সিফার চাঁন রাত্রি
।। অনুপমা চক্রবর্তী ।।
পশ্চিম আকাশে কবে উঠবে রমজানের চাঁদ!
ভাবতে ভাবতে যেন বছর ঘুরেই ফিরলো আবার পবিত্র মাহে রমজান। আট বছরের ছোট্ট কিশোরী সিফার বুকটা আকুলভাবে আনচান করে ওঠে। ঈদ নিয়ে যে চলছে তার মনে নানা গুঞ্জন। আর ঠিকই তো, ঈদের মানসিক প্রস্তুতি শুরু হয় সেই প্রথম রোজা থেকে। সেই রোজা রাখবে সে এবার পুরোটা মাসজুড়ে। শুধু তাই নয়। স্কুলের বন্ধুদের সাথে প্রতিযোগিতায় নেমেছে সে, কে কয়টা রোজা রাখতে পারে তা নিয়ে।
সিফার বাবা কলিম উদ্দিন একজন দরিদ্র গ্রামীণ কৃষক। ছোট্ট একখানা জমি আর বসবাসের ঘর তাদের। যেখানে হালচাষ করে কোনোরকমে সংসার চলে। আর বাড়িতে নিজস্ব দুটি গাভি আছে যার দুধ বিক্রি করে চলে সিফার পড়াশোনাসহ বাকি অন্যান্য খরচ। সিফার মা হাশেমা খাতুন অত্যন্ত ধর্মপ্রাণ এবং অশিক্ষিত হলেও একজন বুদ্ধিমতি নারী, যে কি না জানে স্বল্প খরচেও সংসারের নানাদিক সামলে সন্তানের মনের ছোট ছোট স্বপ্নগুলোকে পূরণ করতে। আবার ধর্মীয় রীতিনীতি শিক্ষাসহ সামাজিক জীবনের আদর্শ ও প্রয়োজনীয় নীতিবোধকেও শক্ত অবস্থানে রেখে সন্তান প্রতিপালনে সে বেশ দক্ষ ও কৌশলী। যার দৃষ্টান্ত সিফার চারিত্রিক বৈশিষ্ট্যে সুস্পষ্টভাবে ফুটে ওঠে। পরিবারে আরেকজন বড় সদস্য আছে মেয়েটির। সে হলো তার ছোট্ট ভাই বিজু। বয়স তার পাঁচ হলেও বোনের সাথে নানাকাজে খুঁনসুটিতে কখনো কখনো সে একুশও ছাড়িয়ে যায়। যদিও বন্ধুদের সাথে বোনকে দেখলে তার কলিজায় প্রাণ যেন একেবারেই থাকতে চায় না। বিন্দুমাত্র সময় নষ্ট না করে দ্রুত গিয়ে ছোট কোলটি আঁকড়ে বসে, অনড় অবস্থান নেয়।
ছোটবেলা থেকে দেখে এসেছে সিফা, বড়রা পুরো রমজান মাসে রোজা রেখে আখেরাতে তার সওয়াবের পাল্লা ভারী করার জন্য যথাসম্ভব নামাজ-দোয়া করে। ইবাদতে ব্যস্ত থাকে। তাই মেয়েটিও অতি অল্প বয়স থেকেই তার ঈদের আনন্দকে আরও অর্থবহ করতে ও সওয়াবের পাল্লা ভারী করতে চেষ্টা চালিয়ে যায় রোজা রাখার। এ ব্যাপারে আত্মপ্রতিশ্রুতিতে টিকে থাকতে তার বাবা-মা তাকে সহযোগিতা করে।
প্রথম বছরে প্রথম রোজা রাখে। দ্বিতীয় বছরে প্রথমসহ, সাতাশ এবং শেষ রোজাটা। এভাবে ক্রমান্বয়ে যোগ হয় শুক্রবারের রোজাও। কিন্তু, এবার যে তার গুণে গুণে পুরো মাস রোজা রাখার প্রতিযোগিতা। এভাবে চলতে থাকে সিফার মনে মাসব্যাপী রোজা পালন ও ইবাদতের পাশাপাশি ঈদ আয়োজন নিয়ে নানা পরিকল্পনা। এছাড়াও একটি ভিন্ন আনন্দে এ সময় মেয়েটির মন আরও মেতে উঠতো। সেটা সকলের কাছে অত্যন্ত ক্ষুদ্র বলে মনে হলেও সিফার শিশু মনে ভীষণ উত্তেজনাপূর্ণ সময় বলা চলে।
