ডার্ক ম্যাজিক
।। গাজী হেলাল উদ্দিন ।।
নিশাত আজকাল খুব মনমরা হয়ে থাকে। কোনো কাজেই ঠিকমতো মন দিতে পারে না। প্রথাগত পড়ালেখা তার বরাবরই ভালো লাগে না। ভালোলাগা বলতে তার কাছে হলো গান। নিজেই গান লেখে, নিজেই সুর করে আবার নিজেই গিটারের তালে গলা দেয়। এককথায় গানের ব্যাপারে সে অলরাউন্ডার। কিন্তু তার বাবার বরাবরই আপত্তি গান নিয়ে। ছেলে গান-বাজনা করুক সেটা তিনি চান না। তার ইচ্ছে ছেলে বড় হয়ে ডাক্তার হোক। কিন্তু ছেলের পড়ালেখার হাল দেখে তাকে তার সেই ইচ্ছাকে বিসর্জন দিতে হয়েছে সেদিনই যেদিন নিশাত নবম শ্রেণিতে সায়েন্স না নিয়ে আর্টস নিয়েছিল। সেই দিনের পর টানা একবছর তিনি আর নিশাতের সাথে কথা বলেননি। যখন নবম থেকে দশম শ্রেণিতে নিশাত ভালো নম্বর পেয়ে উত্তীর্ন হলেন, তখন তিনি ছেলেকে নিয়ে আবার নতুন স্বপ্ন দেখতে শুরু করলেন।ডাক্তার না হোক অন্তত সরকারি কোনো উচ্চপদে চাকরি তো সে পেতেই পারে। কিন্তু তার সে আশাও ভেস্তে গেল নিশাতের এসএসসি পরীক্ষার ফলাফল প্রকাশের দিন।এসএসসিতে কোনোমতে টেনেটুনে পাস করেছে নিশাত।সেদিনই আনুষ্ঠানিকভাবে নিশাতের বাবা তার সকল আশা-আকাঙ্ক্ষার বিসর্জন দিয়েছেন। নিশাত এখন একটা বেসরকারি ইউনিভার্সিটিতে পড়ে। বেশ বড় অঙ্কের টাকা দিতে হয় প্রতি সেমিস্টারে। বাবার একমাত্র ছেলে হওয়ায় টাকা যোগাড়ে খুব একটা বেগ পেতে হয় না তাকে। তার বাবা বশির আহমেদ একজন ব্যাংক কর্মকর্তা। মা রাজিয়া আহমেদ প্রাথমিক বিদ্যালয়ের একজন শিক্ষিকা।
পড়ালেখার অজুহাতে নিশাতকে তাদের থেকে দূরে ঢাকার একটা মেসে থাকতে হয়। তার বাবা কর্মসূত্রে থাকেন বরিশালে আর মা থাকেন দেশের বাড়ি রংপুরে।
নিশাতের দিন বেশ কেটে যায়। সকালে ঘুম থেকে উঠে একটু ফ্রেশ হয়েই ছুটতে হয় ক্যাম্পাসে। সারাদিন ওখানেই কেটে যায়। ক্লান্ত শরীরে সন্ধ্যায় বাসায় ফিরে আবার শুরু হয় অনলাইনে বন্ধুদের সাথে আড্ডা। রাতজাগা এই আড্ডার শেষে এক পশলা ঘুম। আবার ঘুম থেকে উঠে সেই নিরন্তর ছুটে চলা। তবে বর্তমানে তার চির পরিচিত জীবন পরিক্রমাতে ছেদ পড়েছে। আজকাল সে নিয়মিত ভার্সিটিও যেতে পারে না। সারাদিন নিজের রুমে কাটিয়ে দেয়। ঠিকমতো কারো সাথে কথাও বলে না। আস্তে আস্তে নিশাত নিজেকে পুরোপুরি ঘরবন্দি করে ফেলে। এখন দিন-রাত সবসময়ই নিজের রুমে পড়ে থাকা। খাওয়া-নাওয়ারও কোনো ঠিক নেই। মেসের অন্যকারো সাথে এখন নিশাত কথা বলে না বললেই চলে। এভাবেই চলে গেল কিছুদিন। কিন্তু একদিন সকালে মেসের অন্য সবাই তার এই হঠাৎ পালটে যাওয়া নিয়ে কথা বলার জন্য তাকে ডাকতে আসে। কিন্তু দেখা গেল তার রুমের দরজা ভেতর থেকে লক করা। কয়েকবার ডাকার পরও কোনো সাড়া না পেয়ে তারা দরজা ধাক্কাতে লাগল। তবুও কোনো সাড়া পাওয়া গেল না। একটা সময় তারা দরজা ভাঙার সিদ্ধান্ত নিলো। বাড়ির মালিককে ডেকে আনা হলো। তার উপস্থিতিতে