ে বললো, ‘জামিল, গোপনে কোনভাবে ওর কাছে পৌঁছাতে পারবি?’
যারপরনাই অবাক হয়ে শুধাই, ‘ কী এ?’
‘গোটাকয়েক চুড়ি।’ রমিজের চোখ মুখের রং পালটে গেল লজ্জায়।
হাসি চেপে বললাম, ‘ তা কায়দা করে সঁপে দিয়ে আসতে পারি বটে, কিন্তু বখশিসটাও ছাড়ছি না।’
রমিজ আলতো হেসে জবাব দেয়, ‘তথাস্তু।’
আমি কৌতুকময় চোখে তাকিয়ে থাকি। কিন্তু সব ঠিকঠাক হল না। সে কথা বিস্তারিত বলার কোন প্রয়োজন এবং ইচ্ছাও নেই, শুধু এটুকু জানলেই হবে, আমরা গিয়ে শুনলাম কনে অসুস্থ এবং দুদিন পর এক বিকেলে রমিজদের বড়োবাড়ির বারান্দায় বসে খবর পেলাম, ভরা বর্ষার বিষন্ন কোন সকালে রেনু নামের লাবণ্যলতাটি চিরকালের মতো ঢলে গেছে খুব নীরবে। সংসারের রূপ-রস-রঙ্গ চোখ মেলে দেখার আগেই সেই হৃদয় চুরিকরনেওয়ালা হৃদযন্ত্রের বৈকল্যের কাছে হার মেনেছে।
বাতি নিভে যায়, আনন্দ কলরব থেমে রয় সকরুণ নিস্তব্ধতায়। চাচাজান শূন্য চোখে বসে থাকেন। চাচিজানের মাতৃ হৃদয় না দেখা মেয়েটির জন্য একরাশ জল হয়ে ঝরে পড়ে। অদ্ভুত ফাঁকা ফাঁকা অনুভূতি হতে থাকে আমার। বুক ঠেলে জমাট বাঁধা কিছু একটা যেন উঠে আসে। সোনার মেয়েটি নেই!
আর রমিজ? রমিজ চুপ করে উঠে যায়। গ্রামের বহুদূরের প্রান্ত ঘেঁষে বয়ে গেছে সুবিশাল ব্রহ্মপুত্র। বহুক্ষণ হেঁটে হেঁটে সেখানে এসে পড়ে সে। ভরা নদী কুলকুল করে বইছে। রমিজ বসে, সাদা জল কলরবে ধাইছে চিরকাল। রমিজ চুপ করে শোনে। ঘন স্রোত অবারিত আকাশের নীচে সরে সরে যায়, রমিজ দেখে। তারপর কাগজে মোড়ানো চুড়িগুলো একে একে ডুবোজলে ছড়িয়ে দেয়। জলরাশি সরে যায়, বয়ে যায়, তারপর গোপন করে দেয় সেগুলো। রমিজ এইবার তাকায় আকাশের দিকে। তাকিয়েই থাকে। সে শূন্য দৃষ্টিতে ব্রহ্মপুত্রের জল থমকে যায়, দূর প্রান্তরের অগণন গাছেরা শাখা নাড়ায় সীমাহীন মাতমে। আর দু’পাড়ের অবারিত বাতাস হুহু করে বয়ে যায়, অন্তহীন দীর্ঘশ্বাসের মতো।
কপিরাইট © ২০১৭ - ২০২০ ।। বইদেশ-এ প্রকাশিত কোনও সংবাদ, কলাম, তথ্য, ছবি, কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না
Design & Development by: TeamWork BD