রমজান মাস শুরু হলে সেই প্রথম রোজা থেকে গ্রামের দাদী, ফুপু, চাচিরা সময় পেলে বসে যায় ‘চুটকি পিঠা’ বানাতে মা হাশেমার সাথে। কেননা, ঈদের দিনে খাবার তালিকার একটা বড় অংশ জুড়ে থাকবে এই হাতে তৈরি পিঠা। তাই গল্প গুজবের ফাঁকে ফাঁকে পুরো রোজার মাস অল্প অল্প করে হাতে দু’আঙ্গুলে পিষে পিষে নিপুণভাবে তৈরি করা হয় পিঠা এবং ঈদের দিন সকালে দুধ ও চিনির মিশ্রণে ভিজে তা হয়ে ওঠে বেশ মজাদার এক ধরনের সুস্বাদু খাবার। যদিও বর্তমান যন্ত্রের যুগে কলের সেমাই, লাচ্ছা সেমাই শহরগুলোতে হাতে তৈরি পিঠার কদর একেবারে ম্লান করে দিয়েছে। তবুও এখনও গ্রামীণ মানুষ দারিদ্র থাকা সত্ত্বেও তাদের এ ঐতিহ্য থেকে বের হয়ে আসতে পারেনি।
ঈদে সিফার আরেকটি পছন্দের উল্লেখ্যযোগ্য পিঠা হলো ‘ছেঁই পিঠা’, যা নিয়েও মেয়েটির আনন্দের সীমা থাকতো না। কারণ এ পিঠা তৈরির পদ্ধতি ছিল খুবই উপভোগ্য। চালের গুড়া সিদ্ধ করে লতা বানিয়ে হাতের তালু দিয়ে ঘষে ঘষে এ পিঠা বানানো হতো রমজান মাসের মাঝামাঝি সময় থেকে। মজার বিষয়, এর আয়োজন হতো একেকদিন একেক ঘরে। প্রতিবেশি মহিলারা এগিয়ে আসতো নিজে থেকে এ পিঠা বানানোতে সাহায্য করতে। সবাই গোল হয়ে বসতো বেলুন-পিড়া নিয়ে। এ অপূর্ব দৃশ্যের মুগ্ধতায় আটবছর বয়সী কিশোরী বালিকা সিফা নিজের বয়সের সীমা ছাড়িয়ে বসে পড়তো মা, চাচি ও ফুপুদের সাথে। মেয়েটির কাছে এ সবমিলিয়েই যেন ঈদের আনন্দ। তাই পবিত্র মাহে রমজানের আগের দিনের চাঁন রাত থেকে ঈদের আগের দিনের চাঁন রাত পর্যন্ত তার ছোট্ট মনের কল্পনায় বরাবর চলতো খুব বড়োসড়ো এক ঈদ আয়োজন।
তবে বাস্তবিক প্রেক্ষাপট এবার একটু ভিন্ন। অন্যবারের মতো সিফার বহু আকাঙ্ক্ষিত রমজান মাস শুরু হলেও আনন্দের পরিসরটা যেন সীমাবদ্ধতায় ঘেরা। তাই অনেককিছু ফিকে হয়ে মেয়েটির শিশু মনের উদ্যমতাকে নানা সময়ে বাঁধ দিয়ে ফেলতো। মাত্র কয়েকদিন হলো একটা আকস্মিক ঘূর্ণিঝড়ে সিফাদের বাড়িঘর এবং আবাদি জমি পুরো লণ্ডভণ্ড হয়ে গেছে। শুধু তাই নয়, যে দুটো গাভীর ওপর নির্ভর করে হাশেমা তার মেয়েকে পড়াশোনা এবং অন্যান্য যোগান দিয়ে বেশ পরিপূর্ণতার সাথে বড় করে তুলছিল তা আজ গভীর অন্ধকারে যাবার পথে। ঘটে যাওয়া প্রাকৃতিক দুর্যোগে তাদের একটি গাভী মারা যায় এবং আরেকটিও ভীষণভাবে আহত হয়। তাই না বুঝে উপায় নেই, এবারের ঈদ সিফার জীবনে তার বিগত বছরের অতীত স্মৃতিকে মুছে নতুন কিছু আনতে চলেছে। তবে এতটুকুই বা বোঝার বয়স কোথায় সেই কিশোরী মেয়ে সিফার!
