শেষ চিঠি
।। পারভেজ বাবুল ।।
আরিফা আমার সহপাঠী। কলেজে ইন্টারমিডিয়েট ফাইনাল পরীক্ষার সময় আমার সিট পড়লো আরিফার পাশে। পৌরনীতি পরীক্ষার দিন আরিফা আমাকে তার খাতা দেখে লিখতে দিয়েছিল। আমি পরীক্ষায় নকল করতাম না। পৌরনীতি পরীক্ষার আগের রাতে বাজারে যাত্রা গান শুনতে গিয়েছিলাম। তাই ভালোভাবে পড়তে পারিনি। আরিফাকে বললাম সহযোগিতা করতে। সে তার লেখা শেষে আমাকে খাতা দিয়ে বলল, ‘আমার খাতা দেখে লিখতে পারবি?’
সঙ্গে সঙ্গে বললাম, ‘পারবো।’
তারপর আরিফা তার খাতা দিলে তা দেখেই উত্তর লিখলাম।
কলেজে আরিফার নামে নানান জনে নানান বাজে কথা বলতো। কেউ কেউ বলতো, আরিফা একটা বাজে মেয়ে। কারো মুখে শুনতাম আরিফাকে পাঁচশো টাকা দিলেই পাওয়া যায়। সত্য-মিথ্যা জানি না। তবে কথাগুলো আমার বিশ্বাস হতো না।
পৌরনীতি পরীক্ষা শেষে পরীক্ষার হলের বাইরে এসে আরিফাকে বললাম, ‘ক্যান্টিনে আয়। তোকে সিঙাড়া আর চা খাওয়াবো। তুই তোর খাতা না দিলে আমি তো কিছুই লিখতে পারতাম না ‘
ক্যান্টিনে চা খেতে খেতে আরিফা বলল, ‘আমি কলেজ চেঞ্জ করবো। এই কলেজে আর পড়বো না।’
তাকে জিজ্ঞেস করলাম, ‘কেন?’
‘কলেজে ছোট লোক বদমাশ কয়েকটা আছে, মেয়ে দেখলেই তাদের জিভে জল আসে। প্রতিবাদ করলেই নানান বাজে কথা বলে। দুর্নাম রটায়। আমার নামেও অনেক মিথ্যে দুর্নাম রটিয়েছে, আমি নাকি বেশ্যা। আমাকে নাকি চাইলেই ভোগ করা যায়।’
‘সেরকম কিছু কথা আমিও শুনেছি, তবে বিশ্বাস করিনি।’
‘বিশ্বাসযোগ্য হলে তো বিশ্বাস করবি। আমি সিদ্ধান্ত নিয়েছি ঢাকায় শহীদ আনোয়ার গার্লস কলেজে পড়বো। আমার বড় বোনের বাসা মহাখালি। ওর বাসায় থেকে কলেজ করবো ‘
‘ঠিক আছে। নিয়মিত আমাকে চিঠি লিখবি। আমিও লিখবো। প্রতিদিন যেন তোর চিঠি পাই।’
তারপর থেকে আরিফা ঢাকায়, আমি কুমিল্লা। আমরা দুজন দুজনকে নিয়মিত চিঠি লিখি। তখনও বাংলাদেশের বাজারে মোবাইল ফোন আসেনি। তাই যোগাযোগের প্রধান মাধ্যম ছিল চিঠি। চিঠি লিখতে লিখতে আরিফা আর আমি প্রেমে ডুবে গেলাম।
আমি প্রতিদিন পোস্ট অফিসে গিয়ে তার ঠিকানায় চিঠি পাঠাই। সেও আমাকে প্রতিদিন চিঠি পাঠায়। তখন দোকানে চিঠি লেখার রঙিন রাইটিং প্যাড পাওয়া যেত। আমি রঙিন প্যাডে চিঠি লিখে নীল খামে তার ঠিকানায় পাঠাতাম। সেও আরও অনেক সুন্দর রঙিন কাগজে আমাকে চিঠি পাঠাতো। সবচেয়ে ভালো লাগতো তার প্রতিটি চিঠিতে লাল গোলাপের পাপড়ি থাকতো, আর থাকতো বিদেশি পারফিউমের মনকাড়া সুগন্ধ। সে খুব সাজিয়ে-গুছিয়ে চিঠি লিখতো, ব্যবহার করতো বিখ্যাত কবি-লেখকদের ভালোবাসা বিষয়ক উক্তি।
তার প্রতিটি চিঠি অনেকবার পড়তাম। আরিফার মতো অত সুন্দর করে আমি লিখতে পারতাম না। তবে আমি শুধু লিখতাম, ‘তোমাকে ভালোবাসি সুন্দরী।’ তারপর মিষ্টি মেয়ে খ্যাত নায়িকা কবরীর ঠোঁট মেলানো গানটা লিখতাম, ‘চিঠি দিও প্রতিদিন।’ সেও লিখতো ‘হ্যান্ডসাম হিরো, চিঠি দিও প্রতিদিন।’ আরিফার চেহারা ছিল নায়িকা কবরীর মতো। আমি বলতাম কবরীর ফটোকপি।
এক বছর চলল আমাদের চিঠি চালাচালি। তারপর সে ধরা খেলো তার বড় বোনের কাছে। আমার পাঠানো চিঠিগুলো তার বড় বোন দেখে ফেলেছে! ফলে আরিফার কলেজে আসা-যাওয়া বন্ধ হলো। তার বড় বোন আমাকে একটা চিঠি পাঠিয়েছেন খুব কড়া ভাষায়। তিনি লিখেছেন, আমি যেন জীবনে আর কোনোদিন আরিফার কাছে চিঠি না লিখি। তার সঙ্গে যেন কোনোদিন যোগাযোগ না করি।
বড় বোনের চিঠির উত্তর না দিয়ে চুপচাপ থাকলাম। ভালোবাসার মানুষের বিরহ-বিচ্ছেদ বড় কষ্টের! তখন নিজেকে পাগল পাগল লাগতো। আরিফার পাঠানো পুরনো চিঠিগুলো বারবার পড়তাম। তার সঙ্গে দেখা হয় না প্রায় চার বছর। কোথায় আছে কেমন আছে কিছুই জানি না। তার পাঠানো শেষ চিঠিটা এখনও পড়ি। খুব কাব্যিক ভাষায় আরিফা আমাকে লিখেছিল, ‘ভালোবাসা আর সম্মান পেলে সব নারীই বদলে যায়; ফুলের মতো কোমল কমনীয় রমনীয় প্রেমময়ী হয়।’
কপিরাইট © ২০১৭ - ২০২০ ।। বইদেশ-এ প্রকাশিত কোনও সংবাদ, কলাম, তথ্য, ছবি, কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না
Design & Development by: TeamWork BD