।। বিক্রমাদিত্য ।।
শুক আমাকে হুঁশিয়ার করেই চলেছে সুবিনয়ের ব্যাপারে। আমি ধৈর্য হারিয়ে ওকে বকা দিলাম। কেন রে বাপু, এতবার বলতে হচ্ছে কেন? আমি নিজে তো চোখের ওপর দেখতে পাচ্ছি এই সুবিনয় আমার আরাধ্য নয়। আরাধ্যের ধারে কাছে কেউ নয়, কিছু নয় সে। না আমি মন্দ বলছি না ছেলেটাকে। সবই ঠিক আছে। সব ঠিকই আছে। তবুও ঠিক আমার সাথে যাচ্ছে না। সবকিছুর পরও আমার আরাধ্য তো সে নয়। তাই না?
এক যুগ হলো আরাধ্যকে দেখি আমি প্রায় রাতে। ঘুমানোর আগে আরশি আমায় দেখাত। তারপর এখন ঘুমিয়ে দেখি স্বপ্নে। দু’জনেরই অভ্যাস হয়ে গেছিল এভাবে দেখা করার। অনেকদিন বাদে আরশিকে আবার দেখাতে বলেছি, সুবিনয় আর আরাধ্যকে পাশাপাশি মেলানোর জন্য। আরশি আমাকে আরেকবার আশ্বস্ত করেছে, দুইটা মানুষ কোনো দিক থেকেই এক নয়। তার পরপরই স্বপ্নে একবার ডেকেছি সুবিনয়কে। আরাধ্য রাগ করবে না জানতাম। আরাধ্য সেরকম মানুষ নয়। তাছাড়া একটা রাতের জন্যই তো। সুবিনয় অবশ্য ঘাবড়ে গিয়েছিল। স্বপ্নে যাতায়াতের অভিজ্ঞতা ছিল না বোধ হয়। আমি দু’জনকেই খুব খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখলাম। নাহ, আমার আরাধ্য সব দিক থেকেই অন্যরকম। চলন-বলন সব আলাদা।
অন্যান্য দিন আরাধ্য টাংস্টেনের জাদু আলোতে আরাম কেদারায় বসে আলোচনা করত, সে কী পড়ল কী লিখল সেসব নিয়ে। মেঝেয় বসে তার কোলে মাথা রেখে সেসব শুনতাম গভীর মনোযোগে। সম্ভবত তার একমাত্র শ্রোতা। সেই রাতে পড়ালেখার আলাপ ছেড়ে, প্রথম সাক্ষাতে সুবিনয়ের আমাকে বলা একটা কথা নিয়ে আরাধ্যের সাথে ওর দ্বন্দ্ব তৈরির চেষ্টা করেছিলাম। সুবিনয় কথায় পারলই না তার সাথে। যুক্তি-উদাহরণ দিয়ে মিষ্টি ভাষায় তাকে একরকম ভাসিয়ে দিল আমার আরাধ্য। ছেলেটার গোবেচারা অবস্থা দেখে বাধ্য হলাম আরাধ্যকে থামাতে। যদিও ভেতরে ভেতরে খুশিই হয়েছিলাম। কে জানে কিছুটা হয়তো অহংকার হয়েছিল। সুবিনয় ওকে পছন্দ করেনি মনে হলো। তর্কে না পারলে পছন্দ না করাই স্বাভাবিক। এমনকি আমি যখন ছল করে সুবিনয়ের পক্ষ নিলাম তখনও কি আরাধ্যকেই বেশি আপন দেখাল না আমার?
‘অতএব এই ছেলে কোনদিনও আমার নয়।’ চুল আঁচড়াতে আঁচড়াতে শুককে বলি, ‘তাহলে তিন বেলা এক গীত কেন গাইছিস হতভাগা?’