দুপুর গড়িয়ে বিকেল হলো। সারাদিন রোজা রেখে সিফার বাবা হাট শেষ করে বাড়ি ফিরে এলো। নিজের জমিতে হাশেমা কিছু সবজির চাষ করেছিল, যা থেকে খুব একটা ভালো ফলন না হলেও তার মধ্য থেকেই কিছুটা তুলে কলিম উদ্দিনকে পাঠিয়েছিল আজ হাটে। রমজান মাস, ঘরের অবস্থাও ভালো না। কেমন করে যে দিন চলবে তারও নির্দিষ্ট কোনো ব্যবস্থা হয়নি। তাছাড়া সারাদিন রোজা রেখে কিছু তো একটা মুখে দিতে হবে। তাই নিরুপায় হয়ে আজ দরিদ্র কৃষক বসেছিল হাটে, সবজি বিক্রি করতে। তবে প্রথম রোজায় সবাইকে সংযমতায় আসতে নিজের সাথে একটু মানিয়ে নিতে হয়। এজন্য বোধহয় ক্লান্তিবোধটা একটু বেশি চলে এসেছে। কিন্তু সেহেরি থেকে শুরু করে রোজা রাখা, রোজা ভাঙ্গা, ইফতারের আয়োজন, সকলের একত্রিত সমাবেশে তারাবিহ নামাজ পড়া, শুক্রবারের জুম্মার নামাজ কায়েম সবমিলিয়ে যে ধীরে ধীরে পুরো মাসটাই আয়ত্ত করে মাসব্যাপী এক ধর্মীয় উৎসবের মিলনমেলা উপভোগ করে সবাই- তা নিয়ে কোথাও কোনো সংশয় না থাকলেও দরিদ্র গ্রামীণ পরিবারের কাছে যেখানে জীবনের প্রতিটি ক্ষণ কঠিন বাস্তবতার যাতাকলে নিষ্পেষিত সেখানে উৎসব, রীতিনীতি প্রতিপালন এসব তীব্র সংকটাপন্ন অবস্থা ছাড়া আর কিছুই নয়। তাই ইচ্ছা থাকলেও অনেক কিছু করার সামর্থ্য হয়ে ওঠেনি এবার সিফার মা হাশেমার। কোনোমতে দিন পার করে রমজান মাসটা গেলে যেন তার সন্তুষ্টি।
খুব একটা সুবিধে করতে না পেরে সিফার বাবা কিছুটা সবজি বিক্রি করে ছোলা, গুড়, তেল আর বিজুর জন্য কলা কিনে বাড়ি ফিরে এলো। মেয়েটি মায়ের মতো বুদ্ধিমতি ছিল বলে বাবা-মায়ের কষ্ট না বলার আগে অনেক সময় বুঝে নিতো। অবস্থা মেনে নিজেকে মানিয়ে নেয়ার ক্ষেত্রেও বেশ পারদর্শিতা দেখাতো। কিন্তু বিজু ছোট। তাই তাকে নিয়ে হাশেমাকে পড়তে হতো নানা ঝামেলায়। একদিকে দুর্যোগপূর্ণ সংসার তারপর সামনে ঈদ। এসব নানা চিন্তায় সিফার মা যখন নিজেকে সারাক্ষণ গুটিয়ে রাখতো তখন আট বছরের মেয়েটির মায়াভরা শান্ত্বনায় নিজেকে বারবার উত্তর না জানা প্রশ্নে জড়াতো সে। তবুও যে চিরায়ত বাঙালি নারীর চরিত্র, শত বাঁধা আসলেও সাবলিলভাবে নিজেকে সবকিছু দিয়ে সংসার আগলে রাখতে হয়। হাল ধরতে হয় কঠিন থেকে কঠিনতর ঝড় মোকাবেলায়। দৃশ্যত, এখানেও তার ব্যতিক্রম হয়নি।