দরজা ভাঙার আয়োজন শুরু হলো। দরজা ভাঙতে তাদের সবার চক্ষু কপালে। নিশাতের নিথর দেহ ঝুলছে ফ্যানের সাথে। তাদের চিৎকার চেঁচামেচিতে লোক সমাগম বাড়তে লাগল। বাড়ির মালিক স্থানীয় থানায় ঘটনার বিস্তারিত বললে তৎক্ষণাৎ পুলিশের একটা গাড়ি পৌঁছে গেল ঘটনাস্থলে। বাংলাদেশের পুলিশ রেপ আর আত্মহত্যার কেসগুলোতে খুব দ্রুত ঘটনাস্থলে পৌঁছায়। কিন্তু এগুলোর বিচার কার্য হয় ঠিক ততটাই দেরিতে। বেশিরভাগই ধুলোর নীচে চাপা পড়ে যায়।পুলিশ এসে ঘটনার বিস্তারিত জেনে, কয়েকজনকে জেরা করে ময়নাতদন্তের জন্য লাশ নিয়ে যায়। যদিও দারোগা সাত্তার মিয়া বেশি গর্বের সাথে নিশ্চিত যে এটা শ্রেফ আত্মহত্যার কাজ। তার মতে, আজকালকার ছেলেমেয়েরা আত্মহত্যাটাকেও একটা ট্রেন্ড বানিয়ে ফেলেছে। এরইমধ্যে নিশাতের বাবাকে ছেলের মৃত্যুসংবাদ জানানো হয়েছে। তিনি হয়তো এরইমধ্যে ঢাকার উদ্দেশ্যে যাত্রা করেছেন। ডিউটিরত অফিসার আসগর কাজী নিশাতের মোবাইল সংগ্রহ করে তার জিম্মায় নিয়েছে।
দুপুরের একটু পরেই বশির আহমেদ ঢাকায় পৌছান। তিনি সোজা থানায় চলে এসেছেন। একমাত্র ছেলের মৃত্যু তাকে বেশ ঘায়েল করেছে। এখনো রাজিয়া আহমেদকে ছেলের মৃত্যুসংবাদ দেয়া হয়নি। ইচ্ছা করেই দেননি বশির আহমেদ।যা হবার সে তো হয়েই গেছে। শুধু আর বিপদ বাড়িয়ে কি লাভ!
ময়না তদন্তের শেষে ওসি আকবর আলী লাশ হস্তান্তর করেন বশির আহমেদের কাছে। ছেলের লাশ প্রতিটি বাবার কাছেই ভারী বোঝা। তিনি লাশ নিয়ে রওনা দিলেন রংপুরের উদ্দেশ্যে। ছেলের বিপদ আর মা টের পাবে না তা কি হয়! তাদের যে নাড়ীর যোগ। তাই তো আজ সকাল থেকেই কেন জানি খুব অস্থির লাগছে রাজিয়া আহমেদের। তিনি বুঝতে পারছেন নিশাতের কোনো বিপদ হয়েছে। তাই ভোর রাতে যখন অ্যাম্বুলেন্সের আওয়াজ শুনলেন তখনই তার রক্ত হিম হয়ে গেল। সারারাত দু’চোখের পাতা এক করতে পারেননি।দরজা খুলে বাইরে বেরিয়ে এসে দেখলো তারই বাড়িতে আজ অ্যাম্বুলেন্স। চারপাশটা তখন শবে পরিষ্কার হতে শুরু করছে। বশির আহমেদ গাড়ি থেকে নামতেই কান্নায় ভেঙে পড়লো রাজিয়া আহমেদ। তার আর বুঝতে বাকি নেই, নিশাত আর নেই। চারপাশের আকাশ ভারী হতে শুরু করলো।
এদিকে এই ঘটনা তদন্তের জন্য নিয়োগ দেয়া হলো পিবিআইকে। পিবিআই এর নবাগত অফিসার অর্ক এই ঘটনা তদন্তের দায়িত্ব পায়। অর্ক তদন্তের প্রথমেই আসগর কাজীর কাছ থেকে নিশাতের ফোন সংগ্রহ করে। কিন্তু ফোন লকড ছিল। সাইবার টিমের একজনের সহায়তায় সে ফোনের লক খুলতে সক্ষম হয়। অর্ক প্রথমেই ফোনের কল লিস্ট চেক করলো। দেখা গেল শেষ এক সপ্তাহে নিশাত কারো সাথে ফোনে কথাই বলেনি। তারপর মেসেজ চেক করলো। সেখানেও সন্দেহজনক কিছু পাওয়া গেল না। সবশেষে তিনি ফেসবুক আইডিতে প্রবেশ করলো। তখনই তিনি পেলেন এক নতুন সূত্র। ফেসবুক মেসেঞ্জারে তানিয়া বলে একটা মেয়ের সাথে তাকে বেশ কথা বলতে দেখা যাচ্ছে