শুকটা খুব তর্ক শিখেছে, ‘তুমি তো গেল দুইবার আমার নিষেধ মানোনি। পইপই করে বলেছিলাম, যেও না, কষ্ট পাবে। শুনেছিলে? একটা টিকল ছয় বছর। পরেরটা ছয় মাসের মাথায় ভেঙে গেল। টানা ছয় সপ্তাহ মেঘ সরলো না মহলের ওপর থেকে। আমি তো ভেবেছিলাম এর কোনো থামাথামি নাই।’
‘থাম তো তুই। তখন ছেলেমানুষ ছিলাম। আর তাছাড়া ওকে দেখতেও আরাধ্যের মতো ছিল। কী আরশি, তুই বল, ছিল না? সুবিনয় তো সেদিক থেকে একেবারেই বিপরীত।’
‘প্রথমজনের কথা বলছ না হয় আরাধ্যের মতো দেখতে। আর পরের জন? তিন বছরের মাথায় যে আরেকজনের হাত ধরলে? তার তো কোনো মিলই ছিল না। তখনও বলেছিলাম, কানে নেওনি। সে নিয়ে তো আরশিকে দোষ দিতে পারবে না। দুই বর্ষা মুখে দানাপানি তোলনি তারপর। আমার কথা শুনতে যদি-’
‘আচ্ছা বাবা ভুল করেছি। ভুল করেছি শিক্ষাও হয়েছে। হয়নি? তোরাই তো খুশি হয়েছিস সবচেয়ে বেশি।’ আমি চিরুনিটা জলের ওপর ছেড়ে দিলাম, ‘ঘ্যান ঘ্যান করিস না আর।’
শুক দুলতে দুলতে বলল, যাক্ বুঝেছ তাহলে। আজ চন্দন দিও না। কাল দিও। আর শোনো, সে আসবে একটু পর।
‘কী বলিস? সুবিনয়? আজ?’
‘হ্যাঁ। দুপুরবেলা। বারান্দার নিচে দাঁড়াবে। হাতে থাকবে দোলনচাঁপা।’
মনটা হঠাৎ দমে গেল সুবিনয়ের জন্য। আহারে বেচারা। ওকে বোধ হয় আমার সবকিছু বুঝিয়ে বলা উচিত। এভাবে কতদিন? আজই বলব। আসলে বিষয়টা ভালো লাগছিল না একদমই। কষ্টও পাচ্ছিলাম একটু একটু। আমি যদি সরাসরি নিষেধ না করি তাহলে সে আসতেই থাকবে। সেটা ভালো হবে না। আমাদের কারো জন্যই ভালো হবে না।
‘উঁহু উঁহু। আজ তুমি ওর সামনে যেও না। সমীরণকে দিয়ে চিঠি ধরিয়ে দিও। লিখো যে তুমি ঘরে নাই।’
‘বেশ-’
শুক বলেছিল আজ উত্তর মহলে না যেতে। আমি এদিকটাতেই খাওয়ার আয়োজন সারলাম। পিঁপড়ার সারি ফিরে গেলে সব ধুয়ে মুছে আলসে ভঙ্গিতে বিছানায় গা এলিয়ে দিলাম। রোদটাকে মৃদু করে মনের ভেতর থেকে আমার আঁকা আরাধ্যের ছবিটা বের করে একমনে দেখতে লাগলাম। ধীর আঙুল বোলাতে বোলাতে অভিমান ভরে বললাম, ‘কত জনা এসে বন্ধ দুয়ার পেয়ে ফিরে গেল। তুমি আসবে কবে আরাধ্য?’ এ ঘরে অন্য কেউ থাকলে লজ্জা পেতাম এভাবে কথা বলতে। সমীরণটা সবসময়ই ঝুঁকে থাকে আমার ওপর। কিন্তু ওকে লজ্জা করে না। কথা বলতে পারে না তো, তাই বোধ হয়। সে যে আছে, মনেই থাকে না। ওর সাথেও কথা বলি মাঝে মাঝে। একমনে বলতে পারি কতকিছু উত্তরের আশ ছাড়াই।