সিফার বাবা ঘাট থেকে গোসল করে এসে আঙিনায় বসেছে। ছেলেমেয়েরা খুব শান্তভাবে বসে একদৃষ্টিতে মায়ের ইফতার সাজানোর কলাকৌশল দেখছে মুগ্ধ দৃষ্টিতে। না, এ ইফতারের আয়োজন ধনীদের নানা মুখোরোচক খাবারের পসরা নয়। এখানে সারি সারি আলোর ঝলকানিতে নানা ধরনের সুগন্ধি খাবারের ঘ্রাণও ছুটছে না। কোনোমতে রোজা ভাঙার ব্যবস্থা। সাথে দেহেরও যাতে কিছুটা ক্লান্তি লাঘব হয়, তা নিয়েই এই দরিদ্র গ্রামীণ পরিবারের আজ ইফতার আয়োজন। মাটির পাত্রে চিড়া ভেজানো হয়েছে যাতে গুঁড় দিয়ে কোনোভাবে চলে যাবে তাদের প্রথম রোজা। শুধু বিজুর পাত্রে আধাটা কলা দেখা যাচ্ছে। সিফার পাত্রেও বাকি অর্ধেকটা পড়েছিল। কিন্তু, তার ছোট্ট মনটা চাচ্ছে কলাটুকু বাবার পাত্রে তুলে দিতে। বাবা সারাদিন কষ্ট করে ফিরেছে, তাই কলাটুকু বাবার খাওয়া উচিত। সে মাকে অনুরোধ করে বুঝিয়ে তা বাবার পাত্রে তুলে দেয়। ছোট হোক বা বড়, মেয়েরা যে মায়ের জাত, সেটা সহজাতগত বৈশিষ্ট্য হিসেবে পুনরায় একবার প্রমাণ করে সিফা।
যথাসময়ে ইফতার শেষ করে বাবার সাথে বিজু গেল আজগর চাচার দোকানে। সেখানে ইফতার শেষে নামাজ পড়ে লোকজনের একটা চায়ের আড্ডা বসে। কলিমউদ্দিনও বসে সেখানে । আর যখন ব্যস্ত হয় গল্পে, তখন বিজু গিয়ে দোকানের ভেতরে ঢুকে ঠিক দোকানদার আজগর চাচার কোলে চড়ে বসে। তাতেও যেন তার স্থিরতা নেই। যতজন আসছে সবার কাছে তাকে কিছু না কিছু তো বিক্রি করতেই হবে। সে যে পাক্কা দোকানদার সেজে বসে আছে। এদিকে আজগর দোকানদারের নিজের কোনো সন্তান না থাকায় কলিমউদ্দিনের দুটো সন্তানকেই তারা খুব ভালোবাসতো স্বামী-স্ত্রী দুজনে মিলে। থাকতোও সবসময় এ দুটি পরিবার সুখে-দুখে পাশাপাশি। তাই বিজুর অত্যাচারে মোটেও বিরক্ত না হয়ে বরং আরও আদরে আগলে রাখতো তার আজগর চাচা। যদিও একদিক দিয়ে বেশ ভালো বেচাকেনা চলছিল দোকানদারের। কারণ, পাঁচ বছরের অমন নয়নকাড়া মায়া বিজড়িত ছেলে বিজুর হাত ফিরিয়ে দেয়ার সামর্থ্য হয়ে উঠতে পারতো না কখনও কারোর। তবে দোকানদার চাচাও অবিবেচক ছিল না। তারাবির আগে কলিমউদ্দিন যখন ছেলেকে নিয়ে বাড়িতে যায় তখন নিত্য ব্যবহারের অনেক সামগ্রী বিজুর হাতে গুঁজে দেয় অতি স্নেহে। তাতে থাকে কিছু খাবার এবং অন্যান্য আরও নিত্য প্রয়োজনীয় গৃহসামগ্রী, যা তাদের কাজে লাগবে। সিফার বাবা না নিতে চাইলেও জোরপূর্বক তাকে নিতে হতো বন্ধুত্বের খাতিরে। তবে, তারাবির আগ পর্যন্ত ছোট্ট বালকটি থাকতো বেশ ব্যস্ত তার এ সকল বেচাকেনা নিয়ে।