গত একমাস। তাদের লেখা মেসেজগুলোও বেশ অস্বাভাবিক। খোলা চোখে অর্কর মনে হলো তার ব্লাক ম্যাজিক নিয়ে কথা বলেছিল। তবে সবার আগে এই তানিয়াকে খুঁজে বের করতে হবে। তবেই পাওয়া যাবে পরবর্তী ক্লু। ফেসবুকে দেওয়া নাম ঠিকানা খুব একটা বিশ্বাসযোগ্য নয়। বিশেষত মেয়েদের। কিন্তু এক্ষেত্রে বিশ্বাস করা ছাড়া আর উপায় নেই। তানিয়াকে খোঁজ করতে গিয়ে দেখা গেল ফেসবুকের নাম ও ঠিকানা পুরোপুরি সত্য। তবে এটা অর্ককে তেমন অবাক করলো না। অর্কর কপালে ভাঁজ পড়লো তার আগেই যখন জানতে পারলো তানিয়াও ঐ একইদিনে নিজের বাসায় আত্মহত্যা করেছে। অর্ক আরও অবাক হলো যখন জানতে পারল নিশাত ও তানিয়া উভয়ের বাড়িও রংপুরে একই এলাকায়। অর্ক আরেকটু খোঁজ নিয়ে জানতে পারলো তাদের এই ডার্ক ম্যাজিক চর্চায় তাদের সাহায্য করেছিল ফাহাদ নামের আরও একজন রংপুরিয়ান। তার খোঁজ নিয়ে জানা গেল তিনি এখন দেশের বাইরে আছেন। অর্ক তার সাথে ইমো অ্যাপের সাহায্য নিয়ে যোগাযোগ করে। তিনি যা জানালেন তাতে রীতিমত অর্কের রক্ত জমাট হওয়ার যোগাড়। তিনি জানান,
‘নিশাত ও তানিয়া দুজন দুজনকে ভালবাসতো সেই হাই-স্কুল থেকে। তারা একইসাথে একই স্কুলে পার করেছে স্কুল, কলেজ। এমনকি তারা একই ইউনিভার্সিটিতে একই বিষয়ে পড়তো। তবে তারা দুজনেই তাদের এই প্রেমকে অমর করতে চেয়েছে। তারা সবসময়ই বিচ্ছেদের ভয় পেত। সেই ভয় থেকেই তারা চেয়েছিল এমন কোনো উপায়, যার মাধ্যমে তার জন্ম-জন্মান্তরের জন্য এক হয়ে যাবে। সেই থেকেই তাদের ডার্ক ম্যাজিকের পেছনে ছুটে চলা। তখনই তাদের পরিচয় হয় ফাহাদের সাথে। যে ডার্ক ম্যাজিক নিয়ে নিয়মিত চর্চা করে। তখন তারা তার শরণাপন্ন হয়। ফাহাদ তাদের নানা উপায় বলেন। কিন্তু তাদের দুজনের মনপুত হয় এই একটা উপায়।’
অর্ক কৌতুহলী হয়ে বলে উঠলো, ‘কী উপায়?’
ফাহাদ আবার বলতে শুরু করলো,
‘যখন কোনো প্রেমিক ও প্রেমিকা একই উপায়ে একই সময়ে দেহের বেড়াজাল থেকে আত্মাকে মুক্ত করে তখন তাদের আত্মা জন্মা-জন্মান্তরের জন্য এক হয়ে যায়। তাদের আর কেউ আলাদা করতে পারবে না। ওরা তাই করছে এবং দুই আত্মার মিলন হয়েছে।’
‘আপনি এসবে বিশ্বাস করেন?’ অর্ক বলল।
‘এটা চিরন্তন সত্য।’
অর্ক তার তদন্ত আর এগিয়ে নিয়ে যায়নি। স্রেফ আত্মহত্যার কেস বলে চালিয়ে দিয়েছে। তবে তার আজও মনে হয় স্রেফ একটা ছলনায় দুইটা মূল্যবান জীবন হারিয়ে গেল।
সময় বয়ে চলে তার আপন গতিতে। দেখতে দেখতে একবছর পেরিয়ে গেল। অর্কও ভুলতে বসেছে নিশাতের কেসটা। এমনি একদিন সকালে পত্রিকার শিরোনামে তার চোখ আঁটকে গেল।
‘ডার্ক ম্যাজিসিয়ান ফাহাদের বাসা থেকে তার ঝুলন্ত লাশ উদ্ধার।’
কপিরাইট © ২০১৭ - ২০২০ ।। বইদেশ-এ প্রকাশিত কোনও সংবাদ, কলাম, তথ্য, ছবি, কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না
Design & Development by: TeamWork BD