।। তামান্না স্মৃতি ।।
– ভাবি আজকেও সে এসেছে।
– তাই নাকি?
– ওই যে দেখেন রাস্তার ওইপাশে দাঁড়িয়ে আছে।
আইরিন জানালা দিয়ে উঁকি মেরে বলল, ঠিকই তো। এই ভরদুপুরেও এসে হাজির হয়েছে।
বুঝি না ভাবি, এই লোকের কোনো কাজকর্ম, চাকরি-বাকরি নেই নাকি। দেখে তো বেশ বড় ঘরের ছেলে বলে মনে হয়!
রেবা মুখ বাঁকিয়ে বলল, আমাদের তিলোত্তমার ভাগ্য বলতে পারেন। এমন অসুস্থতার পরেও ঘরে স্বামী, বাইরের প্রেমিক, দুজনেরই কত কেয়ার পাচ্ছে। আর আমার এমন ভাগ্য, তিলোত্তমার মতো এমন হার্টের অসুখ হলে বাইরের লোক তো দূরের কথা, নিজের স্বামীরও কেয়ার পাবো কি না সন্দেহ।
এবার আইরিন মুখে একটা অশ্লীল ভঙ্গি ফুটিয়ে বলল, আমার বাবা তিলোত্তমার মতো হৃদয় এত বড় নয়। এই হৃদয়ে শুধু স্বামীর ঠায় হয়, বাইরের কারো নয়। দুজন হো হো করে হেসে উঠলো।
পাশের ঘর থেকে তিলোত্তমার স্বামী অঙ্কুর, আইরিন আর রেবার পুরো কথোপকথনই শুনলো। তিলোত্তমা অসুস্থ হওয়ার কদিন পর থেকেই ওকে ঘিরে কিছু গুঞ্জন উড়োউড়োভাবে তার কানে আসছিল। যদিও সে নিজে কখনও কিছু টের পায়নি। তবে আজ আইরিন আর রেবার মুখে স্ত্রী সম্পর্কে এমন কুরুচিপূর্ণ ইঙ্গিত শোনার পর নিজেকে আর সে সামলাতে পারলো না। তাছাড়া কদিন থেকে সেও লোকটাকে খেয়াল করছে। তিলোত্তমা যখন হাসপাতালে ছিল তখনও তাকে দু‘একবার তিলোত্তমার কেবিনের সামনে দেখেছে। এভাবে নিজের অসুস্থ স্ত্রীর প্রতি একরাশ সন্দেহ নিয়ে দিন যাপন করার কোনো মানে হয় না। তাই অঙ্কুর আজ বাড়ির সামনে দাঁড়ানো লোকটার সামনাসামনি হবার সিদ্ধান্ত নিলো।
– কে আপনি?
জয় ভীষণ অস্বস্তিতে পড়ে গেল। এভাবে তিলোত্তমার স্বামীর মুখোমুখি তাকে যে কোনোদিন হতে হবে তা সে ঘুণাক্ষরেও ভাবেনি।
– কী হলো? আমার প্রশ্নের উত্তর দিচ্ছেন না যে? কে আপনি?
জয় মাথা নিচু করে বলল, আমি জয়। তিলোত্তমা আমার বোন হয়।
– কী যা তা বলছেন! দুইবোন ওরা, কোনো ভাই নেই। আসল পরিচয় দিন। তা না হলে আমি পুলিশে ইনফর্ম করতে বাধ্য হবো।
জয় মরিয়া হয়ে বলল, আমাকে বিশ্বাস করুন প্লিজ। আমার কোনো খারাপ উদ্দেশ্য নেই। আমি কোনো ক্ষতি করতে এখানে আসিনি।
– দেখুন ঘুরিয়ে-পেঁচিয়ে কথা বলে কোনো লাভ হবে না। যা বলার সোজাসুজি বলুন।
জয় বুঝলো আজ সে ধরা পড়ে গেছে। শুধু অঙ্কুরের নয়, তিলোত্তমার মুখোমুখিও তাকে হতে হবে। জয় অঙ্কুরের দিকে দিকে তাকিয়ে নরম গলায় বলল, আজ থেকে সতের বছর আগে সিঙ্গাপুরের একটা স্বনামধন্য হাসপাতালে তিলোত্তমার হার্ট ট্রান্সপ্লান্ট হয়েছিল। আর তিলোত্তমাকে হার্ট দিয়েছিল আমার জমজ বোন জয়িতা। তিলোত্তমা যে সময় হার্টের অসুখ নিয়ে সিঙ্গাপুরের হাসপাতালে ভর্তি ছিল, সেই সময় জয়িতার সিঙ্গাপুরে বেশ বড়সড় একটা এক্সিডেন্ট হয়। ডাক্তার সেই সময় অনেক চেষ্টা করেও জয়িতাকে বাঁচাতে পারেনি কিন্তু জয়িতার হার্ট তিলোত্তমাকে বাঁচিয়েছিল। এরপর থেকে আমার বাবা-মা নিয়মিত তিলোত্তমার সাথে, তিলোত্তমার পরিবারের সাথে যোগাযোগ রাখতেন। আপনাদের বিয়েতেও তারা এসেছিলেন। আমি অবশ্য কোনোদিন তিলোত্তমার মুখোমুখি হইনি। কেমন যেন অভিমান হত আমার! মনে হতো তিলোত্তমা যেন আমার একটা অংশ কেড়ে নিয়েছে! কিন্তু গতবছর দুই মাসের ব্যবধানে যখন বাবা-মা দুজনই মারা গেলেন তখন এই পৃথিবীতে আমার আপন বলে কেউ রইলো না। আমি এতিম হয়ে গেলাম। মনে হলো, এই পৃথিবীতে আমার রক্তের সম্পর্কের কেউ নেই। ওই কষ্টের সময়গুলোতে তিলোত্তমার কথা খুব মনে পড়তো। মনে হতো, আমি ভুল ভাবছি। আমি তো একদম একা নই। অন্তত আমার একটা অংশ এই পৃথিবীতে আছে। তাই…
জয় হয়তো অঙ্কুরকে আরও কিছু বলতে চেয়েছিল। কিন্তু অঙ্কুর তাকে কথার মাঝে থামিয়ে দিল। তারপর জয়ের একটা হাত ধরে নরম গলায় বলল, বাসায় চলুন। আজ তিলোত্তমার সাথে দেখা করবেন। আপনার বোনের সাথে দেখা করবেন।
গত এক মিনিট ধরে আইরিন আর রেবার মুখটা বিস্ময়ে হাঁ হয়ে আছে। আর একটু হলে বোধহয় তাদের মুখে বেশ বড়সড় আকারের একটা মাছি ঢুকবে। এ-ও কী সম্ভব! একটু আগে তাদের চোখের সামনে দিয়ে তিলোত্তমার স্বামী নিজের স্ত্রীর প্রেমিককে নিয়ে তাদের বেডরুমে ঢুকলো। এখন আইরিন আর রেবাও তিলোত্তমাদের বেডরুমে উঁকি দিয়ে দেখতে খুব ইচ্ছে করছে, বেডরুমের ভেতরে আসলে কী চলছে, কিন্তু কোনো উপায় নেই। কেননা বেডরুমে ঢোকার আগের মুহূর্তে অঙ্কুর তাদের রাস্তা মাপতে বলে গেছে, মানে হাসিমুখে বলে গেছে, আপনারা এবার আসতে পারেন।
কপিরাইট © ২০১৭ - ২০২০ ।। বইদেশ-এ প্রকাশিত কোনও সংবাদ, কলাম, তথ্য, ছবি, কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না
Design & Development by: TeamWork BD