এদিকে মায়ের সাথে ঘরের কাজে সাহায্যের পাশাপাশি তারাবির নামাজ শেষ করে উঠানে ভাইকে নিয়ে খেলায় ব্যস্ত হয় সিফা। আর মা হাশেমা বসে পাশের বাড়ির রুহিসনের (আজগর দোকানদারের স্ত্রী) সাথে কাঁথা বুনন নিয়ে। সংসারের সকল কাজ শেষ করার পরও নিঃসন্তান ছিল বলে সময় কাঁটতে চাইতো না আজগরের স্ত্রীর। নানাভাবে সে হাশেমার সাথে সঙ্গ নিতে তার বাড়িতে আসতো। কখনো পিঠা বানানোর ছলে, কখনো বা অন্য কাজে, আবার কখনো ছেলেমেয়েদের সাথে গল্প করতে। রুহিসন বেশ ভালো গল্প বলতে জানতো। তাই সে যখন বাচ্চা দুটিকে নিয়ে গল্পে বসতো, ঘণ্টার পর ঘণ্টা পার হয়ে গেলেও তারা শেষ করতে চাইতো না তাদের চাচির মজার মজার সব গল্প। এদিকে হাশেমা সংসারের অনেক কাজ সেরে ফেলতো সে সুযোগে। শুধু তাই নয়, যেহেতু সিফাদের বাড়ির অবস্থা ভালো ছিল না তাই আজগরের মতো রুহিসনও নানা অজুহাতে তাদের সাহায্য করতো এবং চিন্তা করতো কীভাবে তাদের দিন ফেরানো যায়।
একবার কারুকাজের হাত বেশ পাঁকা থাকায় বিসিক থেকে অনেকগুলো নকশিকাঁথার বায়না পেয়েছিল আজগরের স্ত্রী। যেহেতু সিফা-বিজুর ঈদ আনন্দ নিয়ে তারও চিন্তার কোনো সীমা ছিল না, তাই স্বামীকে নিয়ে রোজার আগে আবার একবার বিসিকের অফিস থেকে বেশ বড় রকমের একটা বায়না নিয়ে আসে সে। এরপর হাশেমাকে হাতে ধরে কাজ শেখায় এবং দুজনে মিলে পুরোদমে শুরু করে কাঁথা বুননের কাজ। মাঝেমধ্যে পাড়ার অন্য মহিলারাও এসে তাতে হাত লাগায়। সিফাও তার প্রতিবেশি বন্ধুদের সাথে নিয়ে মা-চাচির মতো নানা সৃজনশীল কাজে নিজেকে গড়ে তোলার চেষ্টায় ব্যস্ত থাকতে পছন্দ করতো। কখনো গাছের পরিচর্যা আবার কখনো নিজেদের মতো করে পিঠা বানাতে বসা আবার কখনো মা-চাচির হাতের লাঠি হয়ে নানা কাজ সামলানো। বলতে গেলে আট বছরের কিশোরী বালিকা একজন পরিপূর্ণ নারীর মতো বিচক্ষণ, কর্মী। আর বিজু তো আছেই, তাকে ছাড়লে কি আর রক্ষা আছে! কেউ আর কোনো কাজ করতে পারবে না।
এভাবে দিন যেতে যেতে ঈদ এলো বলে… নানা স্বপ্নে বিভোর সিফা মাকে একদিন মুখ ফসকে বলে বসলো, একটা লাল জামার ইচ্ছার কথা। সাথে একটা মেহেদির টিউব। আর বেশি কিছু ছিল না তার আবদারের ঝুলিতে। আকস্মিক অভাবের সংসারে একমাত্র মেয়ের এতটুকু আশা মেটানোও যেন দরিদ্র হাশেমার কাছে ভীষণ লজ্জার হয়ে দাঁড়ালো। কারণ, ঘটে যাওয়া প্রাকৃতিক দুর্যোগে ক্ষতির বেগটা এখনও তার পরিবার পুরোপুরি সামলে উঠতে পারেনি। কোনোভাবে এদিক-সেদিক করে যাচ্ছে রমজান মাসটি। তবুও মেয়ের কোনো ইচ্ছা সে এতদিন অপূর্ণ রাখেনি। তাই হাসিমুখে বরাবরের মতো এবারও মেয়ের কপালে একটা লম্বা চুমু দিয়ে রাজি হয়ে গেল হাশেমা তার ইচ্ছা পূরণে।