‘আমার তোমাকেই চাই। তুমি আসো না। বারো বর্ষা গেল প্রথম তোমাকে দেখার। কত খুঁজলাম তোমাকে। তুমি সামনে এলে না একদিনও। কোথায় খুঁজতে বাকি রেখেছি বলো। শুধু কি স্বপ্নেই আসবে এক-দুই পক্ষ পরপর? আচ্ছা তাও এসো। সামনেও এসো যখন ইচ্ছা হবে। আমি অপেক্ষা করব আরাধ্য। তোমাকে চিনেছি বলে আর সবাইকে আমার অচেনা লাগে এখন।’
কথার মধ্যে সমীরণ দোয়াত কলম ঠেলে দিল। ওহ্, আমি ভুলে গেছিলাম চিঠির কথা। লিখলাম, ‘বাড়ি নাই। কবে আসব জানি না। ইতি আমি।’
বলে দিলাম নিচ থেকে দোরঘণ্টি বাজালেই যেন এটা দিয়ে আসা হয়। আরাধ্যকে ঢুকিয়ে রাখলাম। দুপুর গড়াতে চলল। ছাদে যাব ঝাড়গুলো দেখতে। সুবিনয় ছেলেটা এখনো এলো না তো। তবে আসবে নির্ঘাত। আমার শুক ভুল বলে না কখনো। মিথ্যা চিঠিটা কি দিব সুবিনয়কে? বোধ হয় আরেকটু খোলাসা করেই বলা উচিত ছিল যে, সে আমার জন্য নয়। সে নিজেও সুখী হবে না কখনো। আমার সাথে আর কেউ সুখী হবে না কখনো। কিন্তু শুক এসব কথা পরে বলতে বলেছে। তাছাড়া আমারও সমস্ত ইন্দ্রিয় নিষেধ করছিল ওর সাথে আজ দেখা করতে।
সর্বনাশের দোরঘণ্টি বাজল তখনি। সমীরণ টের পেল কি না কে জানে। আমি কী ভেবে বারান্দায় গিয়ে দাঁড়ালাম। ঝালরের আড়াল থেকে চাইলাম। রোদ পড়ে গেছে আজ তাড়াতাড়ি। সবুজ পাঞ্জাবি গায়ে চোখ মুখ কুঁচকে সুবিনয় ওপর দিকে তাকিয়ে আছে। হাতে ধরা দোলনচাঁপা। আমার আরাধ্য সে না। আমি বুঝতে পারছি আমার আরাধ্য সে নয়। নাহ্ আজ তাকে কিছু বলব না। মন জানে আজ আমাদের কথা হওয়াটা বিশাল ভুল হবে। সমীরণ চিঠিটা দিল ওর হাতে। সুবিনয় পড়ল। আরেকটাবার ওপর দিকে তাকিয়ে ঘাড় নামিয়ে উলটো পথে পা বাড়াল। চলে যাক। এই মঙ্গল। আমার বুকের ভেতর কোনো এক অজানা কারণে হু হু করছিল। কিন্তু আমি জানি এটা সাময়িক। আজ দুপুরে এই মুহূর্তের কষ্টকে প্রশ্রয় দিলে এরকম আরও সহস্রদিনের কষ্ট সহস্র রাতের কান্নাকে বরণ করতে হবে। না আমি যাব না।
আরশি খসে পড়েছিল সিঁড়ির ওপর। মন বারণ করছিল। শুক ডানা ঝটপটিয়ে চিৎকার করছিল। বোবা সমীরণ জোরাল অশনি সংকেত জানানর আপ্রাণ চেষ্টা করছিল।
আমি শত প্রহরী ঠেলে সরিয়ে পথে নামলাম, ‘সুবিনয়, দাঁড়াও।’
কপিরাইট © ২০১৭ - ২০২০ ।। বইদেশ-এ প্রকাশিত কোনও সংবাদ, কলাম, তথ্য, ছবি, কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না
Design & Development by: TeamWork BD