কিন্তু পরবর্তীতে বুদ্ধিমতি সিফা অভাবের সংসারে মায়ের একের পর এক সংগ্রাম দেখে নিজের ঐ ছোট্ট বুকটাকে ভীষণ কষ্টে শক্ত করে বেঁধে নেয়। শুধু কি তাই, নিজের স্বপ্নকে ভুলে গিয়ে সে ব্যস্ত হয় ছোট ভাই বিজু ঈদে কী পড়বে তা নিয়ে! পরিবারের আর্থিক সংকট দেখে অনেক ভেবেও সে কোনো উপায় খুঁজে পায় না। এরপর একদিন মা যখন ঘাটে যায় গোসল করতে, সেই ফাঁকে সিফা ট্রাঙ্ক থেকে একটি গজ কাপড়ের ভাঁজ করা খণ্ড বের করে বিজুকে নিয়ে বাড়ি থেকে বেরিয়ে যায়। একবার স্কুল থেকে দৌড় প্রতিযোগিতায় অংশগ্রহণ করে সিফা জামা বানানোর এই গজ কাপড়টুকু উপহার হিসেবে পেয়েছিল। এবার ঈদে এটাও তার বানানোর কথা। কিন্তু, মেয়েটি আগেই টের পেয়েছিল প্রতিবারের মতো এবারের ঈদ তাদের হবে না। লাল জামা অনেক দূরের কথা, হয়তো কোনোমতে পিঠার যোগান দিতে পারবে তাদের মা, এর বেশি আর কিছু নয়। তাই অনেক ভেবে বিনা টাকায় বিজুর জন্য একটি পাঞ্জাবি বানিয়ে দিতে পাড়ার এক দর্জিকে রাজি করায় সিফা। আর যেহেতু মা হাশেমা জানলে কিছুতেই মেয়েটির ঈদের এই শেষ সম্বলটুকু ছাড়তে দিবে না, তাই এই প্রথম কিছু না বলে ছোট ভাইকে সঙ্গে নিয়ে সে বাড়ির বাইরে গেল।
ঈদের বাকি আর ঠিক তিনদিন। সিফা বুঝতে পারলো এখনও মা চেষ্টা করছে তার স্বপ্নপূরণ করতে। তাই সে ছোট ছোট দুটি হাত দিয়ে মার গলাটি জড়িয়ে ধরে অনুরোধ করে বলল, এবার ঈদে সে কিছু চায় না। মা যেন তাকে নিয়ে আর বেশি চিন্তা না করে।
মেয়ের এমন অনুরোধে এবার চোখের পানি লুকিয়ে কোনোমতে নীরবতায় স্থির হলো হাশেমা। তবে স্বপ্নপূরণের জেদটা যেন বেশ নড়েচড়ে বসলো মনে।
পার হয়ে গেল দুদিন। আজ যে সিফার চাঁন রাত। বছর ধরে, কতই না দিন গুণে রোজা রেখে আজকের এই আকাঙিক্ষত দিন। পাড়ার বন্ধুরা নানা পোশাকে গুছিয়ে নিয়েছে নিজেদের ঈদ আয়োজন। হাতে মেহেদি দেয়ার নকশা নিয়ে চলছে রীতিমতো ধরাধরি। তবুও আট বছরের বুদ্ধিমতি সিফা আজ একেবারে স্বাভাবিক। অন্যের সুখ দেখেই যেন সে আজ মহা সুখি। আর ক্ষাণিকক্ষণ পরপর মাকে জড়িয়ে, মাতৃঘ্রাণের আড়ালে লম্বা লম্বা দীর্ঘশ্বাস নেয় সিফা।
দিন গড়িয়ে সন্ধ্যা নেমেছে। রুহিসন আজ বিসিকে নকশিকাঁথাগুলো বুঝিয়ে দিয়ে ফিরেছে বাড়িতে। এদিকে অন্যান্য দিনের মতো ইফতার শেষ করে কেবল আঙিনায় নেমেছে সিফা এক হাতে বিজুকে নিয়ে। হঠাৎ পেছন থেকে আচমকা জড়িয়ে ধরে তার রুহিসন চাচি। একটি লাল জামা গায়ে জড়িয়ে হাতে গুঁজে দেয় মেহেদির রাঙা টিউব। সিফার যে আজ সত্যিই চাঁন রাত্রি, যা খোদার কাছে চাওয়া মা হাশেমার সন্তানের জন্য ঈদের শ্রেষ্ঠ উপহার।
কপিরাইট © ২০১৭ - ২০২০ ।। বইদেশ-এ প্রকাশিত কোনও সংবাদ, কলাম, তথ্য, ছবি, কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না
Design & Development by: TeamWork BD